ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোহাম্মদ আবু নোমান
সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশবের নিশ্চয়তা সব শিশুর জন্মগত অধিকার। পথশিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি বছর পালিত হয় পথশিশু দিবস। পথশিশুর অধিকার আজ নিছক কথার কথা। খোদ রাজধানী ঢাকায় রয়েছে অসংখ্য-অগণিত অসহায় পথশিশু। একসময় এদের ‘পথকলি’ নামে আখ্যায়িত করে স্বাভাবিক জীবনস্রোতে ফিরিয়ে নেবার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা বেশিদূর এগোয়নি। ওদের ভাগ্য পথেঘাটেই পড়ে থাকে। কার্টুনশিল্পী রফিকুন নবীর তুলিতে এরা ‘টোকাই’ হিসেবে পরিচিত।
প্রত্যেক শিশুই মা-বাবার হৃদয়ের ফুল এবং মানব উদ্যানের হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য। তাই অন্তরের সত্যিকার মায়ামমতা দিয়ে শিশুদের লালন-পালন করা এবং তাদের আদর্শ জীবন গড়ে দেয়া সবার কর্তব্য। গোলাপের মত সুন্দর, হাসনাহেনার মত সুবাস ছড়ানো নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ আমাদের অতি আদরের হৃদয়ের বাঁধন, নয়নের পুত্তলি সোনামণি তথা শিশু-কিশোরদের অধিকারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ ও রাষ্ট্রের। যে বয়সে একটি শিশুর স্কুলে যাবার কথা সে সময় জঠর জ্বালা নিবারণে স্কুল-মাদ্রাসা ত্যাগ করে অভাবের তাড়নায় কর্মক্ষেত্রে কায়িক শ্রমে যুদ্ধে নেমে পড়েছে অনেকে। শিশুশ্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ যা কেবল পুঁথির ভাষার মতোই আমরা মুখস্থ করেছি, বাস্তবে এর চিত্র ভয়াবহ। মানব জীবনের সূচনালগ্নে একজন মানুষকে শিশু বলা হয়। আমরা প্রত্যেকে এক সময় শিশু ছিলাম। শিশু বলতে আমরা বুঝি বয়স কম থাকার কারণে যাদের দেহ, মন ও মগজ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি।
জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ‘ইউনিসেফ’-এ শিশু অধিকার ও তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিভিন্ন নীতিমালা রয়েছে। জাতিসংঘের ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ঘোষিত এ সকল নীতিমালার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী শিশুদের নিরাপত্তা ও সুস্থ বিকাশ সাধন হয়নি। জাতিসংঘ একদিকে শিশুদের জন্য অধিকার সনদ প্রদান করেছে অপরদিকে জাতিসংঘেরই নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বব্যাপী বিশেষত ফিলিস্তিন, ইরাক, কাশ্মির, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত সৈনিকদের চেয়েও বেশি। শিশুরা অনুভূতিপ্রবণ ও অনুকরণপ্রিয়। শিশুর সামনে যা কিছুই বলা হবে বা করা হবে, এর একটা চিত্র তার মনে অঙ্কিত হয়ে যায়; যা ভবিষ্যতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শিশুদের কোমল ও পবিত্র মনে যদি একবার কোনো খারাপ ধারণা প্রবেশ করে তবে তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে প্রতিফলিত হয়। তাই যে সংসারে মা-বাবা নিজেদের মধ্যে ভালো ব্যবহার করে, ভদ্রভাবে চলে, সুন্দর কথা বলে, সে সংসারের শিশুরাও ভালো হয়।
রাসূল (সা.) বলেছেন‘মাতা-পিতা সন্তানের জন্য যা রেখে যায় বা যা উপহার দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল উপহার হল উত্তম আদব’। শিশুদের আদর-সোহাগ করা সুন্নাত। সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার জন্য এক বিশেষ দান ও পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক।
প্রিয়নবী (সা.) আরো বলেছেন যে ব্যক্তি কোনো পিতৃহীন শিশুকে আশ্রয় দিয়ে নিজের পানাহারের মধ্যে শরিক করে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন তবে সে যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনো অপরাধ না করে যথাÑ আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে অথবা বান্দার হক নষ্ট করে তাহলে ভিন্ন কথা। রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াপরবশ হয়ে কোনো অসহায়-এতিম শিশুর মাথায় হাত বুলাবে আল্লাহ তায়ালা তার হাতে লাগা প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে একটি নেকি দান করবেন, একটি গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি দরজা বুলন্দ করবেন’।
নবীজীর আদরের নাতি হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.) নামাজরত অবস্থায় নবীজীর কাঁধে চড়ে বসতেন। যতক্ষণ তারা ইচ্ছা করে না নামতেন রাসূল (সা.) সেজদা থেকে মাথা তুলতেন না। জনৈক সাহাবি তাদের এহেন আচরণে নবীজীর নামাজের ব্যাঘাত হয় মনে করে তাদের মৃদু ধমক দিলে নবীজী খুবই অসন্তুষ্ট হন। নবীজি (স:) কন্যাশিশুদের প্রতি অধিক যতœবান হতে নির্দেশ দিয়েছেন। ছেলে সন্তানদের তুলনায় মেয়ে সন্তানদের ভালো খাবার এবং ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
