Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুমিনের সম্মান : প্রকৃতি ও তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

মানুষের সম্মান ও মর্যাদা জন্মগত অধিকার। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে মুমিনের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচাইতে বেশি। একজন মুমিনের মান-মর্যাদা অপর মুমিনের কাছে আমনত স্বরূপ। ঈমানের শর্তসমূহ পরিপূর্ণ ভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি তার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। মুমিনগণ প্রতিটি কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হন। আল্লাহ বলেন, “মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব” (সূরা রূম- ৪৭)। মুমিনগণ যে কোন বিপদ আপদে ধৈর্য্য ধারণ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা, যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। (সূরা আলে ইমরান-১৩৯)। ুবিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় বাইরে নাই। সকল কিছু তারাই মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তায়ালা বলেন, বলুন! হে আল্লাহ তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্যদান কর আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা কর অপমান। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমাতাশীল। ( সূরা আল ইমরান-২৬)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, কেউ সম্মান চাইলে জেনে রাখুক, সমস্ত সম্মান আল্লাহরই জন্য। (সূরা ফাতির-১০)।

মুমিনের সম্মানঃ আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের কে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদাবান করেছেন। যারা ইহকালে ঈমান আনে এবং ঈমানের দাবি অনুসারে জীবন পরিচালনা করে তাদের জন্য পরকালে চিরস্থায়ী জান্নাতের ব্যবস্থা রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা বলে, আমরা যদি মদিনায় প্রত্যাবর্তন করি তবে সেখান থেকে সবলরা (সম্মানীরা) অবশ্যই দুর্বলকে (হীনদেরকে) বহিষ্কার করবে। শক্তি(সম্মান) তো আল্লাহ, তার রাসূল ও মুমিনদেরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা জানেনা। (সূরা মুনাফিকুন-৮)। মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় পাত্র। আখিরাতে তাদেরকে চিরশান্তির স্থান জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্য রয়েছে ফিরদাউস জান্নাত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (সূরা কাহফ: ১০৭-১০৮)। হযরত জায়েদ ইবনে হারাম (রাঃ) ছিলেন মদিনার গ্রাম্য সহাবী। তিনি নবিজীর জন্য গ্রামের জিনিস নিয়ে আসতেন। একদিন তিনি বাজারে আসলে নবিজী (সাঃ) তাকে পেছন থেকে জাফটে ধরেণ। এক পর্যায়ে নবিজী বললেন, আমি এই গোলামকে বিক্রি করব কেউ কিনবে? তখন তিনি নবিজীকে চিনতে পেরে বললেন, হে আল্লাহ রাসূল! আমাকে বেচে আপনি বেশি লাভ করতে পারবেননা। কারণ আমি কালো ও কুৎসিত। তখন নবিজী (সাঃ) বললেন, হে জায়েদ! তুমি সস্তা নও। তুমি ঈমানদার। তোমার প্রতিপালকের কাছে তুমি অনেক মূল্যবান।

মুমিনের সম্মান কা’বা ঘরের চেয়েও বেশিঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল (সাঃ) কা’বা ঘর তাওয়াফ করছিলেন। তিনি (কা’বাকে লক্ষ করে) বলেন, ওহে আল্লাহর ঘর তুমি কতই পবিত্র এবং তোমার সুঘ্রান কতই না মনমাতানো! তুমি কতই না মর্যাদাবান, কত সম্মানের অধিকারী! নিশ্চয়ই সেই সত্তার শপথ যার হাতে মুহাম্মদ(সাঃ) এর প্রাণ! একজন মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তোমার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান, তাদের মাল ও রক্ত। এজন্য আমরা মুমিনদের ব্যাপারে সর্বদা সুধারণা পোষণ করি। (ইবনে মাজাহ,২/১৮৩০)।

মুমিনের সম্মান ফেরেশতার চেয়েও বেশিঃ আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে “আশরাফুল মাখলুকাত” করে সৃষ্টি করেছেন। আদম সন্তানকে তিনি অন্যান্য সৃষ্টি জীবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি। তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি । (সূরা বনী-ইসরাঈল: ৭০)। ফেরেশতা, জ্বীন, মানব ইত্যাদি আল্লাহর সৃষ্টি। জ্বীনজাতির চেয়ে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অনেক বেশি। আদম সনন্তানের মধ্যে যারা পরিপূর্ণ মুমিন ওলি-আউলিয়া তাদের মর্যাদা সাধারণ ফেরেশতার চাইতে শ্রেষ্ঠ । আর নবি রাসূলগন হলেন মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতা তথা হযরত জিবরাইল (আঃ), হযরত মিকাইল (আঃ), হযরত ইসরাফীল (আঃ) ও হযরত আযরাইল (আঃ) এর চাইতেও বেশি মর্যাদাবান। রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন যে, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি মানবজাতিকে দুনিয়া দান করেছেন, তারা পানাহার করে, বস্ত্র পরিধান করে আর আমরা সদাসর্বদা আপনার প্রশংসা করি ও তাসবিহ পাঠ করি। আমরা পানাহার করি না কৌতুকও করি না। তাই মানবজাতিকে যেভাবে দুনিয়া দান করেছেন তেমনিভাবে আমাদেরকে আখিরাত দান করুন। আল্লাহ তায়ালা তাদের উত্তরে বলেন, যাদেরকে আমি কুদরতি হাতে সৃষ্টি করেছি তাদের সমতুল্য এমন কাউকে করবনা যাদেরকে আমি ‘‘কুন”(হও) শব্দ দ্বারা সৃষ্টি করেছি। (আল মুজামুল আউসাত: ৭/৯৯)

