Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রতারকদের নতুন ফাঁদ

কলুষিত সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাত

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

৯০’র দশকের মাঝামাঝিতে অ্যামাজন, এল ইবে, রাকুতেন এবং পরবর্তীতে আলিবাবার হাত ধরে ই-বাণিজ্যের যাত্রা শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে এসব প্রতিষ্ঠান এখন এই খাতের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সবক’টি দেশে। একইসাথে ধরে রেখেছে সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষের আস্থা। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর ঘরে বসে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা বা ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনাকালে এটির বিস্তৃতি হয়েছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু কোন ধরণের লাইসেন্সিং, নীতিমালা, বাধ্যবাধকতা, জবাবদিহিতা না থাকায় প্রতারকদের হাতে চলে গেছে দেশের সম্ভাবনাময় এই খাতটি। সারাবিশ্বে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন ই-কমার্স বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই সময় বাংলাদেশে একের পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। গ্রাহকরা টাকা তো ফেরত পাচ্ছেনই না, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের কোনো বিচারও হচ্ছে না। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসম্ভব অফার ঘোষণা, ক্রেতাদের লোভকে পুঁজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হলেও গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আবার এখনো ধরাছোয়ার বাইরে আছে এমন শত শত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর গোটা খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সংকটে।

জানা যায়, দেশে বর্তমানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। আর এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) আছে আরও ৫০ হাজারের বেশি। কোটি কোটি মানুষের হাতে হাতে থাকা ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সহজেই পণ্য সামগ্রী ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দেয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতারকচক্র রাতারাতি অনলাইনে পণ্য সরবরাহ ও পরিষেবার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত, প্রতারণার উদ্দেশ্যে যে যেভাবে পেরেছে ইচ্ছেমত একটি ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুকে পেজ খুলে শুরু করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। যার জন্য প্রয়োজন হয়নি কোন লাইসেন্স, নেই কোন নীতিমালা, জবাবদিহিতাও নেই কারো কাছে। ফলে পণ্যের নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক দামে, কখনো পণ্যের সমপরিমাণ ক্যাশব্যাকসহ অসম্ভব ও লোভনীয় অফার ঘোষণা করে ক্রেতাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। গ্রাহকরাও লোভনীয় এসব অফার পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। এ যেন অনলাইন মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতারণার নতুন ফাঁদ। যার প্রথমটি ধরা পড়ে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকের কাছে হাজার কোটি টাকা দেনার বিপরীতে মূলধন মাত্র ৬১ কোটি টাকা। বাকী টাকা কোথায় তার কোন সদুত্তর নেই। এরপর একে একে বের হতে থাকে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জ শপ, রিং আইডি, কিউকম, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল প্লাস, বাজাজ কালেকশন, টুয়েন্টিফোর টিকেট ডট কম, গ্রিন বাংলা, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এ্যাগ্রো ফুড এন্ড কনজ্যুমারস, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ডসহ অন্তত: ১৯টি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার তথ্য। এর মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। তবে প্রতারণার মাধ্যমে যাদের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে সেই গ্রাহকরা আদৌও তাদের টাকা ফেরত পাবে কিনা সে বিষয়ে নেই কোন নিশ্চয়তা।

প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা বলছেন, শেয়ারবাজার লুণ্ঠন থেকে শুরু করে এমএলএম মার্কেটিং, যুবক-বিসমিল্লাহ গ্রুপ থেকে এখন ইভ্যালি, ধামাকা, ই-অরেঞ্জ, রিংআইডি পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ ভোক্তা ও এজেন্টরা। মানুষ নিঃস্ব ও প্রতারিত হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে যে সব আইনগত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেয়া হয় তাতে বেহাত হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার বা প্রতারিত ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সাফল্য দেখা যায়নি।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, যারা প্রতারণা করেছে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই ধরনের প্রতারণা সামনের দিনে ঘটতেই থাকবে। এর ফলে ই-কমার্স খাত মানুষের মানুষের আস্থা হারাবে।

এদিকে ই-কমার্স খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণা ঠেকাতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশের ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা আনতে একটি রেগুলেটরি কমিশন গঠন করা হবে। ডিজিটাল প্রতারণা হলে যেন বিচার করা যায়, সেজন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এবং মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে কিছু সংশোধন আনতে হবে। সেই ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধন ছাড়া ই-কমার্স ব্যবসা করা যাবে না।

ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাণিজ্যমন্ত্রী ধারণা করছেন, এই প্রতিষ্ঠানটির আর গ্রাহকদের টাকা ফেরৎ দেয়ার সক্ষমতা নেই। সেক্ষেত্রে সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার তো টাকা নেয়নি। সরকার তো সেই লাভের অংশ নেয়নি। তবে দায় এড়াতে চাচ্ছি না। দায় নিয়েই আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে কী করা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন কেনাকাটাই ভবিষ্যত। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর দিকে তাকালেই সেটি বোঝা যায়। ২০১৯ সালে আমেরিকায় অনলাইন কেনাকাটা যেখানে ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, ২০২০ সাল শেষে সেটি দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। ২০১০ সালে আমেরিকায় অনলাইনে অ্যামাজনের খুচরা ব্যবসা ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। গত বছর মে মাসে সেটি দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। ব্রিটেনেও ৩৫ শতাংশ। চীনে খুচরা ব্যবসার পাঁচভাগের একভাগই হয় অনলাইনে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব দেশে অনলাইনে কেনাকাটার চল বেশি, সেসব দেশে ইন্টারনেটে খুচরা ব্যবসার মোট পরিমাণ ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশী ই-কমার্স জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি অশুভ লক্ষণ। দ্রুত গ্রাহকদের আস্থা অর্জন এবং সঙ্কটের সমাধান না করলে অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান ফিরে যাবে।

ইভ্যালি: দ্রুততম সময়ে জনপ্রিয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ইভ্যালি। চোখধাঁধাঁনো অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা। ইভ্যালির এক হাজার কোটি টাকার দেনার বিপরীতে মূলধন আছে মাত্র ৬১ কোটি টাকা। বার বার সময় দেয়ার পরও গ্রাহকদের টাকা কিভাবে ফেরত দেবে সে বিষয়ে জানাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান মোহাম্মদ রাসেল। পরবর্তীতে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মামলায় এখন কারাগারে আছেন ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও রাসেলের স্ত্রী শামীমা নাসরিন। তবে গ্রাহকরা কবে টাকা ফেরত পাবেন কিংবা আদৌ পাবেন কিনা সে বিষয়ে কোন সুষ্পষ্ট আশ্বাস দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ই-অরেঞ্জ: ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করা অনলাইন শপ ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে সম্প্রতি গ্রাহকরা টাকা নিয়ে সময়মত পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ করেছেন। পণ্য ডেলিভারি না দেয়া এবং অগ্রিম অর্থ ফেরত না দেয়ায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান এখন কারাগারে। এরই মধ্যে গত রোববার প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোনিয়া মেহজাবিনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়েছে। মামলার অপর আসামিরা হলেন- সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই বনানী থানার পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা, খালু জায়েদুল ফিরোজ, প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্যাহ চৌধুরী, নাজনীন নাহার বিথী ওরফে বিথী আক্তার ও নাজমুল হাসান রাসেল।

ধামাকা: গ্রাহকদের কয়েক শ’কোটি টাকা নিয়ে ‘লাপাত্তা’ হয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও আকর্ষণীয় ছাড়ে পণ্য বিক্রির ফাঁদ তৈরি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৫৮৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) জসিমউদ্দিন চিশতি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদের বেশির ভাগ সদস্য পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন বলে জানিয়েছে অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির অফিস বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের ফোন নম্বরও। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ধামাকায় অর্ডার পেমেন্ট করা হাজারো গ্রাহক।

এর মধ্যে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের দায়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ধামাকা শপিংয়ের চিফ অপারেশন অফিসার (সিওও) সিরাজুল ইসলাম রানাসহ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

সিরাজগঞ্জ শপ: ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মত চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের ফাঁদে ফেলে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে সিরাজগঞ্জভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জশপ ডটকম ও আলাদিনের প্রদীপের বিরুদ্ধে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে পণ্য অর্ডার দিয়ে আগাম টাকা পরিশোধ করে বিপাকে অনেক গ্রাহক। সিরাজগঞ্জ শপের প্রতিষ্ঠাতা জুয়েল রানা জেলা প্রশাসনের লার্নিং এন্ড আর্নিং প্রজেক্টে প্রশিক্ষণ নিয়ে গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি।

একইভাবে তাড়াশ উপজেলার নিভৃতপল্লির তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুন এবং মাহমুদ হাসান গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলাদিনের প্রদীপ। সিরাজগঞ্জশপ ডটকম ও আলাদিনের প্রদীপ প্রায় সোয়া চার লাখ অর্ডারের বিপরীতে আগাম নেয় ২০৫ কোটি টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকাভুক্ত ১৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এই দুটি। প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, মার্চেন্ট এবং গ্রাহকদের কাছে সিরাজগঞ্জশপ ডটকমের প্রায় ১৭ কোটি আর আলাদিনের প্রদীপের প্রায় ৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে।

