পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
করোনা সংক্রমণরোধে কঠোর লকডাউন উঠে গেছে ১১ আগস্ট। ঢল-বন্যা কেটে আবহাওয়া এখন স্বাভাবিক। সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা সচল। শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম নগরীর কদমতলী-মুরাদপুরে ছোট ছোট ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে ঘুরছে উৎপাদনের চাকা। শিল্পের কাঁচামাল, মেশিনারিজ, যন্ত্রাংশ এবং উৎপাদিত হরেক শিল্পপণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পুরোদমে চাঙ্গা।
করোনা সংক্রমণ শনাক্ত ও মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হ্রাস, টিকাদান ও গণটিকা কার্যক্রম প্রসার জনজীবনে আপাতত স্বস্তিদায়ক। তিন মাস পর চট্টগ্রামে করোনায় মৃত্যুহীন পর পর দুই দিন পার হলো গতকাল শনিবার। এরফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী মহলও পাচ্ছেন ‘শুভ সঙ্কেত’। এ যেন ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’।
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের ধারক, প্রধান শিল্পনগরী, বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম। সময়ের প্রয়োজনে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছেই। ‘ডেড হর্স’ নয়; করোনার ধাক্কা সামলে খাদের প্রায় কিনারা থেকে এবার নবউদ্যমে ছুটছে অর্থনীতির তেজী ঘোড়া। মন্দা কাটিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং সম্প্রসারণ হচ্ছে। অর্থনীতিতে হয়েছে গতিসঞ্চার এবং হচ্ছে সবল। তিনটি ইপিজেডে এবং গার্মেন্টস, ইস্পাত, সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, চিনিসহ ভোগ্যপণ্যের শিল্প এলাকাগুলোতে প্রায় পাঁচ শত শিল্প-কারখানা উৎপাদনে সচল। দুইশ’র বেশি কারখানা নির্মাণের প্রক্রিয়ায়। নির্মাণকাজে জড়িত বিদেশি প্রকৌশলী ও কর্মীরা ফিরেছেন। শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগকারী এবং ক্রেতা (বায়ার) ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী (সাপ্লাইয়ার) চীন, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতির উন্নতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বয়ে এনেছে।
এ প্রসঙ্গে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। হয়তো একসময়ে চলেও যাবে। কিন্তু করোনার অভিঘাতে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। দীর্ঘদিন মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। বন্দর-শিপিং কার্যক্রম চাঙ্গা হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক জোনগুলোকে শিল্প-কারখানা স্থাপনের উপযোগী দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শেষ করে বিনিয়োগকারীদের বুঝিয়ে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে শিল্প স্থাপনের জন্য অবকাঠামো দ্রুত সম্পন্ন করা সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। চট্টগ্রাম বন্দরসহ নির্মাণাধীন বে-টার্মিনালের সঙ্গে কানেকটিভিটি এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি।
উত্তর চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে বন্দরনগরী হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপাড়ে আনোয়ারা-পটিয়ায় নতুন শিল্প-কারখানা নির্মাণ ও সম্প্রসারণ কাজ চলছে। দেশি-বিদেশি যৌথ ও একক বিনিয়োগের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। শিল্পায়নে দেশীয় নামীদামী শিল্প গ্রুপ ছাড়াও চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।
রফতানি অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) শিল্পজোন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’ বিনির্মাণে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রকল্পটি বিগত ফেব্রুয়ারি মাসে একনেক সভায় অনুমোদনের পর অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্প-কারখানা স্থাপন কার্যক্রম বেগবান হচ্ছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সীতাকুণ্ড এবং ফেনীর সোনাগাজী এই তিন উপজেলা নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ এই শিল্পজোনের প্রায় ৩০ হাজার একর জমি। ৪ হাজার ৩৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। এটি হবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহনশীল, পরিবেশবান্ধব, প্রযুক্তি-নির্ভর ‘ইকো শিল্পাঞ্চল’।
বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহ, সড়ক রাস্তাঘাট, সুপার ডাইক এবং আংশিক শিল্প প্লট তৈরি হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে। শিল্পজোনে ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। রফতানি হবে বার্ষিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী। ইতোমধ্যে ১৭০টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৮ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এতে প্রায় ২২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে। বর্তমানে ১৮টি শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান ট্রায়াল রানে গেছে। নির্মাণাধীন আরো ১৬ প্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলীর ওপাড়ে কোরিয়ান ইপিজেড (কেইপিজেড) বিনিয়োগ, শিল্প-কারখানা সম্প্রসারণ ও উৎপাদনে কর্মচঞ্চল। তবে আনোয়ারায় চায়না স্পেশাল ইকনোমিক জোন নির্মাণকাজ কিছুদূর এগিয়ে থমকে আছে।
