Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ভাড়ায় খাটছে বরাদ্দের বাসা

সরকারি চাকরিজীবীদের মাত্র ৮ শতাংশ বাসা ভোগ করছে

প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : রোকেয়া বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। আবাসন পরিদপ্তরের অধীন আজিমপুর সরকারি কলোনীতে ৩/এন (ডি-২) বাসাটি বরাদ্দ পান তিনি। দীর্ঘ ৪ বছর ধরে বাসাটি ভাড়া দিয়ে রাজধানীর অন্যত্র বসবাস করছেন। তারপরও সরকারি বরাদ্দের বাসাটি ছাড়ছেন না তিনি।
খোন্দকার মিজানুর দারাইন আবাসন পরিদপ্তরের অধীন আজিমপুর সরকারি কলোনীতে ২০/এইচ (ডি-২) বাসাটি বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু গত আগস্ট মাস থেকেই তিনি বাসাটি ভাড়া দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে থাকছেন। পুলিশের স্পেশাল শাখায় উপ-পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত এই কর্মকর্তা অন্যত্র থাকলেও সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া বাসাটি ঠিকই দখল করে আছেন।
রোকয়া বেগম বা মিজানুর দারাইনের মতো ভাড়ার লোভে এভাবেই আবাসন পরিদপ্তরের বাসাগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাসা না পেলেও অন্য লোকজন মাসিক ভাড়া দিয়ে বসবাস করছেন। অথচ যাদের বাসা প্রয়োজন তারা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দিনের পর দিন। আবাসন পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষের বাসা রয়েছে। বাকীদের ভাড়া বাসায়ই থাকতে হচ্ছে।
এদিকে দুই যুগ আগের সরকারি একটি সিদ্ধান্তের কারণে আবাসন পরিদফতর নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পরিদপ্তরের প্রয়োজনীয় লোকবল থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ সরকারি বাসা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বরাদ্দ দিচ্ছে। ফলে সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ঘটছে অনিয়মের ঘটনা। আর তদারকি ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক বাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
সূত্র মতে, সরকারি আবাসন পরিদফতরের অধীনে বিভিন্ন টাইপের প্রায় ১২ হাজার বাসা ছিল। ১৯৮২ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে প্রায় ৬ হাজার এ, বি ও সি টাইপ বাসা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে ভাগ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেয়ার জন্য একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে সরকারি আবাসন পরিদফতর ওই তিন শ্রেণির বাসা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাসাগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে বন্টন করে দেয়ার পর সেগুলো থেকে রাজস্ব আদায়, বরাদ্দ, সংরক্ষণ, তদারকি ও রক্ষাণাবেক্ষণে নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। বাসা দেখভাল ও তদারকির জন্য মন্ত্রণালয়গুলোর কোনো লোকবল নেই। তদারকি ও অব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক বাসা বেহাত পড়ে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি বাসা বরাদ্দ দিয়ে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বাসা বরাদ্দ নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। অনেকে আবার ভাড়া দিয়ে নিজ ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন। অনেকে আবার বাসা নিজের সন্তানের নামে করিয়ে নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বাসা বা বাড়ি বরাদ্দ বাতিল সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ, সরকারি অফিস স্থান বরাদ্দ ও সরকারি অফিসের জন্য বে-সরকারী বাড়ি ভাড়ার জন্য ছাড়পত্র প্রদান, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ সংক্রান্ত কাজ, বাসা বা বাড়ির ভাড়া আদায় এবং না-দাবি সনদপত্র জারী সংক্রান্ত কাজ, সরকারি বাসা বাড়ি হতে উদ্ভূত মামলা পরিচালনা, আবাসন বরাদ্দ সংক্রান্ত মন্ত্রাণালয় কর্তৃক প্রণীত নীতিমাল বাস্তবায়ন, কর্তৃপক্ষ অর্পিত অন্যন্য দায়িত্ব পালন করা আবাসন পরিদফতরের অন্যতম কাজ।
