পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার (চিলমারী থেকে ফিরে) : ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’ ভাওয়াইয়া স¤্রাট কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের এই গান হৃদয় কাড়েনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের সেই চিলমারীর বন্দর নিয়ে কত লোকগাথা! তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদী বিধৌত ‘চিলমারী’ এক সময় দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। বাসন্তীর নাম কে না জানে? এক সময়ের দুর্গম চিলমারীর অধিকাংশ বসতি চরাঞ্চলে গড়ে উঠলেও আগের সেই ‘মঙ্গা/আকাল’ এখন নেই। সেই চিলমারী যাবো ৩৬ বছর পর। ১৯৭৯ সালে ছেলেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলাম অষ্টমীর মেলায় ‘বানর’ কিনতে। ওই সময় প্রচ- রোদে তপ্ত বালুতে দাঁড়িয়ে মহিষের দই খাওয়ার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। এখনো চোখে ভাসে হিন্দু ধর্মের নবদম্পতিদের হাত ধরাধরি করে ব্রহ্মপুত্রে ডুব দেয়ার দৃশ্য। স্বামী-স্ত্রী হাত ধরে জোড়ায় জোড়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে ডুব দিচ্ছে। কিশোর বয়সে স্বপ্ন দেখতাম আহা! আমিও যদি...।
কুড়িগ্রাম শহর থেকে চিলমারীর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের বন্দর আরো ৫ কিলোমিটার দূরে। নদের পাড় ও চরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের যাপিত জীবন দেখতে কুড়িগ্রাম থেকে রওনা হলাম দুপুরের আগে। বাহন ব্যাটারিচালিত ভ্যান। নিঃশব্দে ধীরগতিতে চলছে ভ্যান। উলিপুর পৌঁছার পর বেঁকে বসলেন ভ্যানচালক। চিলমারী যাবেন না। অগত্যা অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আরেকটি ভ্যানে উঠতে হলো। ৩৬ বছরে উলিপুর-চিলমারীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পথে পথে পাকা বিল্ডিং, ছোট ছোট কারখানা।
আর অধিকাংশ সড়কের দুই পাশে দোকানপাট ও বিভিন্ন স্থাপনা। অথচ এক সময় এই সড়ক ছিল বালুকাময়। বাড়ি বলতে ছিল খড়ের ঘর। চিলমারীতে নেমেই খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি মুক্ত হোটেলে খেতে বসেই বোঝা গেল রাস্তাঘাট পাকা হলেও বালুর যন্ত্রণা থেকে মানুষের মুক্তি মেলেনি।
বালুই মাখামাখি বাদাম ভর্তা-মাছভাত খেয়ে পরিচিত জনের খোঁজে থানাহাট। রাস্তায় দাঁড়িয়েই ছিলেন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে। অতঃপর ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি সুন্দর মসজিদ। জানালেন, থানাহাট ইউনিয়নের এই মসজিদ মোগল আমলে নির্মিত। চিলমারী উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার উত্তরে মোগল স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন এই মসজিদ এত পরিচিতি যে, দশ গ্রামের মানুষের কাছে গ্রামটি ‘মসজিদপাড়া’ হিসেবে পরিচিত। স¤্রাট শাহজাহানের সময় নির্মিত মসজিদটির নির্মাণকালীন সময়ে দেয়ালে নাম লিপিবদ্ধ করা হয় ফার্সি ভাষায়। সংস্কারের সময় ফার্সি শব্দগুলো বালু-সিমেন্টের স্তরের নিচে পড়ে যায়। বর্তমানে মসজিদপাড়া জামে মসজিদ নামে পরিচিত মসজিদটির নান্দনিকতা চোখে পড়ে।
