Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়

প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আসছেন আজ

প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৪ পিএম, ১৩ অক্টোবর, ২০১৬

আহমদ আতিক : ঢাকা-বেইজিংয়ের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উঠছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যতম সহযোগী চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে আসছেন আজ। ৩০ বছরের মধ্যে এটাই চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও শিল্প-বাণিজ্যে মহাচীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিস্তার চায় সরকার। সত্তুর দশকের প্রথমার্ধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের সঙ্গে যে সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন; সেটা আরো বিকশিত করতে চান তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফর নিয়ে তাই শুরু হয়েছে উৎসাহ উদ্দীপনার। দেশের কূটনীতিক, দক্ষিণ এশিয়ার ঝানু কূটনীতিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর নিয়ে হিসেবে নিকেষ শুরু হয়ে গেছে। দু’দেশের মধ্যেকার এই সম্পর্ক বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো বাড়াবে। কূটনীতিকদের ভাষায় দুই দেশের উন্নয়ন ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক পাল্টে দেবে অনেককিছু। তাই বিদেশী মেহমানকে স্বাগত জানাতে মহাপ্রস্তুতি নিয়েছে ঢাকা।
চীনের প্রেসিডেন্টর ঢাকা সফর উপলক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির সাথে সড়ক, রেল এবং  নৌ-পথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা চলছে। এ সফরে আধুনিক সিল্ক্ রুট খ্যাত চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ হবে দু’দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেকার আলোচনার অন্যতম বিষয়। এই বৃহত্তম কানেকটিভিটির উদ্যোগে চীন ও বাংলাদেশসহ ৩০টির বেশি দেশ যোগ দিয়েছে। এর ফলে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠছে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান। ৩০ বছর পর চীনা কোন প্রেসিডেন্টের সফরকালে বাংলাদেশ পাবে বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগের আশ্বাস। আর এ কারণেই চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর পর্যবেক্ষণ করছে বৃহৎ শক্তিগুলো। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত। এ দিকে লক্ষ্য রেখেই তাই চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বে ভারতের ঈর্ষা করার কিছু নেই। চীনা প্রেসিডেন্টের এই আগমনকে তাই সবভাবেই স্মরণীয় করে রাখতে চায় বাংলাদেশ। তাকে স্বাগত জানাতে এরই মধ্যে ঢাকা সেজেছে অপরূপ সাজে। প্রধান সড়কগুলোতে চীনা প্রেসিডেন্টের ছবি টাঙানো হয়েছে। পাশে রয়েছে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। নিরাপত্তা চাদরে ডেকে দেয়া হবে রাজধানী।
গত মঙ্গলবার চীনা বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য-বিনিয়োগসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা ঘটবে। বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে বিশ্বাসী জানিয়ে তাদের মৌলিক জাতীয় স্বার্থ এবং এর সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত সুরক্ষায় বেইজিংকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
আর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর বাংলাদেশ সফরে আলোচনার অন্যতম বিষয় হবে প্রাচীন সিল্ক রুট খ্যাত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’। এই বৃহত্তম কানেকটিভিটির উদ্যোগে চীন ও বাংলাদেশসহ ৩০টির বেশি দেশ যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ হবে এই সিল্ক রুটের কেন্দ্র। প্রস্তাবিত এ রুটের মাধ্যমে স্থলপথে এশিয়ার মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। আবার সমুদ্রপথে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাজাখস্থানে এক ভাষণে তার ভিশনারি ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের বিষয় প্রথম জানান। পরবর্তী তিন বছরে বাংলাদেশসহ ৩০টির বেশি রাষ্ট্র এ উদ্যোগে যোগ দিয়েছে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এর মাধ্যমে চীন অনেকগুলো রাস্তা করতে চায়, যার মাধ্যমে পরিবর্তিত যেকোনও পরিস্থিতি, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ বা অবরোধের মধ্যেও যেন সুযোগ থাকে ভিন্ন পথে বাণিজ্য যোগাযোগ অব্যাহত রাখা।
চীনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বেইজিংয়ে গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময়ে চীনের প্রস্তাবিত রোড ও বেল্ট উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু  চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। এ চুক্তিগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
চীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কং জুয়ানইউ বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এ সফর বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্কের মাইলফলক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, রোড ও বেল্ট উদ্যোগ একটি ধারণা। যেকোনও দেশ এখানে যোগ দিতে পারে। রোড ও বেল্ট উদ্যোগের  উদ্দেশ্য হচ্ছে বাণিজ্য করার পথ বা রুট নিরবচ্ছিন্ন রাখা।
আর তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বলেন, পঞ্চাশের দশকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চীনের সঙ্গে যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল তা আরো বিকশতি করতে চায় বাংলাদেশ। যার মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক নবযাত্রার সূচনা হবে। এছাড়া সফরের সময়ে প্রায় ২৫টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক সই করা হবে।
চীনের প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য ওয়াং হানিং, লি ঝাংশু, স্টেট কাউন্সিলর ইয়াং জিচি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনমন্ত্রী জু শাওশি, অর্থমন্ত্রী লু জিইয়েই, বাণিজ্যমন্ত্রী গাও হুচেং, পিপলস ব্যাংক অব চায়নার গর্ভনর ঝু জিয়াওচুয়ান প্রমুখ। সফরসঙ্গী হিসেবে প্রতিনিধি দলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, মন্ত্রী, সহকারী মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতসহ ১৩ নেতা ছাড়াও ৩৩ জন ওয়ার্কিং স্টাফ, ৩৪ জন নিরাপত্তা বিষয়ক ও মিডিয়া স্টাফ রয়েছেন।
চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকে অর্থনৈতিক মাইলফলক হিসেবে দেখছেন সরকারের মন্ত্রী এবং ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছেন, এ সফরে হতে যাওয়া চুক্তি ও দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হবে। দেশের বিদ্যুৎখাত, সেতু ও অবকাঠামোর বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা সহায়তা বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরালো করেছে। বাণিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি থাকলেও ৫৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ফলে চীনে রপ্তানির হারও বাড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকে খুবই ইতিবাচক মনে করছে চীন-বাংলাদেশ চেম্বার।
যেসব প্রকল্পে চুক্তি সই হতে যাচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতের প্রকল্প। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতের বেশ কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট, ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে আমরা চীনের সহযোগিতা চেয়েছি। সেই বিষয়গুলি হয়তো এবার নিশ্চিত হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, চীনা প্রেসিডেন্টের এ সফরে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। চীনে তৈরি পোশাক খাতে যারা বিনিয়োগ করে এদের অনেকেই বাংলাদেশে এসে তাদের শিল্প পুনঃস্থাপন করবে। আমরা চীনকে একটা স্পেশাল ইকোনোমিক জোন বরাদ্দ দিচ্ছি। তাই আমাদের আশা চীনের ব্যবসায়ীরা এখানে বিনিয়োগ করবে।
এদিকে চীনের রাষ্ট্র পরিচালিত গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস এ গত বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেইজিং-ঢাকার ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বে নয়াদিল্লীর ‘ঈর্ষান্বিত’ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে ভারত এর সুযোগ নিয়ে ব্রিকস সম্মেলনে চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করতে পারে।
অবশ্য চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হওয়া যদি ভারতের ওপর একটু চাপ সৃষ্টি করে, তা খুব একটা খারাপ ব্যাপার নয় বলেও উল্লেখ করেছে পত্রিকাটি। তাদের যুক্তি হলো, এতে দিল্লী এই অঞ্চলে কাজ করার ক্ষেত্রে নিজের কৌশলগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান ঋণচুক্তির অঙ্কের বিষয়টি না বললেও ‘রেকর্ড পরিমাণ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে’ বলে জানিয়েছিলেন। সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, চীন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও উন্নয়নের অংশীদার। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র চীন সফর দু’দেশের সম্পর্ককে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যায়। যোগাযোগ, জল-স্থল এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। চীনের সহায়তায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। চীন বাংলাদেশের স্বপ্নের অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। তাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশে এই সফর অত্যন্ত অর্থবহ।
