পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘আট বছর ধরে এখানে দাঁড়িয়ে একই কথা বলছি। আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। আমি গত বছর বলেছিলাম, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে আমাকেও গুম করে দিন। আমি আজও একই কথা বলছি। আমি এখানে আর আসতে চাই না। আমি শুধু আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই। প্রধানমন্ত্রী আপনি কি আমাদের কান্না শুনতে পাচ্ছেন না, স্বজন হারানোর ব্যথা কি অনুভব করতে পারছেন না?’ গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে কান্না জড়িত কণ্ঠে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন হাফসা ইসলাম নামের এক তরুণী। তিনি নিখোঁজ সাজেদুল ইসলামের মেয়ে। সাজেদুল ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শাহীনবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন।
একই অবস্থায় তিতুমীর কলেজের ফাইন্যান্স বিভাগের ছাত্র আবদুল কাদের মাসুমেও। তিনি নিখোঁজ হওয়ার আট বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবে এখনো তার মা আয়েশা আলী প্রতীক্ষায় আছেন। একমাত্র ছেলে ফিরে আসবেন মায়ের কোলে। মা বলে জড়িয়ে ধরবেন। কিন্তু সেই প্রতীক্ষা যেন আর শেষ হয় না। তবে মাসুমের মায়ের প্রশ্ন এই প্রতীক্ষার অবসান কি কখনোই হবে না, ছেলে কি ফিরবে না? শুধু সাজেদুলে মেয়ে হাফসা ইসলাম ও মাসুমের মা আয়েশা আলী নন, এমন প্রশ্ন গুমের শিকার প্রত্যেক মানুষের স্বজনদের।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর বংশালের ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমানের ছেলের জন্মদিন ছিল। মাহফুজ তার ছেলেকে বিশেষ এই দিনটিতে ফুল এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রæতি রাখতেই তিনি শাহবাগ যান ফুল কিনতে। কিন্তু এরপর আর ঘরে ফেরেননি। পরবর্তীতে তার পরিবার জানতে পারে, সাদা পোশাকে একদল মানুষ তাকে শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে মাহফুজের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেয় মাহফুজের দুই সন্তান ও তাদের মা নিলুফা। এই দিনটিতে গুমের ঘটনার শিকার অসংখ্য ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে তাদের দুঃখের কথাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। একই সঙ্গে তারা এই বিষয়ে রাষ্ট্রের উদাসীনতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতার কথা একে অপরকে জানান। তারা একাত্ম কন্ঠে প্রিয়জনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।
এদিকে, প্রতিবারের মত এবারও জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। গতকাল ‘মায়ের ডাক’ শিরোনামে ওই সভায় নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের একটাই আকুতি। তারা স্বজনদের ফিরে পেতে চান। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া প্রত্যেকের বুকে নিখোঁজ স্বজনের ছবি। কারও বুকে সন্তানের ছবি, কারও বুকে বাবার ছবি, আবার কারও বুকে ভাইয়ের ছবি। সভায় নিজেদের দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন তারা। কারও মা, কারও সন্তান, কারও বোন ঘটনার বর্ণনা দেন। তারা প্রতিটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ করেন।
মাসুমের মা আয়েশা আলী বলেন, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে টিউশনির কথা বলে ঢাকার নাখালপাড়ার বাসা থেকে বের হন ছেলে আবদুল কাদের মাসুম। তখন বয়স ছিল ২৪ বছর। আমার একটাই ছেলে। খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল সে। আশা ছিল প্রশাসনে বড় চাকরি করে দেশের মানুষের সেবা করবে। কোন অপরাধে তাকে গুম করে দেয়া হলো, সেটা আমরা জানি না। আমাদের একটাই অনুরোধ, আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। ছেলে ফিরে আসবে এই প্রতীক্ষায় থাকি প্রতিনিয়ত। ছেলে ফিরে আসে না। এটা যে কত দুঃসহ যন্ত্রণার, এটা বলে বোঝানো সম্ভব না।
২০১৯ সালের জুন মাসে নিখোঁজ হয়েছেন মিরপুর এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বাতেন। তার মেয়ে আনিসা ইসলাম বলেন, বাবাকে ফিরে পেতে আর কত বছর লাগবে জানি না। আদৌ ফিরে পাব কি না, সেটাও বলতে পারছি না। বাবা বেঁচে আছেন কি না, এটাও আমরা বলতে পারছি না। আমি জানতে চাই, আমার বাবা বেঁচে আছেন কি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই অনুরোধ, তিনি যেন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন।
আনিসা বলেন, বাবা যখন নিখোঁজ হন, আমার ছোট ভাই মো. ইনামের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। এখন তার বয়স পাঁচ বছর ছুঁই ছুঁই। সে আমাকে যখন প্রশ্ন করে বাবা কোথায়, আমি নির্বাক হয়ে যাই। চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। যখন বাইরের লোকজন জিজ্ঞাসা করে, তোমার বাবা কী করেন, তিনি কোথায়, তখন আমরা জবাব দিতে পারি না। যদি বলি, বাবা গুম হয়ে গেছেন, তবে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, বাবা বড় অপরাধী না হলে গুম হতেন না। কিন্তু আমরা তো জানি না আমার বাবার কী অপরাধ? অপরাধ করলে তার বিচার হোক, গুম করে জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারেন না। বাবার সন্ধান চাই।
এদিকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসের ওই আলোচনা সভায় নিখোঁজদের পরিবারকে সহমর্মিতা জানাতে এসেছিলেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার তাগিদ দেন। পাশাপাশি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। তাদের মধ্যে ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম প্রমুখ।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। লজ্জা পাই। কারণ এ দেশের জন্য আমারও অবদান আছে। আমরা গুম-খুনের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করিনি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন মারা গেছে তখন আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কাঁদিনি। আমি কেঁদেছি। তিনি আরো বলেন, মানুষ গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে। আমার ধারণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সব বিষয় অবশ্যই জানেন। কারণ তিনি প্রতিদিন ৮টি সংস্থার রিপোর্ট পড়ে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে আসে, গুম কারা করে। এই গুম সরকারি বাহিনী করেছে, সরকার করেছে, এটা বিশ্বাস করার বহু কারণ রয়েছে। যদি গুম, খুন ও বিচারবহির্ভ‚ত হত্যাকান্ড সরকারি বাহিনী না করে থাকে, তাহলে যারা গুম হয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করছেন না কেন কেউ? কেউ তো গুম হয়েছেন ১০-১২ বছর হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, কেন খুঁজে বের করা হচ্ছে না নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায়। কারা জড়িত, তাদের বের করা হচ্ছে না। এমনকি এ ব্যাপারে মামলা করতে গেলে সেটা গ্রহণ করতে চান না। নিজেরা না করে থাকলে মামলা গ্রহণ করার কথা। যখন আপনি নিজে করবেন, তখন মামলা নিতে চাইবেন না।
এদিকে, আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষ্যে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছরে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক, উদ্বেগ আর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট ৬১৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৯৪ জনকে। ফেরত এসেছেন ৫৭ জন। অন্যদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।