পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে তাদের স্বাগত জানাব -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
মহসিন রাজু, বগুড়া থেকে : দুই মাস আগে পূর্ব বগুড়ার সারিয়াকান্দির দুর্গম চরাঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সমাপ্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে র্যাবের ডিজি বেনজীর আহম্মেদ ঘোষণা দিয়েছিলেন “বিপথগামী জঙ্গিদের মধ্যে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় তারা আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে আর্থিক ও আইনগত সহায়তা দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে।” মূলত সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে গতকাল (বুধবার) বগুড়ার শাজাহানপুরের আব্দুল হাকিম ও গাইবান্ধার মাহমুদুল হাসান বিজয় (১৭) আত্মসমর্পণ করে প্রত্যেকে প্রণোদনা বাবদ ৫ লাখ টাকার পৃথক দুটি চেক গ্রহন করলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দুই জঙ্গি আব্দুল হাকিম ও বিজয় উপস্থিত সকলের উদ্যেশ্যে বলেন, “আমরা যে পথে ছিলাম সে পথ অন্ধকারের। সে পথে যেন কেউ না আসে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় সকল জঙ্গিরই সাড়া দেয়া উচিত। আমরা ভুল পথে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এবং অনুতপ্ত। আমাদের ক্ষমা করবেন। আমরা যেন দেশের জন্য ভালো কাজ করতে পারি। জঙ্গি হাকিমের বড় ভাই আব্দুল হালিম ও বিজয়ের মা আকতার জাহানও কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের ছেলে ও ভাইয়ের কৃতকর্মের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সকল জঙ্গিকে সঠিক পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান। বিজয়ের মায়ের কান্নাজড়িত ও আবেগমথিত বক্তব্যের সময় পুরো টিটু মিলনায়তন হলে পিন পতন স্তব্ধতা নেমে আসে। পানিতে ভিজে উঠে প্রায় সব শ্রোতারই চোখ!
এই প্রণোদনা চেক প্রদান উপলক্ষে বগুড়ার শহীদ টিটু মিলনায়তনে র্যাব আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বিপথগামীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘‘ইসলাম ধর্মকে কলঙ্কিত করার পথ থেকে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে তাদেরকে আমরা স্বাগত জানাব। সন্ত্রাস জঙ্গিবাদে জড়িতরা আত্মসমর্পণ করুন, অন্যথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজে আনবেই। যেসব পরিবারের সন্তানরা বিপথগামী হয়েছে তাদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি অভিভাবকদের প্রতি আহবান জানান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন র্যাব-১২ অধিনায়ক ও এডিশনাল ডিআইজি শাহাবুদ্দিন খান বিপিএম।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি রুখে দিতেই সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী কর্মকা- চালাচ্ছে ৭১-এর পরাজিত শক্তি। ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ তরুণদের পথভ্রষ্ট করা হচ্ছে। বিদেশিদের হত্যা করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথ বন্ধ করার অপেচষ্টা চলছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে ভুল বুঝিয়ে তরুণদের বিপথগামী করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মুসলমান জাতিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে। কারা এসবের সাথে জড়িত তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জেনে গেছে। জামায়াত শিবির এসব বিপথগামীদের পথভ্রষ্ট করতে উৎসাহিত করেছে। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের জীবন দিয়ে জঙ্গিবাদ দমনে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, যারা পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী হয়েছে তারা ফিরে আসার জন্যও পথ খোলা রাখা হয়েছে। শীঘ্রই আরো জঙ্গি সদস্য আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তিনি সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে র্যাব মহাপরিচালক ও এ্যাডিশনাল আইজিপি বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘অযৌক্তিক কারণে রক্তপাত ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম রক্তঋণ পরিশোধে খুনের ধারা বন্ধ করতে বলেছে। শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা দেশে অশান্তি করছে সেই শকুনিদের ডানা ও কলিজা ছিঁড়ে ফেলা হবে। দু’একটি পিস্তল, গ্রেনেড, এ কে ফোরটি সেভেন রাইফেল নিয়ে আসলে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী কতটা শক্তিশালী তা সকলেই দেখেছে। যারা স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসবে তাদেরকে পুনর্বাসনে সহায়তা করা হবে, যাতে সমাজের মূল ধারায় তারা ফিরে আসতে পারে।’’
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন র্যাব-১২ বগুড়া কোম্পানির অধিনায়ক মেজর এএফএম আজমল হোসেন খান।