করোনাকালে গোড়া থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর দিন-রাত সার্বক্ষণিক (২৪/৭) সচল। তবে কঠোর লকডাউন প্রত্যাহারের পর শতভাগ কর্মমুখর। আমদানি পণ্য ডেলিভারি পরিবহন এবং রফতানি চালান জাহাজীকরণে বন্দর কর্তৃপক্ষের সমানতালে ব্যস্ত বন্দর ব্যবহারকারীরা। বন্দর সম্পূর্ণ জটমুক্ত। বহির্নোঙরে অলস অপেক্ষা ছাড়াই ৯০ ভাগ জাহাজ মাত্র এক থেকে দু’দিনে সরাসরি ভিড়ছে জেটি-বার্থে। বাংলাদেশে ও বৈশি^ক করোনা মহামারী পরিস্থিতির উন্নতি এবং কঠোর লকডাউন প্রত্যাহারের সুবাদে বন্দরে পণ্যসামগ্রী ওঠানামা এবং কাস্টমসের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। গেল আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৬৯০ টিইইউএস আমদানি-রফতানি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং ৩২৬টি জাহাজ আসা-যাওয়া করেছে। আগের বছরে একই সময়ে (আগস্ট’২০২০) ২ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৭ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং ২৭১টি জাহাজ আসা-যাওয়া করে।
গত আগস্টে প্রধান বন্দর-ভিত্তিক একক বৃহৎ রাজস্ব প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪১০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আগস্ট’২০২০ সালে আদায় হয়েছিল ৩ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আয় এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৫ শতাংশ। পণ্য হ্যান্ডলিং, রাজস্ব আয় বৃদ্ধিসহ সব সূচকে উন্নতির ফলে বন্দর-কাস্টমস-শিপিং বর্তমানে করোনার পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরেছে। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বন্দরে এখন কার্গো, জাহাজ কিংবা কন্টেইনার জট নেই। দ্রুত পণ্য খালাস হচ্ছে। পরিবহন ও ডেলিভারিতে কোন সমস্যা নেই। বহির্নোঙরে গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি বড় জাহাজ থেকে লাইটার-কোস্টার জাহাজে খালাস এবং নৌপথে পরিবহন হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ইস্পাত ও লোহাজাত, সিমেন্ট শিল্প এখন নতুন উচ্চতায় আসীন। সারাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চাহিদার ৬০ ভাগেরও বেশি পূরণ করছে চট্টগ্রামের স্টিল অ্যান্ড আয়রন এবং সিমেন্ট কারখানাগুলো। স্বনামখ্যাত শিল্পোদ্যোক্তা মোস্তফা-হাকিম গ্রুপ কর্ণফুলীর ওপাড়ে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে এইচ এম স্টিল নামে নতুন ইস্পাত কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একই শিল্পগ্রুপের গোল্ডেন ইস্পাতও সচল। করোনাকালেও নতুন ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে বিলেট রফতানি হচ্ছে চীনে। প্রথমবারের মত চীনে এম এস বিলেট রফতানি করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও ব্যবসা উন্নয়ন) কামরুল ইসলাম এফসিএ জানান, গত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চীনে ৯০ হাজার মেট্রিক টন বিলেট রফতানি হয়েছে। বছরের শেষদিকে আরও ৩০ হাজার টন রফতানি হবে। ইস্পাত শিল্পখাতে আরও অবদান রাখছে কেএসআরএম, বিএসআরএম, একেএস, আরএসআরএম, শীতলপুর রি-রোলিং মিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পে চট্টগ্রামের ইস্পাত ও সিমেন্ট কারখানাগুলো নির্মাণসামগ্রী জোগান দিয়ে আসছে।
ইস্পাত শিল্প কাঁচামালের প্রধান উৎস শিপব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে পর্যাপ্ত জোগান আসছে। এরফলে ইস্পাত ও লোহাজাত কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। সীতাকুণ্ড উপকূলে জাহাজ ভাঙা শিল্পে দারুণ ব্যস্ততা। ছোটবড় ৪০টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড পুরোদমে চালু। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের সার্বিক পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করেছে। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও আগের তুলনায় অনেকটা নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব হয়েছে শ্রমঘন এই খাত। তাছাড়া স্ক্র্যাপ, পিগ আয়রন আমদানি হচ্ছে।
গার্মেন্টস শিল্পের জন্মস্থান চট্টগ্রাম। সঙ্কট কাটিয়ে এই খাত বেশ চাঙ্গা। ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে। বিজিএমইএএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার ধাক্কা সামলে তৈরি পোশাক খাত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। আমেরিকা, ইউরোপের বাজার থেকে ব্যাপকহারে অর্ডার আসছে। রফতানির পিক সিজন চলছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। করোনার আগের অবস্থায় ফিরেছে গার্মেন্টস খাত।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের জিএম মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ বলেন, এই ইপিজেডে বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বড় দু’টি কারখানা শিগগিরই উৎপাদনে যাবে। তাতে অনেক কর্মসংস্থান হবে। ইপিজেডে চালু কারখানাগুলোতেও পুরোদমে উৎপাদন চলছে। কর্ণফুলী ইপিজেডের জিএম মো. এনামুল হক জানান, ইপিজেড কেন্দ্রিক বিনিয়োগের আগ্রহ থাকলেও জমির অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কয়েকটি কারখানা তাদের ইউনিট সম্প্রসারণ এবং নতুন ইউনিট চালু করেছে।
আবাসন খাত মন্দা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, আবাসন খাত ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনার ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।