Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাওলানা উবায়দুল হক : একজন সাহসী আলেমের প্রতিকৃতি

নিবন্ধ

প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এসএম সাখাওয়াত হুসাইন : ৬ অক্টোবর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা উবায়দুল হকের (রহ.) ৯ম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৭ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দূরে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম. বারঠাকুরিতে ১৩৩৫ বাংলার ১৪ বৈশাখ মোতাবেক ১৯২৮ সালের ২ মে শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন।
দারুল উলূম দেওবন্দে পড়াশুনার শেষ বছর ঢাকাস্থ বড় কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফূল উলূম মাদ্রাসার মুহতামিম হজরত মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজী হুজুর (র.)-এর আগ্রহে এবং দারুল উলূম দেওবন্দের সম্মানিত শিক্ষকদের পরামর্শে খতিব সাহেব বড় কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই মাদ্রাসায় তিনি তিন বছর শিক্ষকতা করেন। পরে হজরত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী ও মাওলানা এযায আলীসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে দেখা করার জন্য তিনি দেওবন্দ চলে যান। মাওলানা এযায আলী (র.) তাঁকে উত্তর প্রদেশস্থ শাহজাহানপুরের এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতার জন্য পাঠিয়ে দেন। সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর মাওলানা এযায আলী তাঁকে নিয়ে আসেন এবং পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত হজরত মুফতী শফী (র.)-এর দারুল উলূম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার জন্য পাঠিয়ে দেন। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.)-এর খলীফা এবং পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির শীর্ষ নেতা হজরত মাওলানা আতহার আলী (র.) ও মুফতী শফী (র.)-এর অনুমতিক্রমে মাওলানা উবায়দুল হককে ঢাকায় নিয়ে এসে নেজামে ইসলাম পার্টির রচনা ও প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্ব দেন। অল্পদিন পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে সকল রাজনৈতিক দল বেআইনি ঘোষণা দিয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধকরে দেয়। যার ফলে নেজামে ইসলাম পার্টির সকল তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে এই সময় মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকায় সিনিয়র শিক্ষকের একটি পদ শূন্য হলে মাওলানা উবায়দুল হককে এ পদে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৪৫ সালে তিনি তাঁর শিক্ষক হজরত মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর অনুমতিক্রমে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকায় যোগ দেন। মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকায় তিনি ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হাদিস বিভাগের লেকচারার, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তাফসির বিভাগে সহকারী মওলানা, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এডিশনাল হেড মাওলানা এবং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯৮৫ সালের ২ মে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর ফরিদাবাদ এমদাদুল উলূম মাদ্রাসায়, ১৯৮৬ এবং ’৮৭ সাল এই দুই বছর চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায়, এবং ১৯৮৭ সাল থেকে সিলেট কাসিমূল উলূম দরগাহে হজরত শাহ জালাল (র.) মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিসের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া ১৯৮৫ সাল থেকে কয়েক বছর তিনি ঢাকার ইসলামপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসায় মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি ঢাকা আজিম পুরের ফয়জুল উলূম মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও মুহতামিমের দায়িত্বে ছিলেন। জামেয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ এবং কুমিল্লা কাসিমুল উলূম মাদ্রাসার মজলিসে শুরার সভাপতি, সিলেট জামিয়া সিদ্দিকিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান, মঈনুল উলূম হাট হাজারী, পটিয়া মাদ্রাসা এবং সিলেট জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদ্রাসাসহ আরো অনেক ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানার দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৭ সালের ৬ অক্টোবর আমৃত্যু এই দায়িত্বে ছিলেন।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) প্রকাশিত বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-১) তরিখে ইসলাম, দুই খ-, ২) সিরাতে মোস্তফা, মূলগ্রন্থ উর্দু, এটা প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ও চরিত্র নিয়ে রচিত। ৩) তাসহীলুল কাফিয়া এটি আরবি ব্যাকরণের উচ্চতর গ্রন্থ কাফিয়ার উর্দুশরাহ। এটা মূলত মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের জন্য পাঠ-উপযোগী করে লেখা। ৪) আযহারুর আযহার। নূরুল আনওয়ারের দ্বিতীয় অংশের উর্দুশরাহ। এটাও মূলত মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের পাঠ্যবই। ৫) নসরু লফাওয়ায়িদ (শরাহ ও নোট শরহেআক্বায়িদ, উর্দু)। ৬) আস সেক্বায়া। শরহে ওয়াক্বেয়া দ্বিতীয় খ-ের উর্দু অনুবাদ। ৭) শিয়া সুন্নী এখতেলাফ, মূল গ্রন্থ উর্দু, শিয়া-সুন্নি বিরোধ নামে বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। ৮) শরহে শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া। ৯) কুরআন বুঝিবার পথ (বাংলা)। ১০) কুরআনে হাকীম আওরহামারী জিন্দেগী। রেডিও পাকিস্তানে পঠিত উর্দু কথিকা সমগ্র। এটা বাংলা অনুবাদ হয়েছে।
তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯১ সালে ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে একটি সেমিনারে। উপমহাদেশের অন্যতম আলেমে দ্বীন মওলানা আবদুর রহীম (রহ.) জীবন ও কর্মের উপর দুই দিনব্যাপী জাতীয় সেমিনারে তিনি আলোচক হিসেবে এসেছিলেন। সেদিন তাঁর ভরাট কণ্ঠের বক্তব্য শুনেছিলাম। পরবর্তীতে ১৯৯৪ মাদরাসা ছাত্রদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার তালীম ও তারবিয়াত ক্যাম্পে প্রায় ১ ঘণ্টা দারস দিয়েছিলেন। দারসের শুরুতে আমাকে খতমে নবুয়ত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াতটি জানতে চাইলেন আমি বলার পর ধন্যবাদ জানালেন। এরপর থেকে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত বহুবার তাঁর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও একান্তে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ হয়েছে। দেশের চলমান যে কোনো পরিস্থিতিতে খতিব উবায়দুল হকের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি ইসলাম, দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবসময়ই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। জাতীয় মসজিদের খতিব হওয়ার পরেও তিনি সরকারের নানা ধরনের ইসলামবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করতেন কঠোরভাবে। তার কথার মধ্যে কোনো ধরনের ভয়ভীতি বা জড়তা ছিল না। তাকে এ পদ থেকে অপসারণের চেষ্টাও হয়েছে বহুবার তাতেও তিনি দমে যাননি আরও দৃঢ়তার সাথে ইসলামের সঠিক কথা তিনি মুসল্লিদের সামনে তুলে ধরতেন। এছাড়া তিনি এদেশের ইসলামী দলগুলোর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সংকটকালে। আজকের দিনে তার মতো মানুষের খুবই প্রয়োজন ছিল।
লেখক : সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাওলানা উবায়দুল হক : একজন সাহসী আলেমের প্রতিকৃতি
আরও পড়ুন