Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আগ্রাসী রূপে ভাঙন-বন্যা

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মায় একযোগে পানি বৃদ্ধি : ১১ জেলায় আরো অবনতি

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

অতি বৃষ্টির সঙ্গে সব বাঁধ-ব্যারেজ খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত। উজানের ঢলের তোড়ে দেশের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদ-নদীর দুই ক‚ল ছাপিয়ে নদীতীর ভেঙে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে একের পর এক গ্রাম-জনপদ মাঠ-ঘাট ফসল। প্রধান দুই অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা নদ-নদীর পানি একযোগে বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আরো বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে। এরফলে আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে নদীভাঙন ও বন্যা পরিস্থিতি। গতকাল বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মাসহ ছয়টি নদ-নদী ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়।

যমুনা নদের ৯টি পয়েন্টের সবক’টিতেই বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে পানি বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল থেকে ভাটিতে বন্যার্ত ও নদীভাঙন কবলিত লাখো মানুষ পানিবন্দি। তাদের কষ্ট-দুর্ভোগ অবর্ণনীয়। প্রমত্তা নদ-নদী গিলছে বসতভিটা, ফল-ফসলি জমি, ক্ষেত-খামার, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভেঙে ধসে পড়ছে রাস্তাঘাট বাঁধ।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে জানা গেছে, আজ বুধবার উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উত্তর-মধ্যাঞ্চলে জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইল, পাবনা, মধ্য-দক্ষিণে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।
দেশের নদ-নদী পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো জানায়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, ধরলা, ধলেশ^রী, আত্রাই এই ৬টি নদ-নদী ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫১টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫৩টি স্থানে হ্রাস ও ৫টি স্থানে অপরিবর্তিত থাকে।

গত সোমবার ৪৪টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি, ৫৬টি স্থানে হ্রাস, ৯টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ৬টি নদ-নদী ১৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। রোববার ৫০টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫৩টি স্থানে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ১৫টি স্থানে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভ‚ঁইয়া জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ এবং গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খোয়াই ব্যতীত প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদী ভাগ্যক‚ল পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবোর সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, উত্তর জনপদ ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলে অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে রয়েছে। তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া উভয় নদের শাখা-প্রশাখা নদীসমূহে বাড়ছে পানি। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনা নদের ৯টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনেই পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে ফুলছড়িতে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার, সাঘাটায় ১০, বাহাদুরাবাদে ৩৩, সারিয়াকান্দিতে ৪৬, কাজীপুরে ৪৭, সিরাজগঞ্জে ৪৪, পোড়াবাড়ীতে ১১, মথুরায় ১০ এবং আরিচায় ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

ধরলা নদীর পানি হ্রাস পেয়ে কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার ঊর্ধ্বে রয়েছে। গাইবান্ধায় ঘাগট নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মাত্র দুই সেন্টিমিটার নিচে এসে গেছে। উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ধলেশ^রী নদীর পানি কিছুটা বেড়ে টাঙ্গাইল জেলার এলাসিন ঘাটে বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
পদ্মায় এবং উজানে গঙ্গা নদীর পানি আবারো বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গোয়ালন্দে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার এবং সুরেশ^রে ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভাগ্যক‚ল পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ৩ এবং মাওয়ায় ৮ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, বগুড়ায় যমুনায় পানি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ঝুঁকির মুখে বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, ধুনট হয়ে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের বাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়ছে। ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পশ্চিম পার্শ্বে বসবাসকারী হাজার হাজার গ্রামবাসি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রলজি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, গতকাল বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত যমুনায় পানি বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

স্টাফ রিপোর্টার, গাইবান্ধা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, গত সোমবার বিকাল ৩টা থেকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি মঙ্গলবার ৩টা পর্যন্ত ১১ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে নদীর তীরবর্তী নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। অপরদিকে ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এখন বিপদসীমার ২ সে.মি. এবং করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার ২৪ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার ২শ’ ৫০টি চর-দ্বীপচরের নদী সংলগ্ন গ্রামের মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। ৩০টি ইউনিয়নে পানিবন্দি আছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ২৭ সে.মি আর ব্রক্ষপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৩৬ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা, দুধকুমোর, গঙ্গাধরসহ বিভিন্ন নদীর পানি বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শুরু হয়েছে নদী ভাঙন।
ভোলা জেলা সংবাদদাতা জানান, উজানের পানির তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে মেঘনার ভয়াভহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনের নদী ভাঙনে এরই মধ্যে বহু বসতঘর ও দোকানপাট, মাছঘাট, মসজিদসহ প্রায় ৪০০ মিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসক তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন, আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড একসঙ্গে মিলে এই জোড়খাল এলাকার মেঘনা নদীর ভাঙন রোধে কাজ করছি। ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) ডক্টর মিজানুর রহমান জানান, জোড়খাল এলাকাটি হচ্ছে মেঘনা-তেতুঁলিয়া নদীর মোহনা। রাজাপুর এলাকা ভাঙন রোধে ৩৪২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ। কয়েক হাজার হেক্টর জমির আমনসহ অন্যান্য ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাঙন-বন্যা

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১
১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