ঘুরতে ঘুরতে চরের বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর ভাঙা-গড়া নিয়েই তাদের যাপিত জীবন। নদী এপাড় ভাঙে তো ওপাড় গড়ে। এতে তারা অভ্যস্ত। তারাও ঠিকানা বদল করেন। আবার চর ভেসে উঠলে নতুন বসতি গড়েন। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদ ও তিস্তা নদীর প্রতি তাদের ভালোবাসার কমতি নেই। আক্কাছ আলীর ভাষায় ‘নদীই জীবন নদীই মরণ’। অনেকেই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বন্যায় নদী পলি ফেলে গেলে জমিতে ভালো ফসল হয়। ধান, পাট, সরিষা, কলাই, বাদাম, তিশি, যব, ভুট্টা, রসুন, পিঁয়াজ এমন কোনো ফসল নেই, যা চরের জমিতে হয় না। সব ফসলই ফলে। তবে সরকারের কাছ থেকে তেমন সুবিধা পান না। আবদুর রহিম নামের এক কৃষক জানান, সরকার আমাদের দিকে তাকায় না। এক সময় এ এলাকায় মহিষের বাথান ছিল। এখন নেই। সরকার যদি ঋণ দিয়ে এ এলাকার কৃষকদের গরুর খামার করার বন্দোবস্ত করত তাহলে দেশের গরুর গোশতের চাহিদা অনেকাংশে আমরাই মেটাতে পারতাম। কিন্তু কেউ আমাদের দিকে তাকায় না।
প্রান্তিক মানুষের জন্য ১০ টাকা মূল্যে চাল বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন। তার আগমন উপলক্ষে এখনো চিলমারীর হাটে- বাজারে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রী গত সাপ্তাহে এসে বন্দরের উদ্বোধন করেছেন। ঘুরতে ঘুরতে রমনা স্টেশন। রেললাইনে দাঁড়িয়ে কথা হলো কয়েকজনের সঙ্গে। তারা দেশের রাজনীতির খবর জানতে চান। ঢাকার খবর কী জিজ্ঞেস করেন। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবে কি না জানতে চান। কাশ্মীরে মানুষ কি স্বাধীনতা পাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। আমাদের নেতানেত্রীদের ভারতমুখিতার হেতু কি জানতে চান। আমেরিকার নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন না ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন জানতে চান। হিলারির প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত বলেও মত দেন কয়েকজন। সেখানেই জানা গেল ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত চিলমারী উপজেলায় দু’টি থানা। অধিকাংশ এলাকা নদী বিধৌত নিম্ন প্লাবিত সমভূমি। সাধারণ মানুষের কাছে যা চর নামে পরিচিত। তারা জানান. প্রতি বছর বন্যার সঙ্গে পরিবাহিত পলিমাটি সঞ্চিত হয়ে প্লাবিত সমভূমি গঠিত হয়েছে। ৩টি ইউনিয়ন অষ্টমীরচর, নয়ারহাট ও চিলমারী ব্রহ্মপুত্রের পেটের ভেতরে চরাঞ্চল নিয়ে গঠিত। তিন ইউনিয়নই কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। কেবলমাত্র নৌপথে ওসব অঞ্চলে যাতায়াত করা যায়। তবে থানাহাট, রমনা ও রানীগঞ্জের সাথে সড়কপথে জেলা শহর কুড়িগ্রামের যোগাযোগ রয়েছে। ২২৫ বর্গকিলোমিটার আয়োতনের চিলমারী উপজেলায় মৌজা ৮৫টি, গ্রাম ১১৭টি, লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৯২ জন। চরাঞ্চল হলেও শিক্ষিতের হার পুরুষ ৬০.১১%, মহিলা ৩৯.৮৯%। নদী ভাঙা-গড়ার মধ্যেও কৃষি আবাদযোগ্য জমি ৯ হাজার ৮৩০ হেক্টর। চরের প্রায় অর্ধেক মানুষ মাছ ধরে বিক্রি করতে অভ্যস্ত হলেও এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষি পরিবার ১৭ হাজার ৭৪৬টি।
ব্রহ্মপুত্র নদের পেটের ভেতরের অষ্টমীরচর ইউনিয়নের বড় চর গ্রাম এখনো ভাঙছে। ইতোমধ্যেই অনেক ধানী জমি নদের পেটে চলে গেছে। নদের গর্ভে চলে গেছে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল এবং মানুষের বাড়িঘর। নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন মাছ তেমন জোটে না। তবে মানুষের মধ্যে অভাব তেমন নেই। ‘মঙ্গা’ শব্দটির সঙ্গে চরের শিশুদের তেমন পরিচয় হয়নি। চরের তরুণ-তরুণী ও যুবতীদের অধিকাংশই ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। তারা নৌকায় রৌমারী হয়ে বাসে ঢাকা যাতায়াত করেন। জেলা শহর কুড়িগ্রামের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মাছ ধরা ও কৃষিকাজ প্রধান জীবিকা হলেও মহিলাদের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা গেল। তরুণ-যুবতী ও নারীদের অধিকাংশই পরিপাটি। দামি কাপড়ের বোরকা পরিহিত তিন নারী নৌকা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে দূরে চলে গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তারা