আবুল হোসেন বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও চীন সহযোগিতা করে আসছে। প্রতিরক্ষা খাতকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাথে সংযোগ করতে চীনের সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যা”েছ বাংলাদেশ। নৌবাহিনীকে সমুদ্রপৃষ্ঠে যুদ্ধ করার উপযোগী নৌবহর, সমুদ্রতলে সাবমেরিন এবং আকাশে নৌবাহিনীর নিজস্ব জঙ্গি বিমান, সেনাবাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, বিমান বাহিনীর জন্য বোমারু বিমান সুসজ্জিত করে তোলার ক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। সশস্ত্রবাহিনী ও নৌবাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতেও চীন এগিয়ে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের নিরিখে এ দু’দেশের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। দু’টি দেশের মধ্যকার এই সুসম্পর্ক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড: মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীনে এখন শ্রমের মূল্য বাড়ছে। ফলে তারা বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে। বাংলাদেশের এই সুযোগটি কাজে লাগানো দরকার। নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি পোশাক পণ্য উৎপাদন থেকে সরে আসছে আসছে চীন। সেখানেও বাংলাদেশের সামনে সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আর যেহেতু বাংলাদেশের মোটামুটি সব পণ্যেই চীন শুন্য শুল্ক সুবিধা দিয়ে আসছে, তাই চামড়াজাত শিল্প এবং জুতার বাজার হতে পারে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য চীনে একটি লাভজনক ক্ষেত্র।
চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা এখন বাংলাদেশ। এরইমধ্যে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় শুরু হয়েছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট চেন ফেনজিন বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তারা দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহী। যা আগামী দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়তো চমকে দেবে বিশ্ববাসীকে। বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হওয়ার কারন হিসেবে বলছেন, এদেশের ভৌগলিক অবস্থান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর্মঠ ও বন্ধুসুলভ মানুষ। চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।
বিশাল এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম সহযোগি চায়না হারবার ইনিঞ্জিয়ারিং কোম্পানি। চট্রগ্রামের আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আগ্রহী। চায়না হারবারের প্রেসিডেন্ট জানান, বাংলাদেশ হতে চলেছে এ অঞ্চলের পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রাণ কেন্দ্র।
বাংলাদেশ এবং চীন সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় বাস্তব রুপ পাচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ও  বৈরাগ ইউনিয়নের চারটি মৌজার ৭৭৪ একর জায়গায় গড়ে উঠা অর্থনৈতিক অঞ্চল। তাতে, পরিকল্পনা আছে; টেক্সটাইল, কেমিক্যাল, তথ্যপ্রযুক্তিসহ শ্রমিকগণ প্রায় ৩৭১টি শিল্প কারখানা গড়ার। অর্ধেক পাহাড়ি আর অর্ধেক সমতল ভূমির এই অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের মন্দা কাটিয়ে চট্টগ্রামকে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটেলে পরিণত করবে-এমন আশা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের। এই শিল্প এলাকাকে ঘিরে কমপক্ষে ১৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের কথা রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর নিয়ে ঢাকার যেমন উচ্ছ্বাস আছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রতিবেশি দেশগুলোও এ সফরকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে। গত রোববার পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে এক  বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিক্যাট বলেন, এটি একটি বড় ঘটনা। এ সফরে কী ঘটে সেটি আমরা কৌতুহল নিয়ে দেখছি। আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনা প্রেসিডেন্টের এই সফর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানেরও কৌতুহল আছে।
