দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অসংখ্য মাদ্রাসা মসজিদ খানকা প্রতিষ্ঠা করে কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা প্রচারে যাদের মহান অবদান রয়েছে, তাদের মধ্যে জনাব আলহাজ্জ হযরত মাওলানা মির্জা মুহাম্মদ এনায়েতুর রহমান বেগ আল কাদেরী (রহ.) সাহেব অন্যতম। ১৯৩৯ সনের এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ মুতাবিক ১৩৪৬ সালের ১লা বৈশাখ সোমবার সুবহে সাদিকের পবিত্র সময়ে বরিশালে তাঁর জন্ম হয়। তার পিতা বিখ্যাত পীর আলহাজ্জ হযরত মাওলানা ইয়াছিন বেগ আল কাদেরী (রহ.) ছিলেন একজন ওলিয়ে কামিল ও বুজুর্গ ব্যক্তি। তাই পারিবারিকভাবে সম্ভ্রান্ত আলিম বংশের সন্তান হিসেবে ধর্মীয় পরিবেশেই বড় হতে থাকেন মাওলানা মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ।
বরিশাল শহরের আমানতগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। এ মাদ্রাসা হতেই সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভ করেন তিনি। প্রকৃত জ্ঞানী সর্বদাই জ্ঞানের অতৃপ্তিতে ভোগেন। কুরআন-হাদীস ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও মির্জা এনায়েত বেগ অতৃপ্ততার যাতনা অনুভব করেন। জ্ঞান স্পৃহা তাঁকে বেকারার করে তোলে। তাই তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাংলার দেওবন্দ হিসেবে খ্যাত ‘দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’ মাদ্রাসায় ইলম শিক্ষার জন্য ছুটে যান। দেওবন্দ থেকে বড় বড় শায়খগণ এখানে প্রায়ই তাশরিফ আনতেন বিধায় তাদের সাহচর্য লাভের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা ছিল তাঁর প্রবল। হাটহাজারী থেকে সকলকে মুগ্ধ করে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। শরীয়াতের ইলম শিক্ষা সমাপ্ত করে ইলমে মারিফাত শিক্ষা গ্রহণে তিনি আত্মনিয়োগ করেন, স্বীয় পিতা কামিল ওলী হযরত মাওলানা ইয়াছিন আল কাদেরী (রহ.)-এর হাতে বয়াত গ্রহণ করে মারিফাতের শিক্ষা ও অনুশীলন শুরু করেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি চারি তরিকায় পূর্ণ কামালিয়াত হাসিল করেন। এরপর স্বীয় পিতার নির্দেশে দীন প্রচারে মনোনিবেশ করেন অতি অল্প সময়েই সর্বগুণে গুণান্বিত আবেদ, আলেম, ইসলাম প্রচারক হিসেবে তার নাম দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় ১৯৬৩ ইং সনের নভেম্বর মাসে বিশ্ববিখ্যাত পীর, কামিল ওলী কুতুবে যামান হযরত মাওলানা আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) এর প্রথমা কন্যার সাথে মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ সাহেবের শাদী মোবারক সুসম্পন্ন হয়। এ ঘটনায় বেগ সাহেবের জীবনে বহুমুখী চেতনার বিকাশ ঘটে। একদিকে স্বীয় পিতার দীক্ষা অন্যদিকে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী শ্বশুরের নেক ফয়েজে তিনি সাহসাই আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চ মার্গে পৌঁছে যান। উভয় দিক থেকে তিনি খিলাফতপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় দীনী শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি জনসাধারণকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও শিক্ষাদান করতে থাকেন। ১৯৭০ ইং সনে তার মহান পিতা ইন্তেকাল করেন। এরপর তিনি বরিশালের ঐতিহ্যবাহী জামে এবাদুল্লাহ মসজিদের খতিব হিসেবে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। ইতোপূর্বে তিনি চর কাউয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯৭২ সনে তিনি বরিশাল মাহমুদিয়া মাদ্রসার সহ-অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। একই সঙ্গে তিনি মাদ্রাসার কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ তিনটি পদে অধিষ্ঠিত থেকে কুরআন ও হাদীসের খিদমত করেছেন। তৈরী করেছেন ইসলামের অসংখ্য খাদেম, মুবাল্লিগ, হাফেজ, আলিম ও ক্বারী। তিনি (১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৭৮ এবং ১৯৮৭ ইং সনে) মোট চারবার পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি মিশর, ইরাক, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফর করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ১৯৭৫ সনে বাগদাদে বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর মাযার শরীফে তিনি দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইরাকের তৎকালীন পীর ও বড়পীর ছাহেবের মাযার মসজিদের পেশ ইমাম ও খতীব হযরত ইউসূফ জিলানী (রহ.