পথশিশুদের সুস্থ বিকাশের জন্য অভিভাবক, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। সুস্থ ও মর্যাদাপূর্ণ নাগরিক হিসেবে পেতে হলে পথশিশুদের- ধর্মীয়, শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক ও আদর্শিক বিকাশ জরুরি। ছিন্নমূল শিশুরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে অনাদরে-অবহেলায় মানুষ হচ্ছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
শিশুশ্রম নিয়ে আইন থাকলেও কার্যকরের বেলায় উদাসীনতা দেখা যায়। আমাদের সংবিধানে প্রত্যেকটি মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ ব্যস্ত আছেন নিজের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার নিমিত্তে। শুধু তাদের মৌলিক চাহিদা বললে বড্ড ভুল হবে, বলা উচিত তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে চাহিদা থেকে বঞ্চিত না হন সে লক্ষ্যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। আর যাদের মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার কথা তারা থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত।
প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে একটা দিবস ঠিকই পালন হয়ে যায়। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। শিশুশ্রমে বাধ্য করা মহলটি। কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না সেই মহলের শাস্তি। পরিপূর্ণ সুবিধা পথশিশুদের দিতে পারলে তারা দেশের বোঝা হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠতে পারে আমাদের দেশের সম্পদ। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও বেঁচে থাকার নির্মম প্রয়োজনে বিপুলসংখ্যক শিশু কুলি, হকার, রিক্সাশ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক, ক্ষুদ্র কারখানা, ওয়ার্কশপ, খাবারের দোকান, বাস-স্কুটার, গৃহস্থালীর কর্মী। তীব্র শীতের মধ্যেও তাদের গরম কাপড় ছাড়া দেখা যায় যা অমানবিক ও দুঃখজনক। তাছাড়া অভাবের তাড়নায় বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে শিশুরা। এতে ওদের শারীরিক ও মস্তিষ্ক গঠনে বাধা সৃষ্টিসহ ওদের জীবনে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এসব শিশুরা, অনেক সময় পঙ্গুত্বও বরণ করাসহ জীবনী শক্তি ক্ষয়ে অনেক শিশু মারাও যাচ্ছে।
জন্মের পর থেকেই যারা জীবন যুদ্ধের সাথে পরিচিত। রোদ-বৃষ্টি, গরম-শীত যাদের কাছে সমান। পরনে কাপড় আছে কি নেই তা তাদের কাছে মুখ্য নয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মায়ের হাতের মজাদার খাবার দিয়ে নাস্তা করার পরিবর্তে তারা মানুষের বকুনি খায়। যখন নগরীর শিশুরা পাঠশালায় জ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত তখন এরা নিজদের ক্ষুন্নিবৃত্তির অনুসন্ধানে লিপ্ত। ছিন্নবস্ত্র পরিহিত বা বস্ত্রহীন এরাই পথশিশু নামে সর্বত্র পরিচিত। এদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
চিকিৎসা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুরা সাধারণত চর্ম, ডায়রিয়া, ঠা-া জ্বর, জন্ডিসের মত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। দারিদ্র্য, সংসার ভেঙ্গে যাওয়া, বাড়ি পালানো, যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্ন কারণে শিশুরা পথশিশু হয়ে ওঠে। এরা রেল ও বাস স্টেশন, পার্ক, খোলা আকাশের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় জীবনযাপন করে। রাজধানী মতিঝিল, গুলশান, বনানী, কলাবাগান সহ বিভিন্ন স্থানের ফুটপাত ওভারব্রিজ, সদরঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডসহ কমপক্ষে ১০০টিরও বেশি জায়গায় এসব পথশিশুদের দেখা যায়।
পথশিশুরা বড় অসহায়। ঠিকমতো খেতে পারে না, ঘুমুতে পারে না, পরতে পারে না, ভালো কোনো পোশাক পায় না। ওরা কারও না কারও সন্তান, ভাই বা আত্মীয়-স্বজন। সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়ার কারণে পথশিশুদেরও রয়েছে ন্যায্য অধিকার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এ মৌলিক চাহিদাগুলো যথোপযুক্তভাবে পাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। পথশিশুরা তাদের অধিকার পূরণের প্রত্যাশা করে সরকারের কাছে। সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু তাদের অধিকার আর নিশ্চিত হয় না।
শিশুদের অধিকার রক্ষায় প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহানবী (সা.) ইসলামের সুমহান জীবনাদর্শের মধ্যে রেখে গেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা। ইসলামে শিশু-কিশোরদের উপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উৎসাহ দিয়েছে নিরাপদ পরিবেশে জীবনযাপন করার। নবী করিম (সা.) শিশু-কিশোরদের সঙ্গে খেলাচ্ছলেও মিথ্যা বা প্রতারণা করতে নিষেধ করেছেন। শিশুদের ভালোবাসে না এমন মানুষ কম আছে। তাই তো প্রিয়নবী (সা.) শিশুদের কলিজার টুকরা, জান্নাতের প্রজাপতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমার দলভুক্ত নয়।’
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।