পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : চিত্র-বিচিত্র নাকি এ ঘটনা মানবতা বিবর্জিত! পৃথিবীর কোনো মানুষই হতদরিদ্র হতে চায় না। নীতিবান এবং যাদের অর্থের প্রতি লোভ নেই তিনিও স্বাভাবিকভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে চান। কাঙাল হয়ে বাঁচতে চান না। অথচ উল্টো ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। অবস্থা আলেকজান্ডারের ‘সেলুকাস বিচিত্র এই দেশ’ মতোই। ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রী শুরু হওয়ার পর দেশের কিছু বিত্তবানের মধ্যে এখন হতদরিদ্র হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। স্বাবলম্বী বা সম্পদশালী নয়; সবাই হতে চাচ্ছেন কাঙাল-হতদরিদ্র। দারিদ্র্যসীমার নীচে নামার যেন মহারণ শুরু হয়ে গেছে। সারাদেশের ৫০ লাখ কর্ম-অক্ষম হতদরিদ্র মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রী শুরু হওয়ার পর এ চিত্র দেখা দেয়। ইনকিলাবসহ বিভিন্œ দৈনিক পত্রিকা পড়ে এবং টিভি’র খবর দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। ক’দিন আগে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা সফরেও সেটা জেনেছি। বিল্ডিং, পাকা বাড়ির মালিক, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা সবাই নাম লেখাচ্ছেন হতদরিদ্রের তালিকায়। উদ্দেশ্য গরীবের খাবারে ভাগ বসানো। শত বছর আগে যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় এদের কথাই লিখে গেছেন।
‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। কবির এই পংক্তিতে সেই পুরনো যুগে ‘গরীবের সম্পদের ওপর’ বিত্তশালী ধনাঢ্যদের ‘লোভাতুর দৃষ্টি’ চিত্রায়িত হয়েছে। সে যুগে বিজ্ঞানের এতো সাফল্য ছিল না; ছিল না মানুষের জীবন-মানের উন্নতি। তারপরও গরীবের সম্পদের ওপর ধনী-বিত্তবানদের লোভ ছিল; এখনো আছে। বরং কিছু লোভাতুর মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা শতগুণ বেড়েছে। কাঙালদের ধনে ভাগ বসাতে বিত্তবানদের কেউ কেউ মুখিয়ে আছেন। আওয়ামী ঘরাণার এই লোভাতুররা নিম্ন বিত্তের মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রীর সরকারের সৎ উদ্দেশ্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের নেতারা ১০ টাকার চালের ওপর শকুনি দৃষ্টি ফেলায় গ্রামে-গঞ্জে এ নিয়ে রীতিমতো চলছে তোলপাড়। মিডিয়াগুলোতে নিত্যদিনের খবর হলো ১০ টাকার চাল নিম্ন বিত্তের মানুষের চেয়ে বেশি নিচ্ছেন বিত্তবানেরা। তাদের নির্লজ্জ বক্তব্য ‘দল ক্ষমতায়, এটুকু সুবিধা আমরা নিতেই পারি’।
বর্তমান সরকার হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রীর ‘খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি’ ঘোষণা করে। সারাদেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষের মাঝে এ চাল বিক্রী হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ৭ সেপ্টেম্বর এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এরপর প্রশাসনের দায়িত্বশীল আর তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের সিন্ডিকেটে শুরু হয় চাল নিয়ে চালবাজি। বিত্তবানদের মধ্যে কাঙাল হয়ে দারিদ্র্যসীমার নীচের তালিকায় নাম লেখানোর চলে প্রতিযোগিতা। বিত্তবানরা কে কত গরীব-নিঃস্ব সেটাই যেন প্রমাণের চেষ্টা! উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা ঘুরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এই ভয়াবহ চিত্র। চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন জানান, প্রধানমন্ত্রী ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’ উদ্বোধন করে চলে যাওয়ার পর দুস্থদের খাতায় নাম লেখাতে ৫০ টাকা থেকে একশ’ টাকা নেয়া শুরু হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের লোকজন নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যক্তিদের নামে কার্ড বিতরণ করার নির্দেশনা দেন।
দেশের হতদরিদ্ররা যাতে খেতে পায় সে লক্ষ্যে নামেমাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত উৎসাহব্যঞ্জক। অথচ জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০ টাকায় চাল নেয়ার জন্য প্রণীত তালিকায় নাম উঠাতে একশ’ থেকে একশ’ কুড়ি টাকা করে নেয়া হচ্ছে। মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে ১০ টাকা চালের তালিকায় হতদরিদ্রদের পরিবর্তে নাম উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, মহাজন, আবাসিক হোটেলের মালিক, কলেজের শিক্ষকসহ সচ্ছল ও বিত্তবানদের। ইনকিলাব, প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, সংবাদসহ প্রায় অর্ধশত পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে ১০ টাকা কেজি দরে চালের কার্ড বিত্তবানদের হাতেই বেশি যাচ্ছে। এমনিতেই এ কর্মসূচির ডিলার নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তারপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তথাকথিত হতদরিদ্রদের নাম দিচ্ছেন। এতে প্রকৃত গরীব মানুষের অধিকাংশের নাম বাদ যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিত্তবানদের নাম তালিকায় উঠছে। এছাড়াও কার্ড নামের সোনার হরিণ হাতে পাওয়ায় যারা চাল পাচ্ছেন তাদের ২-৩ কেজি কম দেয়া হচ্ছে। জেলা উপজেলা পর্যায়ের খাদ্য অফিস কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের পরস্পর যোগসাজশে হচ্ছে এসব অনিয়ম আর দুর্নীতি। যেন সবাই কোমড় বেঁধে মাঠে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত দরিদ্রবান্ধব মহতি এ উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিতে। আর মন্ত্রণালয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী স্বভাবসুলভ চিৎকার করেই যাচ্ছেন ‘দুর্নীতি সহ্য করা হবে না’। সর্বোচ্চ আদালতে দ-প্রাপ্ত এ মন্ত্রীর নির্দেশ কে শোনে!
