Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার

প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

“জঙ্গিদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকার আগ পর্যন্ত সাঁড়াশি অভিযান চলবে” দুই মাস জঙ্গি মাস্টারমাইন্ডসহ ৬৮ দিনে ৩৩ জঙ্গি নিহত, গ্রেফতার ১৭৩
উমর ফারুক আলহাদী : জঙ্গিবিরোধী অভিযান আবারো জোরদার করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় এবং কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করে। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বার বার আহ্বান জানানোর পরেও অধিকাংশ জঙ্গি গোপনে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বগুড়া ও যশোরে ৫ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করলেও একটি শক্তিশালী জঙ্গি গ্রুপ দেশে আবারো বড় ধরনের নাশকতা ও হামলার পরিকল্পনা করছে। গোয়েন্দাদের এমন তথ্যের ভিত্তিতে আবারো জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এ অভিযানের অংশ হিসাবে গত শুক্রবার ভোর রাত থেকে শনিবার দিনভর গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়াতে জঙ্গি আস্তানায় সাঁড়াশি অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশ। এ অভিযানে ১২ জঙ্গি নিহত হয়েছে। গত দুই মাস ৮ দিনে মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী থেকে নব্য জেএমবির ৩৩ নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। এ সময়ে পুলিশ ও র‌্যাব রাজধানীসহ সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ১৭৩ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে ৯৭ জন নব্য জেএমবির ও ৯ জন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। অন্যরা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। বিভিন্ন গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিদের আস্তানা শনাক্ত করে একের পর এক চলছে মারমুখি ভয়ঙ্কর অভিযান।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা রয়েছে। বিভিন্ন পেশার নাম করে তথ্য পরিচয় গোপন রেখে জঙ্গিরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আস্তানা গড়েছে। এসব আস্তানায় রয়েছে তাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সেখান থেকেই বিভিন্ন সময় বড় ধরনের হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনা করছে। এমন তথ্যের ভিত্তিইে একের পর এক সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবির অনেক নেতাকর্মী নিহত হওয়ার পাশাপাশি গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে বলে মনে করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, জঙ্গি অর্থায়ন, যোগানদাতা, মদদ দাতাসহ জঙ্গি হামলার আড়ালের শক্তি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের খুব দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।
গুলশান হামলার পর রাজধানীর কল্যাণপুর, আজিমপুর, গাজীপুর আশুলিয়া, টাঙ্গাইল ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশে র‌্যাব পুলিশের অভিযানে নব্য জেএমবির ২৩ জন গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিসহ ৩৩ জঙ্গি গতকাল পর্যন্ত নিহত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আত্মসমর্পণ না করলে রেহায় নেই। যারা এখনো জঙ্গি কার্যক্রমে তৎপর তাদের জন্যও অপেক্ষা করছে করুণ পরিণতি। কোন অবস্থাতেই জঙ্গি ও তাদের অর্থদাতাদের ছাড় দেয়া হবে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, জঙ্গি দমনে সরকার সফল। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষ আজ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। জঙ্গি আস্তানায় র‌্যাব পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান তাদের দুর্বল করে দিয়েছে। অনেকেই তাদের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করছে। তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল আরো বলেন, জঙ্গি নেতা মেজার (অব.) জিয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছে, যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গি জিয়া গ্রেফতার হলে এদের তৎপরতা আরো কমে যাবে। জঙ্গিমুক্ত দেশ গড়তেই সারা দেশে জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আত্মসমর্পণ না করে জঙ্গিরা যখন র‌্যাব-পুলিশের ওপর হামলা করে তখন পাল্টা আক্রমণ করায় জঙ্গিরা নিহত হচ্ছে।
র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, দেশকে জঙ্গি মুক্ত করতে যা যা করার প্রয়োজন তাই করা হবে। তিনি বলেন, প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি কুঁড়ে জঙ্গিদের বের করা হবে। জুিঙ্গদের কফিনে শেষ পেরাকটি ঠুকে দেয়ার আগ পর্যন্ত জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, জঙ্গিদের নেটওযার্ক দুর্বল হয়ে গেছে। তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে র‌্যাব-পুলিশ। অর্থের যোগান দাতাদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয় ১৭ বিদেশীসহ ২২ জন। এদের মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন। এরপর ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদুল ফিতরের জামাতের অদূরে জঙ্গি হামলায় নিহত হয় দুই পুলিশ সদস্য এবং এক হামলাকারী।
