বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিশ্বময় নিয়মিত আকার ধারণ করা নতুন কোনো বিষয় নয় । দুনিয়াতে মানব বসতি স্থাপিত হবার পর থেকে মানবজীবনে উত্থান পতনের যে সূচনা হয়েছিল, তাতে কোনো বিরতি ঘটেনি। আদম বা নবীযুগ থেকে আরম্ভ করে শেষ নবী পর্যন্ত তা নানাভাবে অক্ষুন্ন ছিল, পরবর্তীতে এ যাবত আছে এবং থাকবে। অর্থাৎ আম্বিয়াযুগের বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলির কারণে তাদের সমগ্র ও কালের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রধান অভিন্ন সূত্র ছিল তওহীদ বা আল্লাহর একাত্ববাদকে এবং নবী-রসুলগণের আহবানকে অস্বীকার ও অমান্য করে অন্যকিছুর পূজারি হয়েছিল মূলত এ খোদাদ্রোহীদের শায়েস্তা করার জন্যই তখন নানা প্রকারের বিপদাপদ আসতে থাকে।
এগুলোকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক। এসব বিপর্যয়ের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ‘তুফানে নূহ’ যার বিস্তারিত বিবরণ কোরআন শরীফের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান। হজরত নূহ (আ.) সাড়ে নয়শ’ বছর পর্যন্ত তার কওমকে আল্লাহর তওহীদের দিকে আহবান জানাতে থাকেন, কিন্তু এ সুদীর্ঘ সময়-কালের মধ্যে মাত্র ৮০/৮১ জন তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল। এক সময় তিনি অত্যন্ত নিরাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন: এবং নূহ আরয করলো, হে আমার প্রতিপালক, পৃথিবী পৃষ্ঠের উপর কাফেরদের মধ্যে কোনো বসবাসকারী রেখো না। নিশ্চয় যদি তুমি তাদেরকে থাকতে দাও, তবে তারা তোমার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলবে, আর তাদের সন্তান-সন্ততি হলে তারাও হবে পাপী, অকৃতজ্ঞ। (সূরা নূহ, আয়াত:২৬-২৭)
হযরত নূহ (আ.)-এর দোয়া কবুল হয়েছিল, তাঁর কিস্তিতে (নৌকা, নৌযান) আরোহণকারী মুসলমানগণ ব্যতীত সকল কাফের-মুশরেক মহাপ্লাবনে হালাক হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর হযরত নূহ (আ.) হতে নতুন প্রজন্মের সূচনা। এ কারণে হযরত নূহ (আ.)-কে দ্বিতীয় আবুল বাশার অর্থাৎ দ্বিতীয় আদম বলা হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তুফানে নূহ অর্থাৎ এ মহাপ্লাবন ছিল দুনিয়ার বুকে প্রথম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তারই ধারাবাহিকতায় আম্বিয়া যুগের ঘটনাবলি যেগুলো খোদাদ্রোহিতা ও নবীগণকে অমান্য করার করুণ পরিণতি।
কোরআনের ২৭নং সূরা নমল এর ২৪নং আয়াতে সাবর (ইয়েমেন) রানী বিলকিস ও তার কওম সর্ম্পকে বলা হয়েছে যে, তারা সূর্যপূজা (অগ্নিপূজাও) করতো । ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে সূর্যপূজার প্রচলন ছিল দুনিয়ার নানা স্থানে এখনও আছে। সেকালে ইহুদীরা হযরত উজায়র (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র (নাউজুবিল্লাহ) মনে করত এবং তার কওম সূর্যপূজারী ছিল। সূরা তওবার ৩০নং আয়াতে হয়রত উজায়র (আ.) সম্পর্কে উল্লেখ আছে। দুনিয়াতে যার অনুসারীদের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করা হয়ে থাকে।
