Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ছাই ক্ষতিপূরণ দাবি ব্যবসায়ীদের

বেনাপোল বন্দরে অগ্নিকান্ড

প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পুড়ে যাওয়া শেড থেকে এখনও বের হচ্ছে ধোঁয়া
বেনাপোল অফিস : পুড়ে যাওয়া বেনাপোল স্থলবন্দরের ২৩ নম্বর শেড থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এ শেডের আশপাশে পোড়া গন্ধে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল গলে পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে মালামাল খালাস ও লোড-আনলোডে অসুবিধা দেখা দিয়েছে।
তদন্ত কমিটির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শেডের মধ্যে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলা যাচ্ছে না। যাদের পণ্য পুড়ে গেছে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকরা দ্রুত ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন। এদিকে এই ভয়াবহ অগ্নিকা-ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বন্দর ব্যবহারকারী বৃহওর সংগঠন সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন দাবি করেছেন। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকরা পুড়ে যাওয়া মালের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। অধিকাংশ আমদানিকারকরা বেনাপোলে এসে ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন করে কান্নায় ভেংগে পড়েন। তবে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ এখনও সরানো হয়নি। শেডের ভেতরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পুড়ে যাওয়া থেকে কোন মালামাল রেহাই পেয়েছে কিনা তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা সংশয় করছেন।
অন্যদিকে, প্রতি বছর ভাড়া শতকরা পাঁচ ভাগ বাড়ানো হলেও বেনাপোল বন্দর উন্নয়নে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বন্দরের অব্যবস্থাপনা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা কঠিন। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর থানায় জিডি এন্ট্রি করার জন্য ভিড় জমাতে শুরু করেছে সকাল থেকে ।
অগ্নিকা-ের পর বেনাপোল বন্দরের সহকারী পরিচালক আব্দুল হান্নানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি আগামী দশ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। অপরদিকে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষও একটি কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত কমিশনার ফিরোজ উদ্দিনকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিতে রয়েছেন আরো চার সদস্য। তারা সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবেন। এছাড়া একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
তিনটির মধ্যে স্থলবন্দর ও কাস্টমসের দুটি তদন্ত কমিটি সোমবার সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার সকালে কাজ শুরু করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, বন্দরের ২৩ নম্বর শেডে আগুন নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। শনিবার অনেক রাত পর্যন্ত ওই শেডে আমদানিকৃত কয়েকটি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে পণ্য আনলোড করা হয়। সেখানে কোনো শ্রমিকের ফেলে দেয়া জ্বলন্ত সিগারেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
ওই শেডের ইনচার্জ জানান, শেডের পাশে একটি পোস্ট লাইনে গত ১১ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে। হ্যান্ডলিং শ্রমিকদের সহযোগিতায় সে যাত্রা রক্ষা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর লিখিতভাবে বৈদ্যুতিক লাইন মেরামতের জন্য আবেদন জানানো হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর এ কারণে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, অব্যবস্থাপনা ও চুরির প্রমাণ লুকাতে অগ্নিকা-ের মতো নাশকতামূলক কাজ করা হয়ে থাকে এ বন্দরে। বন্দর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সাত বার এখানে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়। যার কোনো ক্ষতিপূরণ আজও পাননি আমদানিকারকরা। কর্তৃপক্ষ বন্দরে রক্ষিত মালামালের ভাড়াসহ অন্যান্য অর্থ আদায় করলেও পণ্যের বীমা করেন না রহস্যজনক কারণে। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত অগ্নিকা-ে- তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও রিপোর্ট পাওয়া যায় না কখনো।
দেশের সব চেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে ৩৮টি ওয়্যার হাউজ বা শেড আছে। আর ওপেন ইয়ার্ড রয়েছে পাঁচটি। এ সব শেড ও ইয়ার্ডে আমদানি করা ৪৫ হাজার টন পণ্য রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রায় সব সময়ই দ্বিগুণেরও বেশি পণ্য থাকে। প্রতিটি শেডে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয় এসব পণ্য। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো রাখার জায়গায় মাসের পর মাস রাখা হয় বিভিন্ন কোম্পানির ট্রাক চেচিসসহ পরিবহন। যার ফলে পণ্যবাহী ট্রাক রাখা হয় সড়কে। দাহ্য পদার্থের জন্য আলাদা জায়গা থাকার পরও অনেক শেডেই রাখা হয় সেগুলো। বন্দরের অভ্যন্তরে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো ঠিকমতো মেরামত না করায় শর্ট সার্কিটের কারণেও আগুন লেগেছে কয়েকবার। এতো বড় বন্দরে মাত্র দুইজন বাইরের বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিকে মাস্টার রোলে কাজ করানো হচ্ছে। এখানে নেই কোনো বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী। বন্দরের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করে বাইরে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। অন্যদিকে বন্দরের ঐ শেডে বিভিন্ন মালামালের সাথে কেমিকেল জাতীয় পণ্য রাখায় আগুন লেগে এটি আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। তবে এই শেডে কেমিকেল রাখা হয় অবৈধভাবে। কারণ কেমিকেল রাখার জন্য আলাদা শেড থাকলেও সেখানে তা রাখা হয়নি।
২০১৩ সালের ২৩ মার্চ বন্দরের তিন লাখ টাকার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বাইরে পাচারের সময় জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতও করা হয়।
বন্দরের নিজস্ব হাইড্রেন পানি সাপ্লাই ব্যবস্থা থাকলেও অগ্নিকা-ের সময় তা কাজে আসে না। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। বন্দরের ফায়ারম্যানদের তেমন কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। দায়িত্ব পালনেও তাদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে। বন্দরের নিজস্ব পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ছাড়াও কাছেই বেনাপোল ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের একটি ইউনিট রয়েছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনার বাইরে ওই একটি ইউনিটই ভরসা।
বন্দরে একজন সহকারী ফায়ার পরিদর্শকের নেতৃত্বে তিনজন ফায়ারম্যান কাম-হাইড্রেন অপারেটর থাকলেও অগ্নিকা-ের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। রোববারের অগ্নিকা-ের সময় তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। বন্দরের অভ্যন্তরে তাদের সার্বক্ষণিক থাকার কথা থাকলেও ওইদিন তারা কেউ ছিলেন না বলে অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বন্দরের শেড ও ইয়ার্ড থেকে প্রায়ই পণ্য চুরির ঘটনা ঘটছে। চুরির প্রমাণ লুকাতে বন্দরের এক শ্রেণির কর্মচারী অনেক সময় অগ্নিকা-ের মতো নাশকতামূলক কর্মকা- চালায় বলে অনেকের সন্দেহ। সব মিলিয়ে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দরটির নিরাপত্তা একেবারেই ঢিলেঢালা।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘বেনাপোল বন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনায় আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যা ব্যবসায়ী মহলে চরম উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকদের প্রতিনিধিদের কাছে জরুরি চিঠি পাঠিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা হাতে পাওয়ার পর পরই বিষয়টি নিয়ে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) আব্দুল জলিল বলেন, ‘অগ্নিকা-ের কারণ এখনো জানা যায়নি। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই বলা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত ওই শেডে ১১৫টি পণ্য চালানের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত এই শেডে আর কী পণ্য আনলোড করা হয়েছে তা নিশ্চিত হতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া আর কোনো পণ্য ছিল কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সব কিছু হাতে পেলে তবেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।’
তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আগে কোনো পোড়া পণ্য ওই শেড থেকে সরানো যাবে না বলে জানান তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ছাই ক্ষতিপূরণ দাবি ব্যবসায়ীদের
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