ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
(৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিতের পর)
সিদ্দিকী খেলাফত আমলে কোরআন সংকলনের ইতিহাস জানতে হলে প্রথমেই খেলাফতের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া দরকার। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) প্রথম খলিফা হিসেবে যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তিনি যে তিনটি প্রধান সমস্যার সম্মুখীন হন সেগুলো হচ্ছে : রসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক প্রেরিত হজরত ওসামা ইবনে জায়দ (রা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযান হুজুর (সা.)-এর ওফাতের কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া এবং তা পুনরায় প্রেরণের বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ দেখা দেওয়া, জাকাত অস্বীকারকারীদের একটি দলের উদ্ভব হওয়া ও তাদের দমন সমস্যা এবং মোরতাদ ও নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া। তিনটি বিষয়েরই স্বতন্ত্র বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। শেষোক্ত বিষয়ের সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ অভিযান জড়িত, আমাদের আলোচ্য বিষয় ইয়ামামা যুদ্ধ :
হিজরি ১২/৬৩৩ সালের ঘটনা। ইয়ামামার একটি স্থানের নাম আকরাবা যা হাদিকাতুল মওত (মৃত্যুর বাগান) নামে পরিচিত। এ বিশাল বাগানে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার মোসায়লাতুল কাজ্জাব তার বিপুল সংখ্যক সৈন্যসহ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল বলে স্থানটি মৃত্যুর বাগান নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সাধারণভাবে একে বলা হয় ইয়ামামার যুদ্ধ।
ইসলামের ইতিহাস ও সিরাত গ্রন্থগুলোতে ইয়ামামা যুদ্ধের বিশদ বিবরণ রয়েছে। ঘটনাটি সংক্ষেপে নি¤œরূপ :
মোসায়লামাতুল কাজ্জব ছিল বনু হানিফা গোত্রের লোক। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের বিরুদ্ধে খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) যে কটি অভিযান পরিচালনা করেন সেগুলোর মধ্যে ইয়ামামার যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে মোসায়লামা ও তার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের ফলে ভ- নবীদের উৎপাত বন্ধ হয়ে যায়। এ যুদ্ধে মোসায়লামার সৈন্য সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার। পক্ষান্তরে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম।
উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হওয়ার একপর্যায়ে হজরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) রণকৌশল হিসেবে মোসায়লামাকে আক্রমণ করেন এবং সে প্রাণ রক্ষার্থে নিকটস্থ এক বাগানে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থা দেখে তার বাহিনীর সৈন্যরাও দৌড়ে গিয়ে বাগানে আশ্রয় নেয় এবং সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা বাগানের প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। অতঃপর একজন মুসলমান দুঃসাহসিকভাবে প্রাচীর টপকে বাগানের ভিতরে প্রবেশ করেন এবং ভিতর থেকে দরজা খোলেন। মুসলিম বাহিনী দ্রুত বাগানে প্রবেশ এবং তাদের হত্যা করতে থাকে। ওয়াহশী ও তার এক সঙ্গীর হাতে মোসায়লামাতুল কাজ্জব নিহত হন। বাগানে ভ- নবী ও তার অনুসারী সৈন্যদের রক্তের সয়লাব বইতে থাকে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী বনু হানিফার একুশ হাজার লোক মারা যায়। তাদের মধ্যে সাত হাজার লোক আকরাবা রণাঙ্গনে নিহত হয়, সাত হাজার মৃত্যু বাগানে নিহত হয় এবং সাত হাজারকে হত্যা করা হয় পলায়নকালে। বাকিরা হয়তো পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অপরদিকে মুসলমান শহীদদের সংখ্যা ছিল এক হাজার, তাদের মধ্যে কালামুল্লাহ শরীফের হাফেজের সংখ্যা ছিল অধিক এবং মোহাজেরীন ও আনসারের সংখ্যা ছিল ৩৬০।
