Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে যে কারণে ভারতকে সতর্ক করলেন শেখ হাসিনা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২১, ১১:১৬ পিএম

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় দুদিন ধরে দুর্গা পূজার মণ্ডপে হামলা ভাংচুরের পর বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপরাধীদের কঠোর শাস্তি এবং সেই সাথে জোর কণ্ঠে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গিকার করেন। দেশের হিন্দু নাগরিকদের অধিকার এবং নিরাপত্তা রক্ষায় তার সরকারের অঙ্গীকারের কথা বহুবারই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। কিন্তু বুধবার শেখ হাসিনা ভারতকে সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতকেও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয়, যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে, আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে। –বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের সরকারের উঁচু পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে ভারতের অভ্যন্তরীণ স্পর্শকাতর কোনো বিষয় নিয়ে আপত্তি-অস্বস্তির কথা বলার নজির বিরল। সাধারণত এতোটা স্পষ্ট বার্তা আমরা ভারতকে দেইনা, যদিও তারা অনেক কথা বলে। এমনকি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অত্যন্ত ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তি নোংরা ভাষায় বাংলাদেশকে অপমানও করেছেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে আগে ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীর প্রসঙ্গ টেনে তাদেরকে উইপোকার সাথে তুলনা করেছিলেন, যা নিয়ে তখন বাংলাদেশে জনমনে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে অন্তত প্রকাশ্যে তা নিয়ে ভারতের কাছে কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি।

সেই বিবেচনায় বুধবার ভারত নিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল বিরল একটি ব্যতিক্রম। কী বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি ভারতকে? বার্তা স্পষ্ট। ভারতে সাম্প্রদায়িক ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া হয় এবং ভারত যেন তা মনে রাখে এবং সেদিকে নজর দেয়, বলেন তৌহিদ হোসেন। এবং শেখ হাসিনার এই বক্তব্য যে সত্যি তার দু:খজনক প্রমাণ আমরা দেখেছি ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হুমকিতে পড়েছে উদ্বেগ বাড়ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় - বিশেষ করে মুসলিমরা - দিনে দিনে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পিটিয়ে হত্যার মত বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, এবং উগ্র হিন্দুত্ব-বাদীদের উদ্ধত আচরণকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া নিয়ে ভারতের ভেতরেই অনেক অভিযোগ উঠছে।

বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশের সরকার হিসাবে ভারতের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেশী দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার এবং বাংলাদেশে তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে অস্বস্তি- উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে অনেক পর্যবেক্ষক কম-বেশি নিশ্চিত। 'বার্তা স্পষ্ট, ভারতে সাম্প্রদায়িক ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া হয় এবং ভারত যেন তা মনে রাখে এবং সেদিকে নজর দেয়‘ বললেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন । আওয়ামী লীগ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে দেখে এবং বাংলাদেশে যাতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদ ঘাঁটি গাড়তে না পারে তার জন্য তৎপর। ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন পাশের পর গত বছর অন্তত দুজন মন্ত্রীর দিল্লিতে নির্ধারিত সফর শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়। ঐ সিদ্ধান্তকে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষের বার্তা হিসাবে দেখা হয়েছিল।

তৌহিদ হোসেন যিনি কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নয় বছর ভারতে বসবাস করেছেন, তিনি বলেন, ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার নি:সন্দেহে আওয়ামী সরকারের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে। আপনি যদি দেখেন পাশের বাড়ি ধর্মীয় কট্টরপন্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ যে চরিত্র ছিল তা এখন খুব কমই অবশিষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আমি আদর্শ কোনো পরিস্থিতি হিসাবে মনে করিনা। সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশেও রয়েছে, অনেক সুযোগসন্ধানী রয়েছে। কিন্তু ভারতে এই পরিস্থিতি এখন আরো খারাপ বলে আমি মনে করি। তৌহিদ হোসেন বলেন, বিজেপি সরকার আইন করে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি তৈরির চেষ্টা করছে এবং তার মতে, তাতে তারা অনেকটাই সফল সফল হয়েছে। বহু বহু বছর পর ভারতে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক একটি প্লাটফর্মের ওপর ভর করে দাঁড়ানো একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দেশ শাসন করছে। সুতরাং এটা বলা অসঙ্গত হবে না যে, সেদেশের সমাজে সাম্প্রদায়িকতা অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। 

ভারত কি গুরুত্ব দেবে?

