Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শেখ রেহানা : এক সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি

এন আই আহমেদ সৈকত | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

শেখ রেহানার ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই শান্তির আলোকবর্তিকা হাতে বিশ্বময় শেখ হাসিনা। শেখ রেহানা বেগম মুজিবের পরিপূরক হয়ে উঠেছেন তার কর্মে এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে। শেখ রেহানার জীবনালেখ্য নিয়ে হয়তো বেশি কিছু জানা যায়নি, তবে জীবনের গভীরতা অনুধাবন করা যায় ব্যাপকভাবে। কারণ, তার সাদামাটা জীবনচরিত এবং অতিথিপরায়ণতা সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সারাজীবন দু:খ, কষ্ট আর সংগ্রামে বেড়ে ওঠা তার। বাবার আদর খুব একটা ভাগ্যে জোটার সুযোগ ছিল না। মায়ের আঁচলে আগলে থাকতে পারেননি দীর্ঘদিন। ছোট থেকেই জীবনের অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে গেছে সংগ্রাম। জীবনের সঙ্গে লড়াই করে আসা এই মানুষটি আর কেউ নন তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা। তিনি একজন মহিয়সী নারী। ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুকে থাকা স্বত্তে¡ও একজন নিরহংকারী সাধারণ জীবনযাপনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সততার অনুকরণীয় আদর্শ এক রতœাগর্ভা মা তিনি। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও কখনও রাজনীতিতে আসেননি শেখ রেহানা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ সক্রিয় রাজনীতিবিদদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। জনহিতৈষী কাজে সব সময়ই ভূমিকা রেখেছেন শেখ রেহানা। বড় বোন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কাছে যিনি শুধুই আদরের রেহানা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। একজন প্রচারবিমুখ মানুষ তিনি, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় ভরসার জায়গা, তার প্রেরণার উৎস আর সংকটে সাহসের ভান্ডার হিসেবে পাশে থাকেন। সরাসরি রাজনীতিতে দেখা যায়না শেখ রেহানাকে তবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছে ‘ছোট আপা’ হিসেবে পরিচিত তিনি। বঙ্গবন্ধু যেমন সারাজীবন শুধু মানুষের কথা চিন্তা করেছেন, তাদের মুক্তির গান গেয়েছেন, তেমনি এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে এদেশের মানুষের জন্য কাজ করছেন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। একজন কাজ করছেন জীবন বাজি রেখে পর্দার সামনে, অপরজন পর্দার অন্তরালে বোনকে সাহস যুগিয়ে, উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। যেমনটি পেয়েছিল বাঙালি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কাছ থেকে। তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। তেমনি শেখ হাসিনার উৎসাহের ভান্ডার শেখ রেহানা।
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে শেখ রেহানা একজন সৎ, একজন সংগ্রামী মানুষ। অতি সাধারণ জীবনযাপন তার। প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন, কিন্তু নিরহংকারী সাদাসিদে সধারণ জীবন তার।নিজে চাকুরি করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছেন, বুঝিয়েছেন জীবনবোধ। সংগ্রাম করেছেন জীবনের প্রতিটি স্তরে। নিরহংকারের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ শেখ রেহানা। তার বড়বোন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী অথচ আচরণে তার কোনো ছাপ নেই। পাবলিক গাড়িতে করে নিজের অফিসে আসা-যাওয়ার খবর সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি আমরা। ব্রিটেনের যে কোনো বাঙালি নাগরিক শেখ রেহানার কাছে সহজেই যেতে পারেন। কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি পাথেয় হয়ে থাকবেন। একবার ভাবা যায়, নিজের বোন প্রধানমন্ত্রী অথচ তিনি অন্যের অফিসে কাজ করেন। সততার এমন দৃষ্টান্ত বিরল এবং শেখ রেহানা তা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। মানবিক মানুষ হিসেব তিনি অনন্য।
বড় বোন শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, কিভাবে সংগ্রাম করে সন্তানদের মানুষ করেছেন শেখ রেহানা। তিনি তার তিন সন্তানকে সঠিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাদের মধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক ইতোমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন গুরুত্বপূর্ণ এমপি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বড় ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি। মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তী মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে এর মধ্যেই পাশ্চাত্যে সাড়া ফেলেছেন।
ছোট ছেলে-মেয়েদের প্রতি মা-বাবার আদর একটু বেশিই থাকে। কিন্তু শেখ রেহানার ভাগ্যে তা খুব একটা জোটেনি। বাবার সান্নিধ্য খুব একটা পাননি। বঙ্গবন্ধু তো জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন বাংলার গণমানুষের জন্য। জীবনের সেরা সময়গুলো কাটিয়েছেন কারাগারে। পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বা প্রায়ই থাকতেন জেলখানায়। আমদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আব্বাও জেলের বাইরে, ঈদও এলো এমন হলে তো কথাই নেই। আমাদের হতো ডাবল ঈদ।’
বাবাকে কাছে পাবার যে আকুতি তা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিচারনেও ‘ছোট মেয়েটার (শেখ রেহানা) শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে কোথায় থাকি তা দেখবে। সে বলে, থেকে যেতে রাজি আছি।’ (১৫ই জুন ১৯৬৬, বুধবার, কারাগারের রোজনামচা)
শেখ রেহানা এতোটাই অভাগা যে অল্প বয়সেই মা-বাবাকে হারিয়েছেন তিনি। বড় বোনের সঙ্গে বিদেশে থাকায় সেদিন বেঁচে যান শেখ রেহানা। ৭৫’এর কালো অধ্যায়ের পর জীবন সংগ্রাম কাকে বলে তা উপলব্ধি করেছেন। জয়ীও হয়েছেন নিজের জীবনসংগ্রামে। দুই বোনই সংগ্রাম করেছেন জীবনের সঙ্গে। এতোটাই সংগ্রামী ছিলো তাদের জীবন যে ছোট বোন শেখ রেহানার বিয়েতে দিল্লী থেকে লন্ডন যেতে পারেননি শেখ হাসিনা শুধু টাকার অভাবে। বিমানের টিকিট কেনার অর্থ তার ছিলনা।

শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক তার একটি লেখায় উল্লেখ করেন, ৮৩ সালে তখন হাসিনা আপা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ওই সময়ে আমি আমার পিএইচডি থিসিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম। এক দিন হাসিনা আপার বাসায় উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, উনি হাশেম ভুঁইয়া নামের একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে লন্ডন পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। তখন হাসিনা আপা বেশ দুঃখ করে আমাকে বললেন, ‘শফিক দেখ, আজকে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আমার একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু সেদিন আমার একমাত্র বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দিল্লি থেকে লন্ডন যেতে পারিনি, কেবল টিকিটের টাকার অভাবে।’ এর চেয়ে বড় কষ্ট ও দুঃখের ঘটনা কারও জীবনে হতে পারে না।
শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডনের কিলবার্নে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুখ দুঃখের সাথী, বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার বাড়িতে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকের সাথে। শফিক আহমেদ সিদ্দিক তখন বিলেতের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষারত ছিলেন।
বিয়ের পর শফিক আহমেদ সিদ্দিক ও শেখ রেহানাকে নানামুখী সংকট মোকাবেলা করে অগ্রসর হতে হয়েছে। সে সময় আর্থিক কষ্টটাই ছিল প্রবল। বিয়ের পরপরই স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে চাইলেই একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাই শেখ রেহানাও বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছিলেন।
শেখ রেহানা চাকরি করবেন সেটি নিয়ে খুব দ্বিধাদ্ব›েদ্বই ছিলেন শফিক আহমেদ সিদ্দিক। পরে রাজিও হন। কারণ শেখ রেহানা প্রায়ই একা বাসায় থাকতেন এবং সার্বক্ষণিক মা, বাবা ও ভাইদের ছবি সামনে নিয়ে কান্নাকাটি করতেন। এ কারণে শফিক সিদ্দিকের সন্দেহ জেগেছিল, এভাবে একা থাকতে থাকতে শেখ রেহানার মানসিক সমস্যা যদি দেখা দেয়। সুতরাং কাজে থাকলে মানুষের সান্নিধ্যে ও ব্যস্ত থাকার কারণে পনেরোই আগস্টের ভয়াবহ স্মৃতি কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারবেন শেখ রেহানা।
আজ ১৩ সেপ্টেম্বর, শেখ রেহানার জন্মদিন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন।এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৫৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তার জন্ম।
তিনি বাঙালি নারীদের আদর্শ। কিভাবে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া যায়, ক্ষমতার লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায়, কোন পদে না থেকেও দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করা যায়, সেটা তিনি দেখিয়েছেন। তাঁর এই নির্মোহ চরিত্রই বাংলাদেশের ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে। সেই প্রচারবিমুখ মহিয়সী নারীর শুভ জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা।
পরিশেষে জন্মদিনে তার একটি কথা স্মরণ করে শেষ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘এই দিনে আমরা সকলে মিলে অঙ্গীকার করি- আমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। সুন্দর, সমৃদ্ধ এবং দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়ব। সোনার বাংলাকে ভালবাসব। পরশ্রীকাতরতা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখব। ঘরে ঘরে মুজিবের আদর্শের দূর্গ তৈরি করে তার আলো ছড়িয়ে দিব। কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’।
রোটারিয়ান এন আই আহমেদ সৈকত,
উপ তথ্য ও যোগাযোগ( আইটি) সম্পাদক,
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শেখ রেহানা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