এই দুটি ঘটনার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তখনই জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে আস্তানা গড়ে সেখান থেকেই তৎপরতা চালাচ্ছে জঙ্গিরা। আর এই আস্তানাগুলো শনাক্ত করতে তৎপর হয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
কল্যাণপুর অভিযানের এক মাস পর আবারও বড় ধরনের একটি অভিযানে যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতায় নাটের গুরু হিসেবে চিহ্নিত তামিম চৌধুরীর আস্তানার খোঁজ পেয়ে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় একটি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। সেখানেও গোলাগুলিতে নিহত হন তামিমসহ তিনজন। ওই আস্তানা থেকে জীবিত উদ্ধার হয়নি কেউ।
গাজীপুর সদরের লেবুবাগান এবং পাতারটেক এলাকায় পুলিশ এবং টাঙ্গাইল সদরের কাগমারী এলাকায় অভিযানে যায় র‌্যাব। ওই দিন সকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পাতারটেক এলাকার একটি দোতলা বাড়ি ঘিরে রাখে। কয়েক ঘণ্টা অভিযান শেষে পাতারটেকে সাত সন্দেহভাজন জঙ্গির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগেই লেবুবাগান এলাকায় দুই সন্দেহভাজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
আর টাঙ্গাইলের কাগমারায় র‌্যাবের ঘেরাও করা বাড়িতে দুইজনের মৃত্যুর খবর জানায় অভিযানে যাওয়া র‌্যাব।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করছেন, তামিম, জাহিদ এবং তার আগে ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে নয়জন জঙ্গি নিহত এবং ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ‘কমান্ডার’ শরিফুল ওরফে মুকুল, অর্থ যোগানদাতা আবদুর রহমান, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর জঙ্গিরা চাপে পড়ে গেছে।
র‌্যাব ও ডিএমপির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গুলশানে হামলার আগে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৯ সেপ্টম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৯৭ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে রাজধানীর দারুস সালামে পুলিশ সদস্য ইব্রাহীম মোল্লাকে হত্যা, পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে বোমা হামলা ও বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে জবাই করে হত্যার ঘটনায় জেএমবির ১৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তখন ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হোসেনি দালানে হামলার পরিকল্পনাকারী আলবানি ওরফে হুজ্জা, কামাল ওরফে হিরনসহ নব্য জেএমবির তিন জঙ্গি নিহত হন।
জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান একদিনে ১২ সন্দেহভাজন জঙ্গির মৃত্যু-এর আগে কখনও হয়নি। গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে একই সময় তিনটি আস্তানায় অভিযান শুরু করে পুলিশ, পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াত ও র‌্যাব। আর অভিযান শেষে গাজীপুরের এক আস্তানায় সাতজন এবং বাকি দুটিতে দুইজন করে মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়। পরে আশুলিয়াতে আরো ১ জঙ্গি নিহত হয়।
এর আগে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে একদিনে নয় সন্দেহভাজন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছিল মিরপুরের কল্যাণপুরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের পয়লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে নব্য জেএমবির ৫ জনের একটি দল। জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মারা যায় দেশি-বিদেশি ২২ নাগরিক। এ ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ চালায় সেনা কমান্ডোর একটি দল। এতে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী। তারা হলোÑ রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিব্রাস ইসলাম, মীর সাবিহ মোবাশ্বের, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গুলশানের ঘটনার সাতদিনের মাথায় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের দিন পুলিশের ওপর হামলা চালায় নব্য জেএমবির একটি গ্রুপ। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় আবীর রহমান নামে নব্য জেএমবির এক সদস্য। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় শফিউল নামে আরেক জঙ্গি। পরে ৫ আগস্ট র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শফিউল ও তার সহযোগী আবু মোকাতিল নিহত হয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট অভিযান চালায় মিরপুরের রূপনগরে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয় জাহিদুল ইসলাম নামে অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর। এর এক সপ্তাহ পর ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখানে নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী নিহত হয়। সেখান থেকে আটক করা হয় তিন নারী জঙ্গি ও তানভীরের ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