দিল্লিতে জওহারলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির বিশ্লেষক ড. সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলেন, ভারতের ঘটনাপ্রবাহ তার দেশে প্রভাব ফেলে বলে যে কথা শেখ হাসিনা বলেছেন তার সাথে তিনি একমত। কিন্তু একইসাথে তিনি মনে করেন, ভারতীয় গণতন্ত্র দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করবে। তিনি বলেন, ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক জাত-পাত, জাতি-গোষ্ঠী কেন্দ্রিক“ রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কিছু নয়। কিন্তু, তার মতে, এমন রাজনীতিতেও সংখ্যালঘু নাগরিকদের অধিকার, নিরাপত্তা বিধান সম্ভব। বাংলাদেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠকে তুষ্ট করতে সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে, কিন্তু শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে সচেষ্ট বলে আমি বিশ্বাস করি, বলেন ড. ভরদোয়াজ।

তিনি বলেন, ভারতে সমস্যা রয়েছে। অনেক সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কিন্তু, তার দাবী, ভারতীয় গণতন্ত্র এখনও শক্ত, এখনও ভারত হিন্দু রাষ্ট্র নয়। এবং নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর গত সাত বছরে মুসলিমদের সামগ্রিকভাবে খুব বড় কোনো বিপদ হয়েছে বলে আমি মনে করিনা। বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার সাথে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে যোগসূত্র শেখ হাসিনা টেনেছেন, তা নিয়ে বিজেপি বা ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

ড. ভরদোয়াজ বলেন, বিজেপি সরকারের উচিৎ শেখ হাসিনার এই বার্তাকে ইতিবাচক হিসাবে গ্রহণ করা। তিনি তার দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গিকার করেছেন এবং তিনি একই ধরণের সাড়া দেখতে চাইছেন ভারতে। কেন তিনি তা চাইছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তা বুঝবেন বলে আমি মনে করি। কারণ, তারা রাজনীতি বোঝেন।


শেখ হাসিনা যা বলেছেন বা যা চেয়েছেন তাকে কতটা গুরুত্ব দেবে বিজেপি?

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন না বিজেপি আদৌ কোনো গুরুত্ব দেবে। বিজেপির এজেন্ডা খুব স্পষ্ট। তারা জানে ক্ষমতায় থাকতে, ভোটে জিততে সাম্প্রদায়িক কার্ড তাদের খেলতেই হবে। ক্ষমতার আসার আগে এবং আসার পরপরই গুজরাট অর্থনৈতিক মডেল দিয়ে ভারতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনার কথা বিজেপি বলতো তা এখন অসার। কিছুই হয়নি। আমি মনে করি সে যোগ্যতাও বিজেপির নেই। ফলে ধর্মই এখন তাদের রাজনীতির একমাত্র পথ।

তবে ভারত নিয়ে তার বক্তব্যে দেশের ভেতর শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে কিছুটা লাভবান হবেন বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন। একটা অভিযোগ অনুযোগ জনমনে বেশ কিছুদিন ধরে দানা বাঁধছিল যে, ভারত যা কিছুই করুক, বাংলাদেশ কিছু বলেনা। ভারত যা চায় তা পেলেও তারা বাংলাদেশেকে কিছু দিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সেই চাপা ক্ষোভ কিছুটা হলেও শান্ত হবে।



 

Show all comments
  • আরিফ ১৭ অক্টোবর, ২০২১, ১:০৫ এএম says : 0
    ভারতের সাথে সম্পর্ক বিচিন্ন হোক????️????এতেই বাংলাতে শান্তি আসবে
    Total Reply(0) Reply
  • a ama n ১৭ অক্টোবর, ২০২১, ৪:১৯ এএম says : 0
    well said prime minister of bangladesh . India is run by some hindoo .......... . they should stop prechecing hate against others
    Total Reply(0) Reply
  • গাজী হোসাইন ১৭ অক্টোবর, ২০২১, ৫:৪৯ এএম says : 0
    ঘুরিয়ে ফিরিয়ে না বলে স্পষ্ট একটা বার্তা দেওয়া উচিত ভরতকে
    Total Reply(0) Reply
  • M a Hamid munna ১৭ অক্টোবর, ২০২১, ৮:৫৭ এএম says : 0
    ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা l আপনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে বাংলাদেশের মানুষের মনের কথাটি বলেছেন l আমরা আশা করব প্রতিবেশী দেশ আপনার কথার তাৎপর্য অনুধাবনে সক্ষম হবে l জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু l
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