রিং আইডি: মাত্র তিন মাসে শুধু কমিউনিটি জবসের নামেই গ্রাহকের ২১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিং আইডি। প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাইফুল ইসলাম এখন কারাগারে। সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে রিং আইডির আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০১৫ সালে। এক অ্যাপ এক দেশ এই স্লোগান ধারণ করা প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই গ্রাহকদের। প্রতারণার মামলাও হয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রতিদিন ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে সবোর্চ্চ ৫০০ টাকা আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয় কমিউনিটি জবস অফার। সিলভার এবং গোল্ড দুই ধরণের সদস্যপদের ফাঁদে পা দেন অনেকেই। রাজধানীর ভাটারা থানায় হওয়া এক ভুক্তভোগীর মামলায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গত ১ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

কিউকম: ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের ডিসকাউন্টের ফাঁদে পড়ে আড়াইশ’ কোটি টাকা হারিয়েছেন শত শত গ্রাহক। বিজয় আওয়ার, স্বাধীনতা আওয়ার এবং বিগ বিলিয়ন- এ তিন ক্যাটাগরিতে গ্রাহকদের মোটরসাইকেল কেনার অফার দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থীর করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন মিয়াকে গত রোববার রাতে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। শুধু মোটরসাইকেলের অর্ডার বাবদ গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ২৫০ কোটি টাকা। জানা যায়, মালয়েশিয়ার পুত্রা ইউনিভার্সিটিতে মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন রিপন মিয়া। ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে দেশে ফিরেই ইভ্যালির সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর নিজেই নেমে পড়েন ব্যবসায়। প্রতিষ্ঠা করেন কিউকম। ধামাকা অফার দিয়ে তিনি শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা। তার কোম্পানিতে টেলিভিশন, ফ্রিজ ও মোটরসাইকেলের অফার দিত। কম মূল্যের কারণে তার প্রতিষ্ঠানে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। পণ্যের মূল দামের সঙ্গে প্রায় ৭৫ ভাগ ছাড়ের ঘোষণা থাকত।

বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ-প্রতারণার পেছনে শুধু প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরাই নয়, সরকার দলীয় ও ঘনিষ্টজনরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে মাত্র ২ কোটি টাকা অনিয়মের মিথ্যা অভিযোগে আড়াই বছরের বেশি সময় বন্দী করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, কানাডা-মালয়েশিয়াতে বেগম পাড়া হচ্ছে তাদের ধরার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেই। মেগাপ্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলোতেও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ এর সবগুলোর সাথে সরকার ও সরকার দলীয়রা জড়িত।

রিজভী বলেন, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, যুবকের প্রতারণার সাথে জড়িতদের যখন বিচার হয়নি তখন ই-প্রতারকদের আবির্ভাব হয়েছে।

ই-কমার্সের বর্তমান দুরবস্থা প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি) এবং ডিজিটাল কমার্স আইন প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, যে ক্ষতি হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এটা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না।

তবে তিনি বলেন, ই-কমার্সের জন্য নতুন আইন হবে কিনা বা ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে কিনা, সেটা জানা যাবে আরও এক মাস পর। আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে একটি সাব-কমিটি হয়েছে। সে সাব-কমিটির রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে নতুন আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে কিনা। কমিটি পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।

ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সভাপতি শমী কায়সার ও সেক্রেটারি আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ভোক্তা ও বিক্রেতাদের অভিযোগের পেক্ষিতে ই-ক্যাব ১৬ টি প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেছে। এরমধ্যে অভিযোগের বিষয়ে জবাব না দেয়া অথবা সন্তোষজনক জবাব না দেয়ার কারণে ৮টি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। বেশকয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণে রেখে অধিকতর তদন্ত চলছে।

এদিকে প্রতারণার মামলায় ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিরাপদ ডটকমের পরিচালক ফারহানা আফরোজ এ্যানিকে (২৯) গ্রেফতার করেছে সিআইডি। মঙ্গলবার রাতে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, রাজধানী দক্ষিণখান থানাধীন কাওলা এলাকা থেকে সোমবার নিরাপদ ডটকমের পরিচালক ফারহানা আফরোজ এ্যানিকে গ্রেফতার করে সিআইডির একটি টিম। ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিরাপদ ডটকমের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একজন ভুক্তভোগী ফতুল্লা থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিদের সিআইডি কর্তৃক গ্রেফতারের অভিযান অব্যহত রয়েছে।