ইসলাম ধর্মে দিনে তিনটি সময় নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। এসব সময় হচ্ছে সূর্যের উদয়-অস্ত ও ঠিক দুপুর। কেননা এক শ্রেণীর মোশরেক অংশিবাদী এসময়গুলো সূর্যপূজা করত এবং তাদের এ শির্কীরীতির বিরোধিতা করাই ইসলামের উদ্দেশ্য। মানব জীবনের সূচনাকাল থেকে আম্বিয়া যুগের সকল স্তরেই মানুষের খোদাদ্রোহিতা ও পাপাচারের কারণে মানুষকে শিকার হতে হয়েছে নানামুখি ও রকমারি আজাবে এলাহির, যার বিক্ষিপ্ত বিশদ বিবরণ রয়েছে কোরআনের নানাস্থানে।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ দুর্বিপাকের রকমারি ও বিচিত্র রূপের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হযরত মূসা (আ.)-এর সময়ে লক্ষ করা যায়। ফেরাউন যুগের পতন সর্ম্পকে আল্লাহ সূরা ইউনুসে ঘটনাটি এইভাবে বর্ণনা করেছেন: আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। অবশ্যই মানুষের মধ্যেই অনেকে আমার নিদর্শন সর্ম্পকে গাফিল। (আয়াত-৯২)।
জালেম অত্যাচারী ফেরাউন ও তার দলবলকে আশুরা দিবসে সাগরে ডুবিয়ে মারা হয়। বর্তমানে ফেরাউনের লাশ কায়রোর জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের এ শোচনীয় পরিণতির পূর্বে তাদেরকে রকমারি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাকের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছিল। যেমন সূরা আরাফে আল্লাহ বলেন: ১। আমি তো ফেরাউনের অনুসারীগণকে দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা আক্রান্ত করেছি, যাতে তারা অনুধাবন করে। (আয়াত-১৩০)২। অতঃপর আমি তাদেরকে প্লাবন পঙ্গপাল, উকুন, ভেক ও রক্তদ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নির্দশন। কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল। তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়। (আয়াত-১৩০)।
এ আয়াতে বর্ণিত নতুন নতুন এ খোদায়ী আজাবগুলো একসঙ্গে আসেনি, পর পর এসেছে। প্রত্যেক আজাবের মধ্যে বিরতি ছিল। কোনো একটি আজাব শুরু হলে মুসা (আ.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে এ নাফরমান স¤প্রদায় অনুনয়-বিনয়ের সাথে আজাব উঠিয়ে নিতে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে অনুরোধ জানাত এবং মুসা (আ.)-এর দোয়ার ফলে বিপদ কেটে গেলে তারা মুসা (আ.)-এর প্রতি ঈমান আনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিত এবং তাদের অনুরোধে মুসা (আ.) দোয়া করতেন।
আল্লাহ যখন আজাব হতে তাদেরকে রক্ষা করতেন তখন কিছুদিনের মধ্যে তারা আবার অপরাধে লিপ্ত হয়ে যেত। আল্লাহ এ নফরমানদের প্রতি আরেক নতুন আজাব নাজেল করতেন। এভাবে আয়াতে বর্ণিত আজাবগুলো একের পর এক নাজেল হতে থাকে। প্রত্যেক আজাবের মধ্যে এক মাসের বিরতি থাকার বর্ণনাও রয়েছে। সর্বশেষ আজাবটি ছিল ফেরাউনসহ তার বাহিনীকে সাগরে ডুবিয়ে হালাক করা, যা পূর্বেই বলা হয়েছে।
সর্বশেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত যুগে সাবেক আম্বিয়ায়ে কেরামের ন্যায় বড় ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনা না ঘটলেও মেরাজ, শক্কুল কামার চন্দ্র (চাঁদ) দ্বিখন্ডিত হওয়া এবং (হাবসে শাম্স) সূর্যের চলন্ত গতিস্থির হয়ে যাওয়া ইত্যাদি মহাজাগতিক (প্রাকৃতিক) ঘটনালি সর্ম্পকে কাফেরদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন হুজুর (সা.) ওহীর মাধ্যমে। ভবিষ্যতে দুনিয়াতে কেয়ামতের পূর্বাভাস হিসেবে যেসব ঘটনা ঘটবে, হুজুর (সা.) সে সর্ম্পকে অনেকগুলো আলামতের (নিদর্শন) কথা বলেছেন, যা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।