পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হোটেল-মোটেল রিসোর্ট অবকাঠামো নিরাপত্তার অভাব : সূর্যাস্তে জাহাজ বহর দেখার অপূর্ব সুযোগ
শফিউল আলম : সাগরের সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ খুঁজে পাওয়ার কথাটা ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রঘেঁষা বেলাভূমি কক্সবাজারের ছবি। তবে কক্সবাজারে বেড়াতে যেতে হলে একাধিক দিন সময় এবং বেশ ভালো অংকের টাকা হাতে থাকা চাইই চাই। আর তাহলে কক্সবাজারের বিকল্প? খুব কম খরচে ও দিনে দিনে সমুদ্র সৈকতে ঘুরে আসতে হলে ‘মিনি কক্সবাজার’ খ্যাত আনোয়ারার পারকী সৈকতের আর কোনো জুড়ি নেই। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে অবস্থিত চোখ জুড়ানো আনোয়ারার পারকী সৈকতটি। আর পতেঙ্গার যে কোনো জেটি-ঘাট দিয়ে নৌকাযোগে গেলে পারকীতে মাত্র আধা ঘণ্টায় পৌঁছা যাবে। সেই সাথে হয়ে যাবে সাগর উপকূলে নৌ-ভ্রমণের বিরল অভিজ্ঞতাও। পারকী থেকে সোজাসুজি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাওয়াটা আরও রোমাঞ্চকর। তবে নৌকায় যেতে হলে সাগর শান্ত থাকা এবং বড় জাহাজের অকস্মাৎ ধাক্কা থেকে সতর্ক থাকা চাই।
সেখানে বঙ্গোপসাগরের ফেনীল ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য দেখার পাশাপাশি আছে দুটি বাড়তি ‘বোনাস’ সুযোগের প্রাপ্তি। এক. চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে সাগরের বুকের উপর সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজবহরের আলো ঝলমলে মেলার মতো এক অপরূপ দৃশ্যপট। দুই. দেশের প্রধান খর¯্রােতা নদী কর্ণফুলী এবং বঙ্গোপসাগরের মিলিত মোহনায় ছোট-বড়-মাঝারি দেশি-বিদেশি জাহাজ, নৌযান, সাম্পান ও ট্রলারের অবিরাম ছোটাছুটি, জেলে মাঝি-মাল্লাদের ‘বদর বদর হেঁইও’ কলেরবে মাছ শিকারের দৃশ্যগুলো মনহরণ করবেই। উভয় প্রাপ্তি কক্সবাজার অথবা কুয়াকাটায় মিলবে না!
আনোয়ারার পারকী সমুদ্র সৈকতটি ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর এটি গড়ে ৩শ’ থেকে ৩৫০ ফুট পর্যন্ত চওড়া। পারকীর প্রাকৃতিক সুবিধাজনক দিকটি হচ্ছে, এটি একটি বালুকাবেলা অর্থৎ বালির সৈকত (স্যান্ডি বীচ)। প্রসঙ্গত, পারকীর চেয়ে অনেক ছোট আকার-আয়তনের সমুদ্র সৈকত নিয়ে ও তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে ভারত, থাইল্যান্ডের মতো অনেক দেশ প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটককে আকৃষ্ট এবং মিলিয়ন ডলার আয় করে যাচ্ছে। পারকী সৈকত ও আশপাশের ২০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বন বিভাগ সৃজন করেছে ঝাউবীথি, কেয়াবন সমেত ম্যানগ্রোভ বন বাগান। যা যে কারোর নজর কাড়বেই। সেই বনে ও সৈকতে আছে ‘সাগর কৈতর’সহ হরেক পাখ-পাখালির কুহুতান। সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আগায় ছুটতে দেখা যাবে রঙ-বেরঙের ছোট ছোট কাঁকড়া। সৈকতে তাজা ও জ্যান্ত চিংড়িসহ সামুদ্রিক মাছ জেলেদের বিকিকিনি করতেও দেখা যাবে। কয়েকটি ‘ইটালিয়ান’ গোছের রেস্তোরাঁয় খাওয়া যাবে কড়কড়ে ও গরম মাছ ভাজা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮১ সালে উপকূলীয় বন বিভাগ পারকী সৈকতে ঝাউবাগান সৃজন করে। ধীরে ধীরে ঝাউবীথি বড় হয়ে উঠলে সৈকতটি পর্যটক আকর্ষণ করতে থাকে। এভাবে পারকী সৈকত ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য দেশের অনেক পর্যটকের কাছেই পারকী এখনও অজানা-অচেনা।