সম্মান ও সুখ্যাতি অর্জনের লোভ নিন্দনীয়ঃ ইসলাম সম্মান ও খ্যাতি অর্জনের লোভ করাকে নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। খ্যাতি বা সম্মান অর্জনের প্রচেষ্টা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। অন্তরে নিফাক তৈরি করে। এক পর্যায়ে মানুষ শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। মুমিনের ইবাদত বন্দেগী ধ্বংস করার জন্য এটি শয়তানের অন্যতম একটি ফাঁদ। রাসূল (সাঃ) এর হাদিস অনুসারে কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে শহীদ, আলেম, দাতা বা দানশীল ব্যক্তিকে। যাদের সারা জীবনের ইবাদত রিয়া বা লোক দেখানো হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। (সহীহ মুসলিম, ১৫১৩,১৯০৫)। অপর হাদিসে রয়েছে, হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন দাজ্জালের চেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে আমি তোমাদের জন্য ভয় পায় সে বিষয়টি কি তোমাদের বলব না? আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বলেন, বিষয়টি হলো গোপন শিরক। তা হলো একজন ব্যক্তি সালাতে দাড়াঁবে এরপর যখন দেখবে যে, মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করবে। (মুসনদে আহমদ, ৫/৪২৮,মাজমাউয যাওয়াইদ, ১/১০২)। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে সকলেই নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। তবে দ্বীন প্রচারের জন্য, বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ স্বরূপ অথবা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার জন্য কোন কিছু প্রকাশ করেন তা দোষণীয় নয়। হযরত মুআজ ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, শেষ জামানায় এমন মানুষ আসবে যারা কাজ প্রকাশ করাকে উত্তম এবং গোপন করাকে নিজের শত্রু মনে করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলো, এটি কিভাবে সম্ভব? রাসূল (সাঃ) বলেন, এটা তারা করতে পারবে কারোপ্রতি ভালোবাসার কারণে আর কারোপ্রতি শত্রুতার কারণে। (মুসনাদে আহমদ-২২৪০৫, মেশকাত-৫৩৩০)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি পার্থিবজীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, হয় আমি তাদের দুনিয়াতেই তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দিব এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হলো সে সব লোক আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বিনষ্ট হয়েছে। (সূরা হুদ: ১৫ ও ১৬)।

পদমর্যাদা ও পোশাক মুমিনের সম্মানের মাপকাঠি নয়ঃ পৃথিবীতে মানুষ অনেক সময় বৈষয়িক পদ-পদবী, বেশভূষা দামী পোশাককে সম্মানের মাপকাঠি মনে করে। অথচ এরা আল্লাহর কাছে সম্মানিত নাও হতে পারে। অন্যাদিকে ঝির্ণ পোশাক ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেও আল্লাহর কাছে সম্মানিত হওয়া যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা নিম্নমানের পোশাক পরিধান করেন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের অবস্থান হলো তারা যদি কোনো বিষয়ে কসম করেন, আল্লাহ তায়ালা তার কসম পূরণ করার ব্যবস্থা করেন, অপর বর্ণনাতে রয়েছে তাদেরকে দেখলে মানুষ ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়, বিবাহের প্রস্তাব দিলে ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু আল্লাহর দরবারে তারা মকবুল। (মেশকাত শরিফ- ৫২৩১)

আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব রয়েছে মুমিনদেরঃ মুমিনদের বন্ধুত্ব হলো আল্লাহর সাথে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য অনেক বড় সম্মানের বিষয়। আল্লাহই তাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তায়ালা তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অনন্ধকার থেকে আলোর দিকে। (সূরা বাকারা-২৫৭)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, মানুষদের মধ্যে যারা ইব্রাহীমের অনুসরণ করেছিল তারা, আর এই নবি এবং যারা এ নবির প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠতম। আর আল্লাহ তায়ালা হলেন মুমিদের বন্ধু। (সূরা আলে ইমরান- ৬৮)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, জেনে রেখো আল্লাহ তায়ালা রয়েছেন ঈমানদারদের সাথে। (সূরা আনফাল-১৯)।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