ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
এম আবদুল্লাহ : “পুলিশের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে এদের বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে। এরা কেন এত বেপরোয়া আচরণ করছে? আসলে এরা কারা? কয়েকজন পুলিশের আচরণের জন্য পুলিশের সব অর্জন ম্লান হচ্ছে”। গেল গত ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে এমন উষ্মা প্রকাশ করেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিবাহ। আগের দিন বুধবার রাজধানীর মিরপুরে বাবুল মাতব্বর নামে এক চা দোকানিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবারে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেন তিনি। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে বলেন, ‘এরা বলছে- তারা নাকি দেশের রাজা, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে এরা কারা, এদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন?’ তিনি আরো বলেন, ‘কেন পুলিশ এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ করছে, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থেকে জনগণের সেবা বা নিরাপত্তা না দিয়ে কেন জনগণকে হেনস্থা করছে? পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তা ধরাকে সরাজ্ঞান করে এমন আচরণ করছে। তারা কিভাবে এমন বেপরোয়া হয়ে উঠলো তা ভেবে দেখা দরকার।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের অভিভাবক। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি সাহেব পুলিশের বিরুদ্ধ ক্ষোভ ঝেড়েছেন সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। আর পুলিশের আইজি সাফ বলে দিয়েছেন, কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের অপকর্মের দায় পুলিশ বাহিনীর নয়।
পুলিশের বেপরোয়া অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিয়ে কয়েক মাস ধরে আলোচনা-সামালোচনার ঝড় বইছে। লেখালেখিও হচ্ছে বিস্তর। জননিরাপত্তার মূল দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধের তালিকায় যখন থাকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, ঘুষ গ্রহণ, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, হত্যা, ছিনতাইসহ চোখ বেঁধে পায়ে গুলি এবং থানাহাজতে নির্যাতনের মতো জননিরাপত্তাবিপন্নকারী বিষয় তখন বিবেকবান মানুষকে তা ভাবিয়ে তোলে। দেখা যাচ্ছে, এমন কোনো অপরাধ নেই যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা করছেন না। নিরীহ নাগরিকদের হয়রানি, বিনা ওয়ারেন্টে যে কাউকে আটক, সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং পরে কখনো স্বীকার, কখনো অস্বীকার করা, অর্থের বিনিময়ে পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান, অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাতসহ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। সব মিলিয়ে জননিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ এখন ভয়ানক বেপরোয়া আচরণ করছে। দিনদিন পুলিশ সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠছে মূর্তমান আতঙ্ক।
সর্বশেষ পুলিশী নির্মমতার শিকার বাবুল মাতব্বর। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাবুলের স্ত্রী লাকি বেগমের ভাষ্য অনুযায়ী, গত বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে চাঁদা না দেয়ায় পুলিশের উপস্থিতিতে তাদের সোর্স দেলোয়ার লাথি মেরে বাবুলকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাবুলের সারা গায়ে আগুন ধরে যায়। চার পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখেন। বাবুল মাটিতে গড়াগড়ি করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তিনি বালতিতে থাকা পানি দিয়ে স্বামীর শরীরের আগুন নেভাতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলেও কাজ হয়নি। সারা শরীর পুড়ে যাওয়া বাবুলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করার পর বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান।
দিন কয়েক আগে মোহাম্মদপুরের আসাদগেট এলাকা থেকে মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ রানা শিকদারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক গোলাম রাব্বীকে তুলে নিয়ে বেদম মারধরের পর মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়। প্রাণে বাঁচতে হলে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে বলে দাবি করে পুলিশের ওই দলটি। তবে কোনোক্রমে ছাড়া পান গোলাম রাব্বী। মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকায় এ নিয়ে বেশ হইচইও পড়ে যায়।
যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মীরহাজিরবাগে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে। পুলিশ বিকাশকে পেটানোর সময় বলে, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। একই দিন রাজধানীর পুরান ঢাকায় অজয় শীল নামে এক যুবকের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ।
কিছুটা পুরনো হলেও অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, স্পেশাল পুলিশ ব্যাটালিয়নে এক সদস্য বন্ধুদের সাথে নিয়ে নিজ বাহিনীর কনস্টেবলের স্ত্রীকে গণধর্ষণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে দায়িত্বরত আনসার সদস্য এক রোগীর কন্যাকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে আনসার ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় সাত লাখ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন পুলিশের বিশেষ শাখার এএসআই মাহফুজুর রহমান ও তার গাড়িচালক। পরে জিজ্ঞাসাবাদে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত অন্তত দুই ডজন পুলিশ সদস্যের নাম ফাঁস করে দেন মাহফুজুর রহমান। তার অ্যাকাউন্টে এক মাসেই মাদক ব্যবসার ২৭ কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ মেলে। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে পুলিশের গুলিতে চারজন মারা যান। ছেলের সামনে মাকে নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনার প্রতিবাদে জনতা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সে সময় এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও দায়ী পুলিশদের বিচারের মুখোমুখি করার কোন খবর কেউ জানে না।
অপরাধপ্রবণতা যেকোনো মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে। সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের মধ্যে যে কোন পেশার লোকই জড়াতে পারে অপরাধে। অন্যান্য পেশার লোকও মাঝেমধ্যে অপরাধে জড়াচ্ছেন। তবে যাদের গায়ে বিশেষ পোশাক জড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যাদের দায়িত্বই হচ্ছে অপরাধ রোধ করা, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করা, তারা যদি অপরাধমূলক কাজে ব্যাপক হারে জড়িয়ে পড়েন তাহলে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে গভীর উৎকণ্ঠার।
সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান হঠাৎ কেন পুলিশের ওপর চটলেন তা বোধগম্য নয়। এরা কারা বলে তিনি যে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন তাও বিস্ময়কর বৈকি। বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষতো বটেই, কানা-বধিরও জানে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ কেন এত বেপরোয়া। পুলিশের বড়-কর্তারা এমপি সাহেবের প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যেই দিতে পারেন। বলতে পারেন যে, ‘পুলিশ বড্ড বেশি বাড়ার এবং বেপরোয়া আচরণ করার বড় কারণ আপনার সরকারের দুর্বলতা ও আমাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরতা’।
পুলিশ কর্মকর্তারা এমপি সাহেবের প্রতি একটা মামুলী চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিতে পারেন। বলতে পারেন,আমরা রাইফেলের নলটি ঘুরিয়ে দিয়ে দেখি? ঘুরিয়ে দেয়ারও দরকার হবে না, কেবল আইনানুগ ও ন্যায়সংগত আচরণ করে দেখি আপনাদের কি অবস্থা হয়। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মুরোদ এমপি সাহেবের আছে বলে মনে হয় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বেআইনি ও অন্যায়ভাবে বিরোধীদের ওপর দমন-নিপীড়ন থেকে বিরত থাকলে সরকার ৬ মাসও টিকবে কিনা সে সংশয় ও শংকা আছে খোদ শাসক দলেই। অতএব বিরোধী দলহীন সংসদে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা-পুলিশ সামলা’ ধরনের ধ¦নি তোলার কোন মানে হয় না।
বলা বাহুল্য, নিয়োগ-বদলিতে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলে যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপরাধের বিচারহীনতা পুলিশের বেপরোয়া আচরণের প্রধান কারণ। পুলিশের অপকর্মের সাধারণত নিরপেক্ষ তদন্ত হয় না। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাসপেন্ডও করা হয় না। শুধু ক্লোজ করা হয়। গুরুতর অপরাধে ক্লোজ কোন শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। পুলিশের অপরাধ পুলিশই তদন্ত করে। অভিযোগ আছে, তাই সহজেই রাজনৈতিক পরিচয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে তদন্তকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অপরাধকারী পুলিশ বেঁচে যান। পরে এদেরই অনেকে বড় বড় পোস্টে কাজ করেন। চট্টগ্রামের রাউজান থানাহাজতে থাকা সীমা চৌধুরী নামের এক তরুণী পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণের মামলার রায়ে তৎকালীন জেলা জজ তার পর্যবেক্ষণে যথার্থভাবেই বলেছিলেন, ‘বাদী পুলিশ, আসামি পুলিশ, তদন্তকারী পুলিশÑ এই মামলায় ভিকটিমের সাহায্য পাওয়ার সুযোগ কই?’
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।