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তাঁর কর্তৃক খিলাফত প্রাপ্ত হন। মাদ্রাসায় শিক্ষা দানের পাশাপাশি তিনি দেশের বহু অঞ্চলে ব্যাপক সফর করে মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপৃত থাকেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি বহু মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তব, খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। মির্জা এনায়েত বেগ সাহেব দীনের প্রচারের জন্য অনেক গ্রন্থ ও রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে কুরবানী কি ও কেন, ঈদ মোবারক, রমজানুল মোবারক, শবে ক্বদর, মাহে মুহাররম ও শবে বরাত প্রভৃতি অন্যতম। রমজানুল মোবারক গ্রন্থটি দীর্ঘদিন পরে এ বছর রমজানে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বিপুল চাহিদার কারণে স্বল্প সময়েই তা নি:শেষ হয়ে যায়।
১৯৮৮ সনের ১২ ই সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা আগমনের সময় লঞ্চে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অত:পর ১৩ই সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদে বাংলাদেশের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ঐদিন বাদ আছর ঢাকায় বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজের হাজার হাজার আলিম ওলামা পীর মাশায়েখ অংশগ্রহণ করেন। জানাজায় ইমামতি করেন ততকালীন খতিব মাওলানা উবায়দুল হক। বরিশালে দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিখ্যাত পীর কুতুবুল আকতাব শাহ আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) জানাযায় ইমামতি করেন। তাতে মরহুম চরমোনাই পীর সাহেব সৈয়দ ফজলুল করিম (র.) সহ দক্ষিণাঞ্চলের সকল দরবারের পীরসাহেবসহ অসংখ্য ওলামা-মাশায়েখ ও লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হন। বরিশালের বিশাল ঈদগাহ মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় একই সাথে পাশের বঙ্গবন্ধু উদ্যান (ব্রেস পার্ক) নিয়ে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বরিশালের কেন্দ্রীয় মুসলিম গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সুযোগ্য মেজ ছেলে মাওলানা মির্জা নুরুর রহমান বেগ জামে এবাদুল্লাহ মসজিদে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন।
তার ছিল বহু গুণগ্রাহী, ভক্ত ও মুরিদ। আচারে-ব্যবহারে, ইলমে আমলে তিনি একজন কামিল ওলীরই প্রতিচ্ছবি ছিলেন। তাঁর সাথে যিনি একবার কথা বলেছেন, সংস্পর্শে এসেছেন প্রয়োজনে কি অপ্রয়োজনে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, জীবনে তিনি তাঁকে ভুলতে পারেনি। তাঁর কথায় আচরণের ছিল এক যাদুকরী প্রভাব। মানুষকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করত তাঁর ব্যক্তিত্ব। কি হিন্দু, কি মুসলিম, কি অন্য ধর্মের লোক, কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত, কি চেনা অচেনা, যে একবার তাঁকে দেখেছে হৃদয়ে তার দাগ কেটেছে গভীরভাবে। আর্তপীড়িতদের সেবা ও সমাজ সেবামূলক বহু কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে তিনি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। মরহুম মাওলানা মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ (র.) তাই মরেও অমর হয়ে আছেন।
লেখক : প্রভোস্ট, কবি জসিম উদ্দীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।