কিন্তু গভীর পরিতাপের হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার গহিরায় অবস্থিত পারকী সৈকতটি সর্বক্ষেত্রেই অনাদরে অবহেলায় অনুন্নত অবস্থায় পড়ে আছে। দীর্ঘদিন পরও সৈকত ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। সবকিছুই চলছে চরম অব্যবস্থাপনায়। এ কারণেই যতটা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার কথা ছিল সেই আকর্ষণ ততটা নেই। পারকী সৈকত ও আশপাশ জুড়ে সুবিশাল এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার পথে রয়েছে হরেক বাধা-বিপত্তি, অবহেলা ও সীমাবদ্ধতা। পারকী বীচের প্রধান সমস্যারাজির মধ্যে রয়েছে হোটেল-মোটেল, রিসোর্টসহ অবকাঠামো সুবিধা ও পর্যটকদের জন্য অপরিহার্য নিরাপত্তার অভাব। সৈকতে নেই গণশৌচাগার। রোদ-বৃষ্টি কিংবা ঝড়ে সুরক্ষার জন্য নেই ছাউনি। এতে করে পর্যটকদের বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়।
চট্টগ্রাম মহানগরী ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক কিংবা পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী (পিএবি) সড়ক থেকে পারকী যেতে সিইউএফএল থেকে সৈকতে পৌঁছা পর্যন্ত ৭/৮ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা বেহাল জরাজীর্ণ। স্থানীয় জনসাধারণের বার বার দাবি এবং সরকারি মহলের ঘন ঘন ওয়াদা-আশ্বাস সত্ত্বেও এ সড়কটি সংস্কার করে প্রশস্ত ও খানাখন্দ দূর করা হয়নি।
পারকী সৈকতে ও আশপাশে আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তার অভাব অত্যন্ত প্রকট। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পর্যটকরা বিশেষ করে নারী-শিশুদের জন্য সন্ধ্যা অবধি কিংবা সন্ধ্যার পর পারকী সৈকত এলাকায় অবস্থানে নিরাপদ বোধ করা হয় না। পারকী এলাকায় প্রকাশ্যে ও আড়ালে চলে হরেক ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ। মদ-বিয়ার, ইয়াবাসহ হরেক মাদক বেচাকেনা চলে অবাধে। নারী পর্যটকদের প্রতি বখাটে-মাস্তানদের কটূক্তি চলে প্রায়ই। রাতে পারকীতে থাকার পরিবেশও নেই, আবাসন ব্যবস্থাও নেই। পুলিশের টহল পর্যটকদের চোখে পড়ে মাঝেমধ্যে। দুর্ধর্ষ বখাটে-মাস্তান ও মাদক চোরাকারবারীরা যেন সবকিছুই ‘ম্যানেজ’ করেই চালিয়ে যাচ্ছে তাবৎ অপরাধমূলক কর্মকা-। প্রসঙ্গত অতীতে পারকী চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল।
অথচ সৈকতে ও আশপাশ এলাকা জুড়ে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা নজরদারি ও টহল নিশ্চিত করা হলে আনোয়ারার পারকী হতে পারত দেশের অন্যতম জনাকীর্ণ পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র। নিরাপত্তা জোরদারের সাথে সাথে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট নির্মাণ করা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকগণ সেখানে রাত যাপন করে সৈকত ও সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতেন। বর্তমানে সৈকতে ও আশপাশে যে সব হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে তা নি¤œমানের। রুচিসম্মত খাবার সেখানে মিলে না। শুধু তাই নয় দামও আদায় করা হয় গলাকাটা হারে। পারকীর যোগাযোগ অবকাঠামো সুবিধা সৃজন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করা হলে সেখানে কোটি কোটি টাকার পুঁজি বিনিয়োগে পর্যটকদের জন্য আবাসন, রিসোর্টসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে দেশের অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা এগিয়ে আসবে বলে জানান পর্যটন খাতের অভিজ্ঞজনেরা।