কেউ স্কুলে, কেউ ফ্যামিলি প্লানিংয়ে চাকরি করেন। চরে কয়েকজনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সুবল চন্দ্র দাস নামের এক জেলে। বয়োবৃদ্ধ সুবল মাঝি দাঁড়ালেন এবং নিজেও গল্পে মজে গেলেন। এরই মধ্যে ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সের আকালু জানতে চান, ‘স্যার ঢাকার কতা কন’। ‘কি কইম ঢাকার কতা? মুইওতো রংপুরের মানুষ’। ‘সেই জন্যি তোমরা খালি অম্পুরের কথা কবার নাগচেন’। আকাল বা মঙ্গ নেই এখন। তারপরও আকালের সময় জন্ম নেয়ায় বাবা-মা এ তরুণের নাম রেখেছেন আকালু। ইঞ্জিনচালিত নৌকার চালক আকালু বলে উঠল ‘আজনীতির খবর কন’। রাজনীতির কথা শুনতে না পেয়ে হতাশ আকালু ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই...’ গাইতে গাইতে চলে গেল। বয়োবৃদ্ধ সুবল চন্দ্র দাস হঠাৎ জানতে চাইলেন, স্যার আপনি কি ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ গানের ইতিহাস জানেন?’ ‘না’-সূচক জবাব পেয়ে বললেন, চিলমারী বন্দর নিয়ে আব্বাস উদ্দিনের এই গান তো বিদেশের মানুষও শোনে। এ গানের ইতিহাস নিয়ে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। বলতে শুরু করলেন সুবল চন্দ্র দাস। আব্বাস উদ্দিন কুচবিহারের মানুষ। তার চাচা চিলমারীতে চাকরি করতেন ১৯১৩ সালে। সে সময় আব্বাস উদ্দিন চিলমারী এসে কিছুদিন চাচার কাছে ছিলেন। তখন বন্ধুত্ব হয় সুদেন বাবু ও সুরেশ বাবুর সঙ্গে। ষাটের দশকে আব্বাস উদ্দিন যখন বিখ্যাত শিল্পী। ১৯৬২ সালে বাল্যজীবনের খেলার বন্ধু সুদেন-সুরেশের আমন্ত্রণে চিলমারী গান গাইতে আসেন আব্বাস উদ্দিন। শিল্পীর আসার তারিখ ঠিক হলো। চিলমারীর চলাঞ্চলজুড়ে সাজ সাজ রব। গানের জন্য মঞ্চ তৈরি হলো চিলমারী বাজারে। মহুকুমা শহর কুড়িগ্রাম থেকে চিলমারী ২০ মাইলের পথ। সড়কপথে পরিবহন বলতে ছিল শুধু গরুর গাড়ি। আব্বাস উদ্দিন ও তার এক ভাই রংপুর থেকে কয়লার ইঞ্জিনচালিত রেলগাড়িতে কুড়িগ্রামে পৌঁছান। সেখান থেকে তাদের গরুর গাড়িতে কুড়িগ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শিল্পী ভাইদ্বয়কে নিয়ে গরুর গাড়ি ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। গানের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা দুপুরে। বিখ্যাত শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন চরাঞ্চলের হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা। পথে পায়ে হেঁটে লোক পাঠানো হলো আব্বাস উদ্দিনকে নিয়ে গাড়িয়াল আবদুল গনি কতদূর এসেছেন খোঁজ নিতে। গরুর গাড়ির ছইয়ের নিচে বসে থাকতে থাকতে শিল্পী আব্বাস উদ্দিন ও তার ভাই আবদুল করিম ধৈর্যহারা। গাড়ি টানা অবলা গরুর সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্য ডুবু ডুবু। চলন্ত গাড়ির ছইয়ের নিচে বসেই গাড়িয়ালকে একটু জোরে গাড়ি চালানোর ইঙ্গিত দিয়ে আব্দুল করিম লিখলেন ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’। ছইয়ের নিচে বসেই সুর করলেন আব্বাস উদ্দিন। চিলমারীতে আব্বাস উদ্দিন-আবদুল করিমকে নিয়ে গরুর গাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যায়। হাজার হাজার মানুষ গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন। অতঃপর মঞ্চে উঠলেন আব্বাস উদ্দিন। দরাজ গলায় শুরু করলেন কিছুক্ষণ আগে রচিত ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই...’। দর্শক-শ্রোতারা বিমোহিত। চিলমারী থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের বুক দিয়ে রৌমারী যেতে হবে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়বে বেলা ৩টায়। অতএব সবকিছু পেছনে ফেলে...।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।