সরকারি আবাসন পরিদফতরের পরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাসাগুলো ভাগ করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের সমস্যা হচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক বাসা নিয়ে পরিদফতর অনেক চাপের মধ্যে রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোর অব্যব্যবস্থাপনার কারণে সেগুলো থেকে সরকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেকে বাসা পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
পরিচালক বলেন, কেউ যদি বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যত্র বসবাস করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত স্বাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য সীমাবদ্ধতার কথাও স্বীকার করেন মো. এমদাদুল হক। অনেকে আদালতের মাধ্যমে স্থগিতাদেশ নিয়ে নেয়। যে কারণে অনেক সময় কেউ বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যত্র থাকলেও কিছু করার থাকে না। তবে গত মাসে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে দু’জন আইনজীবি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আশাকরি এখন দ্রুত এইসব সমস্যার সমাধান হবে।
আবাসন পরিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আবাসন পরিদফতরের অধীনে ৬ হাজার ৬৯টি বাসা রয়েছে। যেগুলো তারা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। আর এ-টাইপ ১ হাজার ২৪৮টি, বি-টাইপ ২ হাজার ২৯৩টি, সি-টাইপ ১ হাজার ৩৯টি ও সি-১ টাইপ ১ হাজার ২০২টি বাসা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়ে আসছে। আবাসন পরিদফতরের অধীনে বাংলো শ্রেণির বাসা রয়েছে ৮৬টি, সুপিরিয়র ২০৬টি, এফ-শ্রেণী ২০১টি, ই-শ্রেণী ৭৬০টি, ডি-১ বাসা ১ হাজার ৩০টি, ডি-২ বাসা ২ হাজার ২৪২টি, অস্থায়ী পূর্ণ ভাড়া বাসার সংখ্যা ২৬৬টি, অস্থায়ী নির্ধারিত ভাড়ার ৪৫০টি, বিভিন্ন শ্রেণির সংরক্ষিত পরিত্যাক্ত বাসা রয়েছে ৩৫৪টি এবং একক আসনবিশিষ্ট বাসা রয়েছে ৪৭৪টি।
আবাসন পরিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ, বি ও সি-টাইপের বাসা রয়েছে ৫ হাজার ৭৮২টি। এদের মধ্যে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের অধীনে ৫৫টি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ২৭৬টি, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ৪১টি, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৪৯টি, তথ্যের ১৮৬টি, কৃষির ১০৫টি, মন্ত্রী পরিষদের ৬৮টি, পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়কের ২০টি, বিমান ও পর্যটনের ২৪টি, বাণিজ্যের ৯৪টি, যোগাযোগের ৬৫টি, সংস্কৃতির ৫৬টি, প্রতিরক্ষার ২১০টি, খাদ্য ও দুর্যোগের ১৫৮টি, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ৩৮টি, বন ও পরিবেশের ২৭টি, জনপ্রশাসনের ৪৮৭টি, প্রবাসী কল্যাণের ১২টি, শ্রম ও কর্মসংস্থানের ৩৬টি, অর্থের ১৩৮টি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ৩৮টি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ১৭৪টি, মহাহিসাব নিরীক্ষকের ৩১৯টি, মৎস ও প্রাণীর সম্পদের ৫০টি, পররাষ্ট্রের ৪৯টি, স্বাস্থ্যের ৩৮৯টি, স্বরাষ্ট্রের ৩০৮টি, গৃহায়ণের ৮৪৯টি, শিল্পের ৬৫টি, পাট ও বস্ত্রের ৪৬টি, ভূমির ৮২টি, মুক্তিযোদ্ধার ৪টি, স্থানীয় সরকার বিভাগের ৮০টি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ৬২টি, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২৯৮টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষার ১৯১টি, ডাক ও টেলিযোগাযোগের ৩৭টি, বিদ্যুৎ ও জালানির ৪৭টি, বিভাগ ও তথ্যপ্রযুক্তির ২৩টি, নৌপরিবহনের ৩১টি, সমাজকল্যাণের ৪৮টি, পানি সম্পদের ২৩টি, মহিলা ও শিশুর ৩০টি, যুব ও ক্রীড়ার ৩৯টি, সরকারী কর্মকমিশনের ১৮টি, দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০টি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ১৯টি বাসা রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাড়ায় খাটছে বরাদ্দের বাসা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