গত শুক্রবার রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে সিআইডি। রিং আইডিতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন- এমন অভিযোগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একজনের করা মামলায় সাইফুলকে গ্রেফতার করা হয়।

টুয়েন্টিফোর টিকেটি ডটকমে’র পরিচালক গ্রেফতার: প্রতারণার মধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অনলাইন টিকিটিং এজেন্সি ‘টুয়েন্টিফোর টিকেটি ডটকমে’র পরিচালক রফিবুল হাসানকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। মঙ্গলবার তাকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান।

তিনি বলেন, রফিবুল হাসানের বিরুদ্ধে ৩ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। মামলাটিতে ২২ (২), ২৩ (২), ২৫ (২), ৩০ (২), ৩৫ (২) ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলাটি করেন মুসা মিয়া সাগর নামে এক ব্যক্তি। মামলায় আসামি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সিইও প্রদ্যোত বরণ চৌধুরী ও মো. রাকিবুল হাসান, পরিচালক (ফাইন্যান্স) মো. আসাদুল ইসলাম, এম. মিজানুর রহমান সোহেল, রাজ্জাকের বোন মোসা. নাসরিন সুলতানার নাম উল্লেখ ও ১০-১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে আসামিরা ফেসবুক ও ওয়েবসাইটে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে অর্থ আত্মসাৎ ও ডিজিটাল প্রতারণা করেন বলে অভিযোগ আনা হয়। এর আগে গত মে মাসে লাপাত্তা হয়ে যায় অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিটি। প্রাথমিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। মে মাসেই তাদের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় একটি জিডি করেন ২০ ভুক্তভোগী প্রবাসী। এছাড়াও আইকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী ইব্রাহিম নামে এক ব্যক্তিও প্রতারণার অভিযোগে জিডি করেন।



 

Show all comments
  • গিয়াস উদ্দীন ফোরকান ৬ অক্টোবর, ২০২১, ২:৩৪ এএম says : 0
    এভাবেই দেশের প্রত্যেকটি সম্ভবনাময় খাতকে ধ্বংস করা হচ্ছে
    Total Reply(0) Reply
  • Helal Ahmed ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৩৮ এএম says : 0
    ই-কমার্স নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শুরু থেকে কেন নড়েচড়ে বসেনি? শুরু থেকে নিয়ম বেধে দিলেতো মার্চেন্ট এবং গ্রাহকদের ক্ষয়ক্ষতি হতো না। ই-কমার্সের পজিটিভ /নেগেটিভ ২ দিকই আছে। ই-কমার্স থেকে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবার অনেক উদ্যোক্তা তৈরী হয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Shahjahan Bikram ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৩৯ এএম says : 0
    ই-কমার্স ব্যবসায় একটা পজিশনে যাওয়ার পর এত দুর্নীতি ও অভিযোগ উঠার কারন কি??? আগে থেকেই এই ব্যবসায়ের খোঁজ খবর রেখে একটা নিতীমালা দিলে আজ এই ব্যবসায়গুলো জুকির মুখে পরতো না কোন ক্রেতার ও ভুগানতি হতো না। এই দায় কি ব্যবসায়িদের?
    Total Reply(0) Reply
  • আরিফুল ইসলাম রনি ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৩৯ এএম says : 0
    ই-কমার্সের নামে যে সব কোম্পানি ইনভেস্ট ইনভেস্ট খেলা করছে,তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।যেমন- রিং আইডি, এসপিসি আরও নাম না যানা অনেক....
    Total Reply(0) Reply
  • Md Sohrab Hossain Jewel ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৪৪ এএম says : 0
    আরো আগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো দরকার ছিল।
    Total Reply(0) Reply
  • Al Amin ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৪৬ এএম says : 0
    এ দেশে ইভালির মত এমন প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করা খুব সহজ! কারন আমাদের চেয়ে লোভী বোধহয় পৃথিবীতে আর কোনো জাতি নাই !
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Aman Ullah Talukder ৬ অক্টোবর, ২০২১, ৮:১৫ এএম says : 0
    এরা চিহ্নিত বাটপার। এদেরকে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার এবং পাশাপাশি জনসাধারনের টাকা সত্বর ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরী।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রতারকদের নতুন ফাঁদ

৭ অক্টোবর, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