Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ব্লু ইকোনোমির অপার সম্ভাবনা

প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩১ পিএম, ৯ অক্টোবর, ২০১৬

বড় বিনিয়োগে প্রস্তুত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক : প্রচারের অভাবে বিকশিত হচ্ছে না : অর্থ প্রতিমন্ত্রী
সোহাগ খান : উদ্যোক্তার অভাবে বিকশিত হচ্ছে না অপার সম্ভাবনার ব্লু ইকোনোমি বা সাগর অর্থনীতি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মুখিয়ে আছে এই খাতে বড় বিনিয়োগে। উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে পারলে সমুদ্রের তলদেশের সম্পদ একসময়ে প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হবে বলে মনে করেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের সমুদ্রের তলদেশে কত বেশী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে দেশের মানুষ সে সম্পর্কে অবগত নয়। যে কারণে ব্লু ইকোনোমির বিকাশ ঘটছে না। এ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তাহলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসবে এই খাতে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ব্যাংকগুলো শুধুমাত্র ফিশিং ট্রলারে বিনিয়োগের মাঝে আবদ্ধ রয়েছে। তাদের উচিত বিপুল সম্পদের হাতছানির এই খাতকে উৎসাহিত করতে নিয়মিত বিনিয়োগ বাড়ানো। বিশেষ করে অত্যাধুনিক ফিশিং জাহাজ কিনতে ঋণ প্রদানে কোন প্রকার কৃপণতা করা উচিত নয়।
অন্যান্য শিল্প খাতের চেয়ে এই খাতের বিনিয়োগ বেশী লাভজনক হবে বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই সচিব। তিনি বলেন, সমুদ্রের তলদেশের সম্পদ সঠিক ভাবে আহরণ করতে চাইলে এই খাতের বিনিয়োগের বিকল্প কিছু নেই। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সমুদ্রসম্পদকে বাংলাদেশের উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার সম্ভব। এক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা, উপযুক্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবিধা থাকতে হবে। এগুলোর ঘাটতি থাকলে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর এসব সুবিধা বিদ্যমান থাকলে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি বাংলাদেশের সামনে খুলে দিতে পারে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত।
এই উন্নয়নের অংশীদার হতে সাগর অর্থনীতিতে ব্যাপক হারে বিনিয়োগে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা। ব্লু ইকোনমিতে বিনিয়োগ কম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় উদ্যোক্তা পেলেই আগ্রহের সঙ্গে বিনিয়োগ করবেন তারা।
এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ব্লু-ইকোনোমি তথা সাগরের তলদেশের সম্পদ বাংলাদেশের একটি বিকাশমান খাত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলে আমরা মিয়ানমার-এর সাথে বিবদমান সাগরের মামলায় জয়লাভ করেছি। সবচেয়ে বেশী সম্পদ ঐ অংশে লুকায়িত আছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে পড়েছি। এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং দেশবাসী তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, ব্লু-ইকোনোমি সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা নেই বলে চলে। যার ফলে এই খাতে উদ্যোক্তা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তবে কোন নতুন উদ্যোক্তা এই খাতে আসলে অগ্রণী ব্যাংক বৃহৎ অংকের বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত আছে। অগ্রণী ব্যাংকের ফিশিং ট্রলারে যে বিনিয়োগ রয়েছে তার বেশীরভাগই নিয়মিত। সুতরাং ব্লুু-ইকোনমির মত বিকাশমান খাতে বিনিয়োগ করতে পরিচালনা পরিষদও কোন আপত্তি করবে বলে মনে হয় না।
পুরোনো উদ্যোক্তার চেয়ে নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানেই অগ্রণী ব্যাংক বেশী আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই আমি ব্যাংকের হাল ধরার পর সকল ব্যবস্থাপকদের বলে দিয়েছি, পাঁচটি ঋণ প্রদান করা হলে তিনটি নতুন উদ্যোক্তা আমার চাই। নতুন উদ্যোক্তাদের ব্লু-ইকোনমি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারি বিভাগের পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ আশরাফুর আজম খান বলেন, এই বিশাল সমুদ্র এলাকাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ তার অর্থনীতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে। তবে এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
তিনি বলেন, সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি লোক সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৯০ ভাগ লোকই উন্নয়নশীল দেশের। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন পেয়েছে। তবে বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা মাছ ধরার জন্য চট্টগ্রাম উপকূল থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। আমাদের মৎস্যজীবীদের ট্রলারের দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ৩০ ফুট। তাদের ব্যবহৃত জাল সর্বোচ্চ ২০ মিটার পানির গভীরে যেতে পারে। অথচ টুনা মাছ ধরার জন্য পানির ১০০ মিটার গভীরে জাল যেতে হয়। সমুদ্রের মাছ শিকার এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য আমাদের বর্তমান সক্ষমতা আরো বহুগুণে বাড়াতে হবে। যার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, অনেক দেরিতে হলেও সরকার এখন সাগরের নীল অর্থনীতি নিয়ে সচেতন হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘টুনা’ জাতীয় মাছ আহরণে সরকার ১০টি লং-লাইনার বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। ব্লু ইকোনোমির বাস্তবায়ন খুব বড় ধরনের একটি উদ্যোগ, সে অনুসারে আমাদের প্রয়োজনীয় ট্রলার, জাল, যন্ত্রপাতি কিছুই নেই। যদিও বছর খানেক ধরে অনেকেই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। টুনা মাছ রপ্তানির জন্য ৮ হাজার মার্কিন ডলার (সাড়ে ৫ লাখ টাকা) ফি দিয়ে সদস্যপদ নিতে হয় ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) কাছ থেকে। বাংলাদেশ এর সদস্য হওয়ার আবেদনও করেছে ২ বছর আগে। শুধু মাছ নয় ‘ব্লুু ইকোনোমি বা নীল অর্থনীতি’ কে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সামুদ্রিক শৈবাল, কাঁকড়া, কোরাল এসবের দিকেও নজর দিতে হবে।
তিনি জানান, বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণ উন্নত জাতের টুনা মাছের মজুদ রয়েছে। শুধু টুনা মাছ রপ্তানি করেই বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বে টুনা মাছের বাজার ১শ’ বিলিয়ন ডলারের।
ব্লু-ইকোনোমি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে কেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াবায়দুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, আমাদের দেশের সাগরের তলদেশে কি পরিমাণ সম্পদ লুকায়িত আছে সে সম্পর্কে কোন ধারণা দেশবাসীর নেই। যার ফলে চট্টগ্রামের কিছু ব্যবসায়ী শুধুই ফিশিং ট্রলারে বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ রেখেছেন। ব্লু-ইকোনোমি সম্পর্কে মানুষের ধারণা না থাকার ফলেই এই খাতে উদ্যোক্তা তৈরী হচ্ছে না। উদ্যোক্তার অভাবেই বিকাশমান এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না।
সমুদ্র বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. হোসেন জামিল বলেন, বাংলাদেশের উপকূল অংশে টুনা মাছের বিচরণ সবচেয়ে বেশি। সব প্রস্তুতি থাকলে আমাদের সমুদ্র অঞ্চলে বছরে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টন টুনা মাছ ধরা পড়ার কথা। সাধারণত প্রতিটি টুনা মাছ ১ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত হয়। প্রতি কেজি মাছের রপ্তানিমূল্য প্রায় ৪ হাজার টাকা। যথাযথ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে টুনা মাছ দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারী মাছের তালিকায় স্থান করে নেবে।
শুধু মাছ নয়, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে আছে বহু মূল্যবান খনিজ সম্পদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মালিকানাধীন বঙ্গোপসাগরের তলের গঠন বিবেচনায় এ অঞ্চলে তেল-গ্যাস ছাড়াও রূটাইল, ইলমেনাইট, গারনেট, মোনাজাইট, ম্যাগনেটাইট, কায়ানাইট, লিউকক্সিন ও জিরকনসহ নানা ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থ রয়েছে। রুটাইল রঞ্জক পদার্থের কাঁচামাল। ওয়েল্ডিং রডের বহিরাবরণ ও টাইটেনিয়াম নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার হয় মোনাজাইট। এটি তেজস্ক্রিয় থোরিয়ামের একটা ফসফেট যৌগ, যার মধ্যে কিছু পরিমাণ সিরিয়াম, ল্যানথানাম ও ইত্রিয়াম থাকে। একই সঙ্গে এটি পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি। এছাড়া পরমাণু বোমার কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হয় এটি। ইলমেনাইট উড়োজাহাজ, গাড়ি ও কেমিক্যাল প্লান্টের যন্ত্রাংশ এবং সার্জিক্যাল ইনষ্ট্রুমেন্ট তৈরিতে ব্যবহার হয়। মোনাজাইট রঙিন টেলিভিশন ও গ্যাস প্লান্টে ব্যবহার হয়। ম্যাগনেটাইট পরমাণু চুল্লি এক্স-রে মেশিন থেকে বের হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রোধ করে। জিরকন ইস্পাত কারখানায় তাপসহনীয় ইক (ব্রিক) হিসেবে ব্যবহার হয়। সিনথেটিক ডায়মন্ড তৈরিতেও ব্যবহার হয় এটি। গারনেটে রয়েছে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও সিলিকা। ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপকদের মতে, বঙ্গোপসাগর গ্যাস সম্পদের জন্য একটা ভালো জায়গা। সদ্য পাওয়া ভারতের সমুদ্র এলাকা ও মহানন্দা বেসিনে গ্যাস হাইড্রেট পাওয়া গেছে। এই গ্যাস হাইড্রেট বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরেও পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আছে।



 

Show all comments
  • কাওসার আহমেদ ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৫৫ পিএম says : 0
    বিশাল সমুদ্র এলাকাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ তার অর্থনীতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে।
    Total Reply(0) Reply
  • হাবিব ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ১:২৪ পিএম says : 0
    এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যান্ত সম্ভাবনাময় খাত
    Total Reply(0) Reply
  • তানিয়া ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ১:২৯ পিএম says : 0
    আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচিতে এই বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা উচিত
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্লু ইকোনোমির অপার সম্ভাবনা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