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বিশেষ অতিথি বগুড়া সদরের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম ওমর ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ মমতাজ উদ্দিন, বগুড়া জেলা প্রশাসক মোঃ আশরাফ উদ্দিন, পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, র্যাব-১২ অধিনায়ক মোঃ শাহাবুদ্দিন খান প্রমুখ। এছাড়াও রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইং-এর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘জঙ্গি মোঃ আব্দুল হাকিম (২২) পিতা আব্দুর রহমান, সাং- কামারপাড়া, থানা শাজাহানপুর, জেলা: বগুড়া। সে ছোট বেলায় ব্রাক স্কুলে পড়াশোনা করে। এরপর কামারপাড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ৩য় শ্রেণীতে পড়ার পর কুষ্টিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণীতের ভর্তি হয়। সেখানে ২ বছর পড়াশোনার পর সে বগুড়ার শাজাহানপুরের বিহিগ্রাম এডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ২০১৩ সালে দাখিল পাস করে। পরবর্তীতে এই মাদ্রাসা হতে ২০১৫ সালে আলিম পাস করে। হলি আর্টিজান হামলার জঙ্গি খায়রুল ইসলাম পায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহচর ছিল। উল্লেখ্য, খায়রুল হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ৫ জন জঙ্গির মধ্যে একজন। খায়রুল ও হাকিম ৫ম শ্রেণী হতে দাখিল পর্যন্ত বিহিগ্রাম এডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় একই সাথে অধ্যয়ন করেছে। এই খায়রুলের প্ররোচণায় আত্মসমর্পনকারী জঙ্গি আব্দুল হাকিম জঙ্গি কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়। জঙ্গি প্রশিক্ষনের দিক থেকে খায়রুল হাকিমের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ফলে খায়রুল জঙ্গি হামলায় অংগ্রহণ করে অন্যদিকে হাকিম জঙ্গি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। হাকিমকে মিরপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় প্রশিক্ষণের জন্য খায়রুল ঢাকায় নিয়ে আসে সেখানে হাকিমের নিয়মিত ধর্মীয় উগ্রবাদের পুথিগত শিক্ষার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। জঙ্গি সংশিষ্ঠ কাজে খায়রুলকে সে আর্থিক ভাবে সাহায্য করছে। ঐ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নিয়মকানুন সম্পর্কে হাকিম জানায় যে, তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল জানালা দিয়ে বাহিরে কোন কাগজ ফেলবে না, জানালার কাছে কখনও কেহ দড়াবেন না এবং দরজা নক করলে কেহ খুলবেন না, নির্দিষ্ট ব্যাক্তিরা দরজা খুলে দিবে। তাদের প্রশিক্ষকদের রুমে প্রবেশ করা নিষেধ ছিল। কিন্তু হাকিম কৌশলে কোন একদিন প্রশিক্ষকদের রুমে উকি দিয়ে দেখে যে, সেখানে রানা নামে একজন সহ আরো ৮/৯ জঙ্গি অবস্থান করছে। সেখানে রয়েছে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ফটোমেশিন ও নানা প্রকারের বই এবং নানাবিধ কেমিক্যাল ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি ছিল। প্রত্যেকদিন তিন বেলায় তিনজন প্রশিক্ষক বিভিন্ন দোয়া দরুদ শিখানো সহ ইসলামের বিভিন্ন জিহাদ ও যুদ্ধের ব্যাপারে ক্লাশ নিতো। তার প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে হলি আর্টিজান শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা হয়। সেই সময়কার হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের হামলা নৃশংস ও বিভৎস দৃশ্য সে মেনে নিতে পারেনি। এছাড়া সে সমগ্র দেশে হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া হামলার নেতিবাচক সমালোচনায় অনুশোচনাবোধ করে এবং পাশাপাশি বিভিন্ন মিডিয়াতে ব্যাপক জঙ্গিবাদ বিরোধী এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতায় তখন থেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুগতে থাকে। সে বুঝতে পারে যে, সে ভুল পথে রয়েছে। তখন সে সুযোগ বুঝে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে পলায়ন করে বাড়ি চলে আসে এবং পরিবারের সাথে খোলাখুলি আলাপ করলে পরিবার তাকে আত্মসমর্পর্ণে উৎসাহী করে র্যাবের কাছে নিয়ে আসে।
আরেক জন জঙ্গি হলো মাহমুদুল হাসান বিজয় গাইবান্ধার সাঘাটার একটি গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের সদস্য। তার শিক্ষা জীবনের শুরুতে খ- খ-ভাবে মূলধারা এবং মাদ্রাসা উভয়ে পড়াশোনা করেছিল। সে ২০১১ সালে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পুনরায় মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যায়ন অবস্থায় প্রথমে ছাত্রশিবিরে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে সে মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানির ওয়াজ ও লিখিত বই অধ্যায়ন করে ধর্মীয় উগ্রবাদিতায় আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গিদের সাহচর্যে এসে জেএমবিতে যোগদান করে। সে বোনারপাড়া, মহিমাগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়ায় জেএমবিেেদর বিভিন্ন সভায় যোগদান ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে এবং এছাড়া সে সংগঠনের অস্ত্র ক্রয়ের জন্য ইয়ানত সংগ্রহ করত। প্রশিক্ষণে তাদেরকে ব্রেন ওয়াশ করে বুঝানো হয়েছে যে, এই জিহাদের মাধ্যমে সরাসরি জান্নাত লাভ করা সম্ভব। প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে শিয়া মুসলিম, খ্রিস্টান নাগরিক ও হিন্দু পুরোহিতকে টার্গেট করে হত্যা বা সহযোগিতা করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। তাকে ‘থ্রিমা’ ও ‘ভিপিএন’ এ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য উত্তীর্ণ হয়েছে। তাকে অস্ত্র প্রশিক্ষণে যোগদানের জন্য ১০,০০০/- টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল। ইতিমধ্যে তাকে কয়েকবার প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। কিন্তু কখনও পরীক্ষা, অর্থাভাব ও পারিবারিক কারণে আসতে পারে নাই। সমগ্র দেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী নেতিবাচক প্রচারণা ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন আত্মসমর্পণ আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে আত্মগোপন কোনো সমাধান নয়। এক পর্যায়ে তার কৃতকর্মের বিষয়টি পরিবারকে অবগত করলে পরিবার তাকে র্যাবের কাছে নিয়ে আসে। শেষ হয় দুই জঙ্গির অন্ধকার জীবনের কালো অধ্যায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।