সাবেক কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রদূত লিয়াকত আলী চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন এবং ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়বে। চীন ট্রেড, ইনভেস্টমেন্ট এবং কানেকটিভিটিকে গুরুত্ব দেয়। আর বাংলাদেশের সঙ্গে একটি কমপ্যাক্ট সহযোগিতার চুক্তি আগে থেকেই আছে। বাংলাদেশে বড় আকারে বিনিয়োগ করতে চায় চীন। তাই এই সফর বাংলাদেশ এবং চীন উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখন ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর এখন চীনের মতো বড় শক্তিও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই অনেকেরই দৃষ্টি এই সফরের দিকে। বাংলাদেশ এসব বিষয় নিয়ে এখন একটি ইউনিক অবস্থানে আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে কম্বোডিয়া থেকে আজ শুক্রবার ঢাকা আসছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীনের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি বাংলাদেশের আকাশ সীমায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশেষ ২টি জেট বিমান তাকে প্রহরা দিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসবে। সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ২১ বার তোপধ্বনি, গার্ড অব অনার, লাল গালিচা সংবর্ধনা ও পুষ্পার্ঘ্য প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে নেয়া হবে শি জিনপিংকে। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে মোটর শোভাযাত্রা সহকারে তাকে তার সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল লা মেরিডিয়ানে নেয়া হবে। বেলা পৌনে তিনটায় হোটেল থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। বেলা তিনটায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের শিমুল হলে চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের চ্যামেলি হলে শি জিনপিং এবং শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসবেন।
বেলা ৪টায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক বেশ কয়েকটি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক সই এবং কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতি দেবেন। পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে ভিজিটর বইয়ে স্বাক্ষর শেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি তার সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল লা মেরিডিয়ানে যাবেন। বিকেল সাড়ে ৪টার পর হোটেলে চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে হোটেল থেকে বঙ্গভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। সাড়ে ৬টার দিকে বঙ্গভবনের কেবিনেট হলে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হবেন তিনি। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বঙ্গভবন দরবার হলে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশ ভোজে যোগ দিবেন শি জিনপিং। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বঙ্গভবন থেকে হোটেলে ফিরে যাবেন চীনের প্রেসিডেন্ট।
শনিবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৮টা ২০ মিনিটে চীনের প্রেসিডেন্ট সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে রওনা হবেন। স্মৃতিসৌধে পৌঁছালে সেখানে তাকে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, নবম ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের জেনারেল কমান্ডিং অফিসার স্বাগত জানাবেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি গাছের চারা রোপন ও পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। স্মৃতিসৌধ থেকে তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাবেন। এরপর সকাল ১০টায় বিশেষ ভিভিআইপি ফ্লাইটে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্টের। বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে তাকে বিদায় জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদায়কালে বিমানবন্দরে চীনের প্রেসিডেন্টের সম্মানে বিশেষ স্ট্যাটিক গার্ড প্রদান করা হবে। ঢাকা থেকে তিনি যাবেন ভারতের গোয়ায়। তবে একটি সূত্র জানায়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথেও সাক্ষাতের কথা রয়েছে শি জিনপিং এর।
চীনের প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষ্যে রাজধানীসহ তার আবাসস্থল ও তার কর্মসূচির স্থলকে ঘিরে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল সীমিত করা হবে। এ উপলক্ষে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থানগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রাস্তার স্পিড ব্রেকার তুলে ফেলা হয়েছে। গাবতলী থেকে নবীনগর পর্যন্ত মোট ২২টি স্পিড ব্রেকার ভেঙে ফেলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের আমন্ত্রণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কম্বোডিয়া থেকে আজ দু’দিনের মাইলফলক সফরে ঢাকা আসছেন। এখান থেকে তিনি ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ভারত যাবেন। গত ৩০ বছরে এটি প্রথম চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর। এর আগে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট লি শিয়াননিয়ান ঢাকা সফর করেন।



 

Show all comments
  • সোহেল ১৪ অক্টোবর, ২০১৬, ২:২৫ পিএম says : 0
    চীন হতে পারে আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