এ ঘটনাই ছিল সিদ্দিকী আমলে কোরআন সংকলনের পটভূমিকা। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোরতাদদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে এবং বিশেষভাবে ইয়ামামা যুদ্ধে কোরআনের হাফেজ শহীদ হয়ে যাওয়ায় প্রথমে হজর উমর (রা.)-এর আশংকা হয় যে, এভাবে হাফেজে কোরআন শহীদ হতে থাকলে কোরআনের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিতে পারে। তাই কোরআন সময়ের প্রয়োজন এবং তা একটি মাসহাবে লিপিবদ্ধ থাকা দরকার।
হজরত ওমর (রা.) তাঁর এ চিন্তার কথা খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-কে বলেন। এ কথা শুনে হজরত আবু বকর (রা.) ইতস্ততা বোধ করলেন এবং বললেন, যে কাজ রসুলুল্লাহ (সা.) করেননি, তা আমি কীভাবে করতে পারি। এতে হজরত ওমর (রা.) বলেন, এটি তো অতি উত্তম কাজ। অতঃপর হজরত আবু বকর (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে অহি লেখক হজরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.)-কে তলব করেন এবং বলেন, আপনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে অহি লিখতেন, উমর (রা.) আমাকে একটি কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। আপনার মতও যদি তার মতো হয় তা হলে আমি সে কাজ করার অনুমতি দান করব। তা না হলে নয়। এরপর হজরত আবু বকর (রা.) হজরত উমর (রা.)-এর প্রস্তাবটি পেশ করেন। প্রথমে হজরত জায়দ (রা.) এ মতের প্রতি সমর্থন দেননি এবং বললেন, যে কাজ আল্লাহর রসুল (সা.) করেননি তা আমি কীভাবে করতে পারি। কিন্তু হজরত উমর (রা.) তাকে এই কথা অনুপ্রাণিত করেন যে, এটি তো উত্তম কাজ। হজরত জায়দ (রা.) বলেন, আমাকে যদি পাহাড় উঠানোর নির্দেশ দেওয়া হতো সম্ভবত তা এত কঠিন হতো না, যা এ খেদমত আনজাম দিতে অনুভব করছি।
অতঃপর হজরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.) এ দায়িত্ব পালনে সম্মত হন এবং তিনি গাছের ছাল, কাপড়ের টুকরা, খেজুরের পাতা, বকরি ও উটের পাঁজরে হাড় এবং লোকের কাছ থেকে কোরআন উদ্ধার করে একত্রিত করেন। সূরা তওবার দুটি আয়াত লাকাদ জাআ কুম রাসূলুন মিন আনফুসিকুম (শেষ পর্যন্ত) কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। এ অংশটি খোজায়মা ইবনে সাবেতের মুখস্থ ছিল, এ অংশটুকু তার কাছ থেকে নিয়ে কোরআনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং একট্টা করা সমগ্র কোরআন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেদমতে অর্পণ করা হয়। তাঁর ওফাতের পর কপিটি হজরত উমর (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত থাকে। তিনি যখন শাহাদাতবরণ করেন তখন কপিটি তাঁর কন্যা ও হুজুর (সা.)-এর স্ত্রী উম্মুল মোমেনীন হজরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। হজরত উসমান (রা.) খলিফা হওয়ার পর একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোরআন হাকিমের এমন একটি মহান খেদমত আনজাম দেওয়া হয় যা কিয়ামত পর্যন্ত চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যা বিকৃত করার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা সে ঘটনাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে চাই। আর তা হচ্ছে এই :
হজরত উসমান (রা.)-এর খেলাফত আমলে হজরত হোজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) খলিফার নির্দেশে জেহাদের উদ্দেশ্যে ইসলাম লশকর নিয়ে আর্মেনিয়া গমন করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনকালে সাঈদ ইবনুল আসও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হোজায়ফা (রা.) সাঈদ (রা.)-কে বললেন, এ সফরে আমি এক অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি যে, লোকেরা কোরআন কারিমে কেরাত পাঠে মতভেদ করছে। তাদেরকে এ অবস্থায় রাখা হলে বিচিত্র নয় যে, এ মতভেদ বিরোধ স্থায়ী আকার ধারণ করতে পারে, যা সংস্কারযোগ্য থাকবে না। সাঈদ (রা.) যখন বিষয়টির বিস্তারিত জানতে চান তখন হোজায়ফা (রা.) বললেন, হোসেম বাসীরা বলে যে, আমাদের কোরআনের কেরাত (পাঠ) অন্য লোকদের চেয়ে উত্তম। কেননা আমরা কোরআন মেকদাদ (রা.)-এর নিকট পাঠ করেছি। বসরাবাসীদের বক্তব্য, আমাদের কেরাত সর্বোত্তম কারণ আমরা কোরআন পাঠ করেছি আবু মুসা আশআরী (রা.)