পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কান্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে’ (সুফিয়া কামাল)। কবি শরতের শেষ দিকে হেমন্তের আগমনী বার্তা জানান দিতে রুপক অর্থে ‘চিঠি’ পাঠানোর কথা বললেও প্রকৃতিতে হেমন্তের আগমনী বার্তার ছোঁয়া নেই। শরৎ যাই যাই করছে। মাঠে সবুজের সমারোহ। হয়তো ঋতুচক্রে হেমন্ত এমনিতেই আসবে। কিন্তু হেমন্তের শুভ্র বাতাস ভোররাতে শরতের শেষ দিকে যে প্রবাহমান হওয়ার রীতি বিদ্যমান তা অনুভূত হচ্ছে না। শরৎ জুড়ে যেন প্রকৃতি রুদ্ররূপ। ভ্যাপসা গরমে মানুষের জীবন বিপন্ন। শরতের শেষ প্রান্তেও প্রচ- রোদ ও গরমের দাবদাহে অতিষ্ঠ নাগরিক জীবন। শরৎ ঋতু রানী নয়; এ রানী এখন যেন অগ্নিগর্ভ।
ষড় ঋতুর দেশে শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানী। ভাদ্র-আশ্বিন এ দু’মাস শরৎকাল। ঋতুরানী শরতের রূপ হয় রাজকীয় সুন্দর। শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময়। গ্রীষ্ম-বর্ষার পরের ঋতু শরৎ। এই শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি থাকার কথা নির্মল স্নিগ্ধ। প্রকৃতিগতভাবেই শরতের আকাশের মতো আকাশ আর কোন ঋতুতে দেখা যাওয়ার কথা নয়।
সব মিলিয়ে শরৎ হয় শুভ্রতার ঋতু। প্রকৃতির বেখেয়ালে সেই শরৎ এ বছর রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। পুরো শরৎ জুড়ে রাজধানী ঢাকায় ভ্যাপসা গরম। দুর্বিষহ যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। গ্রীষ্মের গরমের মতোই ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রী তাপমাত্রা পুরো ভাদ্র-আশ্বিন। এ কেমন রুদ্রমূর্তি? শরৎ যাই যাই করছে। অথচ প্রকৃতি হেমন্তের আগমনী বার্তা দিচ্ছে না। হীম শীতল হাওয়া এখনো ভোরে অনুভূত হয় না। শরতের এই রুদ্রমূতি এবং অগ্নিগর্ভ শরতের এ হালের জন্য দায়ী কে? পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশকে ধ্বংস করে কি আমরাই প্রকৃতির চিরায়ত রূপ-ঋতু বদলে দিচ্ছি? শরতের শুভ্রতায় একাকার হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই...’। ‘জাগার সাথী’ দূরের কথা প্রচ- দাবদাহ ও ভ্যাপসা গরমে শরতের রাতে মানুষ ঘুমাতেই পারে না। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করে রাত কাটে মানুষের।
বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর এই ভূখ-ে শরৎকালের রাতে জ্যোৎস্নার রূপ হওয়ার কথা অপরূপ। মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে পড়ার দৃশ্য থাকবে। চাঁদের আলোর শুভ্রতায় আকাশ থেকে কল্প-কথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসবে পৃথিবীতে। বাংলার ঋতু পরিক্রমায় ঋতু রানী শরৎ হবে মোহনীয়। শরতের আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াবে; উড়ে বেড়াবে লাটাই বাঁধা ছোট কাগজের তৈরি নানা প্রজাতির ঘুড়ির মতোই। অপরূপ সৌন্দর্যের কারণেইতো শরৎকালকে বলা হয় ঋতু রানী। প্রকৃতি প্রেমী শুধু নয়; যার মন আছে সে মানুষ শরৎকালে প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যে মোহিত হবেই। প্রকৃতির এমন রূপের বাহারে আগেকার দিনে কবি-সাহিত্যিকের মনোজগত ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ মেতে ওঠেছিল। তারা ফুল-পাখি-কাশবন নিয়ে রচনা করেন নতুন নতুন সাহিত্য। লেখেন কবিতা-গান-গল্প-নাটক। শরৎকাল লেখকদের নান্দনিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উদ্ভাসিত। অথচ এখন! গরমের যন্ত্রণায়..।
ক’দিন আগে ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-যমুনার চরে দেখলাম থোকা থোকা কাশের বন। সাদা কাশবন জানান দিচ্ছে শরৎকাল প্রবাহমান। নদীমার্তৃক বাংলাদেশে এ সময়ে প্রকৃতির সেজে ওঠার দৃশ্য তুলনাহীন। বর্ষার অঝোর ধারার বৃষ্টির ঝঞ্ঝাট নেই। বৃষ্টি কিছুটা থাকলেও তা শৌখিন। শরতে বর্ষার ভ্যাপসা গরম কমে আসে। শীতের আগমনী বার্তা বেজে ওঠে প্রকৃতির সাইরেনে। না শীত না গরমের আরাম অনুভূত হওয়ায় শরৎ হয়ে ওঠে আদরনীয় ও জীবনযাপনের জন্য লোভনীয় এক সময়। মাথার ওপরের আকাশ যেন বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র হয়ে ওঠে; আর নীলাকাশের বুক জুড়ে সাদা শৌখিন থোকা থোকা সাদা পাল তুলে মেঘের দল নৌকার মতো ভেসে বেড়ায়। আর সবুজ জমিনের কার্পেট সবুজ ঘাস ও বিভিন্ন ফুলে এবং পানিভারে নুয়ে পড়া নদীগুলোর তীর ঘেঁষে সারি সারি ফুটে থাকে সাদা বক, পালকের মতো ধবধবে কাশফুল। নরম বাতাসে কাশফুলের মাথা কি পরম সৌন্দর্যে দুলতে দুলতে জানায়, শরৎ এসেছে, শরৎ এসেছে, শরৎ এসেছে। তাইতো শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘চিক চিক করে বালি কোথা নেই কাঁদা/একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা’। নদ-নদীর তীরের কাশবন ফুলে ফুলে সাদাই রয়েছে। কিন্তু গরমের এতো যন্ত্রণা কেন? লোডশেডিং এ সাধারণ মানুষের এমনিতেই ত্রাহি অবস্থা। তারপর মাসের পর মাস জুড়ে ভ্যাপসা গরম মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। প্রকৃতির কেন এই বৈরী আচরণ?