তাছাড়া পারকী সৈকত এলাকায় গড়ে তোলা ২০ কিলোমিটারব্যাপী বনবাগানের অনেকাংশই এখন ফাঁকা। স্থানীয় দুর্বৃত্তরা বন কেটে সাবাড় করছে। বন বিভাগ রয়েছে কার্যত নির্বিকার। ঝাউবীথির অনেক ঝাউ গাছ এখন নেই। অথচ ঝাউসহ নিবিড় নব বাগান হতে পারে পারকীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু পারকীতে ‘নিবিড়’ বনবাগান গড়ে তোলার কথা বন বিভাগের আশ্বাসের মধ্যেই সীমিত রয়েছে। বন বাগান ক্রমশ সাবাড় হতে থাকায় সেখানে পাখ-পাখালি বিশেষ করে অতিথি পাখির আনাগোনাও কমে গেছে।
পারকীর সুদৃশ্য সাগর সৈকতকে ঘিরে অফুরান ও উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও সুযোগ-সুবিধার অভাবে পর্যটকদের কাছে টানতে পারছে না। চট্টগ্রাম নগরীর সন্নিকটে হওয়ায় ভ্রমণপিয়াসুদের কাছে পারকী সৈকতের আলাদা একটি কদর থাকার কথা ছিল। কিন্তু অবকাঠামো ও আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা অপ্রতুল হওয়ায় তা আটকে আছে। পারকীতে বেড়াতে গেলে সময় ও অর্থ উভয়েরই সাশ্রয় হয়। পর্যটকরা দিনে দিনেই ফিরে যেতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় এবং সৈকতের চরম অব্যবস্থাপনার কারণে পর্যটকেরা আশানুরূপ সন্তুষ্ট হতে পারেন না। অবাধে মাদকের ব্যবহার ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অসামাজিক ব্যবসার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে আসা পর্যটকদের বিব্রত হতে হয়।
এদিকে প্রশাসন সূত্র জানায়, সরকার পারকী সৈকতের উন্নয়নে বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সৈকতের ৩২ একর জায়গায় গড়ে তোলা হবে ট্যুরিজম জোন। সেখানে গড়ে উঠবে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটকবান্ধব বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এছাড়া গড়ে তোলা হবে পর্যাপ্ত পার্কিং স্পেসসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। চট্টগ্রাম বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর দ্রুত বাস্তবায়ন হলেই পারকী সৈকতের শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বাড়বে পর্যটকের সংখ্যা।
যত্রতত্র অবৈধভাবে দোকানপাট গড়ে ওঠায় সৌন্দর্য হারাচ্ছে পারকী সৈকত। সম্প্রতি সৈকতের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ দোকানপাট। এসব দোকানপাট বসানোর কারণে পরিসরে ছোট হয়ে গেছে মূল সৈকতের জায়গা। তাছাড়া এসব দোকান সৈকতের সৌন্দর্যও ম্লান করে দিচ্ছে। অবৈধ দোকানগুলোর মালিক স্থানীয় লোকজন। এদের বিরুদ্ধে পর্যটকদের কাছ থেকে খাবারও পণ্যের মূল্য বেশি আদায় করার অভিযোগ রয়েছে হরহামেশা। এ কারণে অনেক সময়ই ঝগড়া-বিবাদেরও সৃষ্টি হয়।
এদিকে জোয়ারের লোনা পানিতে সৈকতে লাগানো ঝাউগাছের গোড়া থেকে মাটি সরে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে শত শত গাছ। পড়ে যাওয়ার পর এগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছে চোরের দল। ফলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এই ঝাউ বাগান। এ নিয়ে বন বিভাগের কর্তারা নির্লিপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।