-এর নিকট। এ লোকেরা হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) -এর মাসহাফের নাম লুবাবুল কুলুবা রেখেছিল। কুফার লোকদের দাবি, কোরআনের সঠিক কেরাত আমরাই জানি। কেননা আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। মোট কথা, এক এলাকার মুসলমানরা অপর এলাকার মুসলমানদের তানা তিরস্কার করতে থাকে এবং তারা প্রত্যেকে নিজের কেরাতকে সঠিক মনে করেন। হোজায়ফা (রা.) বলেন, কোরআন হাকিম একই কেরাতে সংকলিত হওয়া উচিত, তা না হলে বিরোধ বাড়তে থাকবে। হজরত হোজায়ফা (রা.) কুফায় পৌঁছার পর সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সমর্থকরা জোর গলায় বলতে থাকে যে, তাদের কেরাত অধিক সঠিক। ফলে কথা কাটাকাটি বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। এমতাবস্থায় হজরত হোজায়ফার (রা.) কূফা হতে মদিনা গমন করেন এবং হজরত উসমান (রা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ঘটনার বিবরণ দান করেন। হজরত উসমান (রা.) সাহাবাগণকে ডেকে এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শ চান এবং সবাই হজরত হোজায়ফা (রা.)-এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন যে, কোরআন হাকিমের কেবল মাত্র একটি কপি অক্ষত রেখে সমগ্র মুসলমানকে একই কোরআনে সমবেত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং কোরআনের যে কপিটি হজরত আবু বকর (রা.)-এর নির্দেশে লেখা হয়েছিল এবং হজরত হাফসা (রা.)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল তা আনা হয় এবং সাহাবাগণের একটি দলকে ওই কপি নকল করার জন্য নিয়োগ করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন হজরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে জোবায়রা (রা.), সাঈদ ইবনুল আস (রা.) এবং আবদুর রহমান ইবনে হারেস (রা.) ইবনে হেশাম-এ সাহাবিগণ হজরত উসমান (রা.)-এর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে হজরত হাফসা (রা.)-এর নিকট রাখা কোরআনের বিভিন্ন কপি নকল করেন এবং ফাতহুলবারী এর বর্ণনা অনুযায়ী ওইসব কপি সা¤্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয় এবং খলিফা উসমান (রা.)-এর নির্দেশে বাকি সব কপি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কেরাতে (পাঠে) কোনো প্রকার বিরোধ না থাকে।
এ বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করে একটি মহল ভুল ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য পেশ করে থাকে যে, হজরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফত আমলের পূর্বে কোরআনের তরতীব অর্থাৎ বিন্যাস সাধন করা হয়নি, তিনি সর্ব প্রথম এ কাজ করেন এবং হজরত উসমান (রা.)-এর নির্দেশে কোরআনের যেসব কপি করানো হয় সেগুলোর বিন্যাস সাধন করা হয় তারই তত্ত্বাবধানে। এতে বোঝা যায় যে, হজরত উসমান (রা.) এ বিনাশ সাধনে নিজে কিছু পরিবর্তন আনয়ন করেছেন। এটি ভুল ও বিভ্রান্তিকর ধারণা যা পূর্বেই বলা হয়েছে।
সার কথা এই যে, রসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করেন, সে সময় তিনি যে কোরআন রেখে যান তা কিতাবী অর্থাৎ লিখিত আকারে একস্থানে ছিল না। তবে কোরআনের আয়াতসমূহ এবং সূরাগুলো বর্তমানের মতো বিন্যাস্ত ছিল কিন্তু সেগুলো বিক্ষিপ্তভাবে নানা স্থানে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, যার বিবরণ আগে প্রদত্ত হয়েছে। খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ইয়ামামা যুদ্ধের পরবর্তী বিক্ষিপ্ত সব অংশ জমা করে সেগুলোকে কিতাব আকারে সাহাবিদের দ্বারা লেখান। যার দায়িত্বে ছিলেন জায়দ ইবনে সাবেত (রা.)। প্রথম খলিফার এটিই ছিল সবচেয়ে বড় কীর্তি। বস্তুত জামেউল কোরআন তিনিই ছিলেন। হজরত উসমান (রা.) কেরাতে বিদ্যমান বিরোধ দূর করে একটি মাত্র কেরাত অক্ষুণœ রাখেন এবং তার বহু কপি নকল করে সেগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে দেন এবং এটাই তার বড় র্কীতি। এ হিসেবে তিনি কোরআনের সংকলক।
সিদ্দিকী খেলাফত আমলে লেখা কোরআনের যে কপি উদ্ধারের খবর প্রকাশিত হয়েছে তা এক সেরা আবিষ্কার। এর পূর্ণাঙ্গ কপি প্রচার করা সম্ভব হলে বিরুদ্ধবাদীদের কোরআন সংকলন সম্পর্কিত অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। (সমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।