দুর্নীতি ইস্যুতে আমাদের যা অবস্থা তাতে মানুষ ধরেই নিয়েছে দেশে দুর্নীতি হবে; এটা নিয়তি। সেটা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে। পিয়ন পদে চাকরি পেতে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। স্কুলের শিক্ষক পদে দিতে হয় ৭ লাখ থেকে ১০ লাখ। অন্যান্য ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। অব্যবস্থা, অন্যায়, দুর্নীতি এগুলোকে মানুষ ‘নিয়তি’ হিসেবে ধরেই নিয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতিকে আগে মন্দ মনে করা হলেও এখন কার্যত ‘সাফল্য’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। না হলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো প্রবীণ ব্যক্তিও ঘুষের পক্ষে সাফাই গাইতেন না। মূলত বিশ্ব দরবারে দেশ যতোই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা সামনে মধ্যবিত্ত হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠুক সাধারণ মানুষের তাতে কিছু আসে যায় না। অনৈতিক নেতৃত্বের কারণে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। যখন জানা যায়, গ্রামে হতদরিদ্রদের নামের বদলে পাকা বহুতল বাড়ির মালিক, আওয়ামী লীগ নেতা, কলেজের অধ্যাপক নিজে এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে ১০ টাকা কেজির কার্ড করিয়েছেন; ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা বলেন ‘দল যখন ক্ষমতায় তখন এটুকু সুবিধা নিতেই পারি’; তখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে মানুষ্যবোধ, মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থানের পারদ কত নীচে নেমে গেছে। শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ যেসব পেশার মানুষকে সমাজের জনগণ নির্ভরতার চোখে দেখেন তাঁদের এমন আচরণে জানান দেয় আমাদের অধোগতির স্তর কত দূর নেমেছে।
জনগণের ভোটের অধিকার চুকেবুকে গেলেও দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, হত দরিদ্রের সংখ্যা কমছে বলে বলছে বিশ্বব্যাংক। কুড়িগ্রামের চিলমারীসহ মঙ্গার দেশ ঘুরে সে চিত্রই পাওয়া গেল। উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা বা আকাল এখন আর নেই বললেই চলে। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে এবং মানুষ কাজ করছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছেন, গরীবরা ক্রমান্বয়ে আরো গরীব হচ্ছেন। মানুষের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়, আচরণেও। যে সব পরিবারে কর্মক্ষম মানুষ নেই, হতদরিদ্র এবং সে সব পরিবারের জন্য ১০ টাকা কেজির চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র।
১০ টাকা কেজি দরে চাল এক সময় ছিল রাজনৈতিক ইস্যু। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় টাঙ্গাইলে নির্বাচনী এক জনসভায় শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন তার নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবেন। যদিও আওয়ামী জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। তারপরও দলটির অধিকাংশ নেতা নির্বাচনী প্রচারণায় ১০ টাকা মূল্যে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে সেটা সম্ভব না হওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দল ১০ টাকা চাল খাওয়ানের ইস্যু নিয়ে সরকারকে নাস্তানাবুদ করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রচার করে তারা এধরনের প্রতিশ্রুতি দেননি। দেরিতে হলেও ১০ টাকা চাল বিক্রীর সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন।
গরীব মানুষ সৎ নেতা, সৎ কর্মকর্তাকে কাছে পেতে চায়। কিন্তু প্রশাসন কেবলই পরিবেষ্টিত আছে কতগুলো নষ্ট মানুষ দ্বারা। দরিদ্র মানুষ রাস্তা চায়, স্কুল চায়, হাসপাতাল চায়, খুব সাধারণভাবে বাঁচতে চায়। মোটা ভাত মোটা কাপড় তাদের প্রত্যাশা। যারা সেটাও পাচ্ছেন না তাদের জন্য ১০ টাকার চাল। দুঃখজনক হলো আমাদের রাজনীতি আর প্রশাসনিক সংস্কৃতি তার এই সামান্য চাওয়াটুকুও কেড়ে নেয়। যখন রাষ্ট্র স্ব-উদ্যোগে গরীবকে কিছুটা দিতে এগিয়ে এলো তার ওপর পড়লো ধনিক শ্রেণীর লোলুপ দৃষ্টি। ১০ টাকা মূল্যের চাল পেতে সবাই যেন কাঙাল হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে চলুন আমরা সবাই কাঙাল হই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।