কয়েক বছর আগে সিডর-আইলা নামের প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। পশুপাখিও মারা গেছে হাজারে হাজার। অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। কিন্তু সুন্দরবন অমূল্য সম্পদ বাঘসহ পশুপাখি এবং ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে বাঁচিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুন্দরবন ‘ঢাল’ হিসেবে কাজ করেছে। ভারতীয় স্বার্থে সেই সুন্দরবন ধ্বংস করতে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মানুষ এর প্রতিবাদ করলেও দিল্লী অখুশি হবে সে শঙ্কায় সরকার বদ্ধপরিকর রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবেই। আবার রাশিয়াকে খুশি করতে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। চিরনবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্ফোরণের ভয়াবহ কাহিনী বিশ্ববাসী জানে। তারপরও একগুঁয়েমি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবেই। মূলত প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের এ ধরনের বৈরী আচরণে ভূম-ল উত্তপ্ত হচ্ছে। বেখেয়ালী হয়ে পড়েছে প্রকৃতি। যার পরিণতি ভোগ করছে রাজধানী ঢাকার মানুষ। পুরো শরৎ জুড়ে তাপদাহে অতিষ্ঠ রাজধানীর মানুষ। যদিও গ্রামের নদীপাড়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকা ভ্রমণের সময় চোখে পড়লো গাঢ় নীল আকাশ। সোনা ঝরা রোদে শীতল বাতাস। নীলাভ আকাশে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে শিমুলের তুলোর মতো ভেসে চলেছে সাদা মেঘের ভেলা। নদীর ধারে ফুটেছে সাদা সাদা কাশফুল। মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে কাশফুল। দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কাশফুলের বনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকি। সাদা বক, পাখ-পাখালির দল মহা কলরবে ডানা মেলে ব্রহ্মপুত্র নদের আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মতো উড়ে যাচ্ছে। নদের চরের কিনারে বাঁশঝাড়ে বাচ্চা দিয়েছে কালো ডাহুক। বাচ্চাদের খাওয়ানো জন্য ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ডুবের পর ডুব দিয়ে মাছ ধরে উঠে যাচ্ছে। জারুল গাছে বসে মাছ শিকার করছে মাছরাঙা। দূর-দূরান্তে তাকাতেই দেখা গেল বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ তুলে নৌকা যাচ্ছে পাল তুলে। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা শহর ও উপজেলা শহরে ঘুরে চোখে পড়লো শিউলী, কামিনী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা, বেলী, ছাতিম, বরই, শাপলা, জারুল, রঙ্গন, টগর, রাধাচূড়া, মধুমঞ্জুরি, শ্বেতকাঞ্চন, মল্লিকা, মাধবী, কামিনী, নয়নতারা, ধুতরা, কল্কে, স্থলপদ্ম, কচুরী, সন্ধ্যামণি, জিঙে, জয়ন্তী প্রভৃতি নাম না জানা নানা জাতের ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে বাতাস। কবির ভাষায় ‘আমাদের দেশটারে কত ভালবাসি/সবুজ ঘাসের বুকে শেফালির হাসি’ দৃশ্য তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে দেখেছি।
বাংলার প্রকৃতিতে শরৎ মানেই নদীর তীরে তীরে কাশফুলের সাদাহাসির প্লাবন। মাঠে মাঠে সবুজের মেলা। মাঠ জুড়ে সবুজ ধানের সমারোহ। কিন্তু সকালে ধানের কচিপাতায় জমা হওয়া শিশিরের ওপর প্রভাতের তরুণ আলো মুক্তার মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে না কেন? এ কেমন মানুষের প্রতি শরতের বৈরী আচরণ? নাকি শরতের এ বেখেয়ালী আচরণের জন্য আমরাই দায়ী?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।