দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
হিজরী সনের প্রথম মাস মুর্হারম। মুর্হারমের প্রথম তারিখ হিজরী সনের নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ- পহেলা বৈশাখ, ইংরেজী নববর্ষ ও থার্টি ফাস্ট নাইট খুব ধুমধাম ও মহা আড়ম্বনার সাথেই এদেশে উদ্যাপন করা হয়। কিন্তু হিজরী নববর্ষ কোনো প্রকার ঘনঘটা ছাড়াই আমরা বরণ করে নেই। বরণ করে নেই বল্লে একটু ভুলও হতে পারে; কারণ কোন দিক দিয়ে হিজরী সন শেষ হয়ে নববর্ষ শুরু হয়ে যায় তা হয়তো আমাদের অনেকের খবরও থাকে না। অথচ হজ্ব, রোজা, ঈদ ইত্যাদির মতো গুরুত্বরপূর্ণ ইবাদত আরবী তারিখের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় হিজরী সন,মাস, তারিখ জানা ফরজে কেফায়া । প্রতিটি এলাকার অন্তত কিছু সংখ্যক তা জানতে হবে। অন্যথায় এলাকার সকলেই গুনাহগার হবে। যাই হোক, আমরা বর্ষ বরণ করি আর না করি, খবর রাখি আর না রাখি হিজরী নব বর্ষ কিন্তু শরু হয়েগেছে। আগামী ২০ আগস্ট রোজ শুক্রবার ১০ মুর্হারম। ১০ মুর্হারমকে ইসলামী পরিভাষায় আশুরা বলা হয়। আশুরা বল্লেই আমাদের মনের ফানুসে ভেসে উঠে কারবালার মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ভেসে উঠে কিছু বিপথগামী অর্বাচীন লোকের ‘হায় হাসান! হায় হোসেন!’ বলে রাজপথ প্রকম্পনকারী বিলাপের প্রতিধ্বনি। আমরা আশুরাকে কারবালা বানিয়ে ফেলেছি। অথচ আশুরা মানেই কারবালার ট্র্যাজেডি নয়। বরং এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য অগণিত ঘটনাবলী এবং সংঘটিত হয়েছে আরো অনেক জীবন্ত কাহিনী যা মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে জাগরিত করে ঈমানী চেতনা। এই দিবসে হযরত আদম আঃ ও ইউনুস আঃ এর তওবা কবুল হয়। হযরত নূহ আঃ এর নৌকা জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে। হযরত ইব্রাহীম ও ঈসা আঃ এর শুভ জন্ম হয় এবং হযরত মুসা আঃ বনি ইসরাইলকে সঙ্গ নিয়ে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করেন বলে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত আছে (কানযুল উম্মাল হাদিস নং ২৪২৫৬; মু‘জামে তবরানী কাবীর হাদীস নং ৫৫৩৮)। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। নিজেও কন্টিনিউ এই আশুরার রোজা রেখেছেন এবং অপরকেও রোজা রাখার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। হুজুর স. এর সময় তো কারবালার ঘটনা ঘটেইনি। কারবালার ঘটনা ঘটেছে হুজুর স. এর ইন্তেকালে অন্তত ৫০ বছর পরে। তাহলে আশুরার তাৎপর্য কারবালা কেন্দ্রীক হয় কিভাবে? তবে হ্যাঁ, কাল পরিক্রমায় এই ঐতিহাসিক দিনেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নবী স. এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন রা. এর শাহাদাতের মর্মš‘দ ঘটনা ঘটিয়ে তাঁর শাহাদাতকে চির স্মরণীয় করে রেখেছেন বিশ্ববাসীর নিকটে। একই দিনে ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা ঘটতে পারে। তাই বলে সব ঘটনাকে সবাই একইভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, তা নয়। যেমন- ১৫ আগস্ট বাংলার ইতিহাসে এক নারকীয় ঘটনা সংগঠিত হওয়ায় এই দিবসটি আমাদের দেশে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হয়। অপর দিকে এই দিবসে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ বেনিয়াদের দুঃশাসনের কবল থেকে ভারত মুক্ত হয়েছিলো বলে ভারতে এ দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা দিবস ও আনন্দ-উল্লাসের দিবস হিসাবে পালিত হয়। ১৫ আগস্ট ভারতের লোকেরা আনন্দ উল্লাস করে বলে আমাদের বাংলাদেশের নাগরিকদেরও আনন্দ উল্লাস করা শুধু অনুচিৎই হবে না; বরং সংবিধান লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধীও হতে হবে বটে। সুতরাং ১৫ আগস্টকে ভারত ও বাংলাদেশ একই ভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না বা পারবে না। প্রত্যেক দেশের নাগরিককে তার স্ব স্ব দেশের আইন, নিয়ম ও সংবিধান অনুযায়ীই এ দিবসটি পালন করতে হবে। ঠিক তেমনি ভাবে ধর্মীয় দৃষ্টকোণ থেকে তাৎপর্য বহন করে এমন কোনো দিবসকে আমরা ইসলাম ধর্মেরে অনুসারী হিসাবে, এক ও অভিন্ন রাসূলের স. এর উম্মত হিসাবে আমাদেরকেও সেভাবেই মূল্যায়ন ও পালন করতে হবে যেভাবে রাসূলে করীম স. করেগেছেন বা করতে বলে গেছেন। এ ব্যাপারে আমরা রাসুলে কারীম স. এর জীবন চরিত ও তাঁর অমীয় বাণীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাই যে, তিনি যখন হিজরত করে মদিনায় গমন করলেন তখন তিনি দেখতে পেলেন যে মদিনার ইয়াহুদিরা আশুরার দিবসে রোজা রেখেছে। হুজুর স. তাদের রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে জিঙ্গাসা করলে প্রত্যুত্তরে তারা বলে, এই মহান দিবসে আল্লাাহ তা‘আলা হযরত মুসা আঃ ও তাঁর কওমকে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার বাহিনীসহ সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ফলে মুসা আঃ আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া স্বরূপ এই দিবসে রোজা রাখতেন। তাঁর উম্মত ও অনুসারী হিসাবে আমরাও প্রতি বসর এই মহান দিবসে রোজা রাখি। তখন হুজুর স. বলেছিলেন, মুসা আঃ এর অনুসরণে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশী যোগ্য। অতপর হুজুর স. এ দিবসে রোজা রাখা শুরু করলেন এবং সাহাবায়েকেরামকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৩৩৯৭, ৪৬৮০ ও ৪৭৩৭; মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৭১৪, মিশকাত শরীফ হাদীস নং ২০৬৭) রমজানের রোজা ফরজ হওয়া পর্যন্ত আশুরার রোজাই ফরজ ছিলো। ২য় হিজরীর শাবান মাসের ১০ তারিখে যখন রমজানের রোজা ফরজ হয় তখন আশুরার রোজার বিধান ফরজ থেকে ঐচ্ছিক সুন্নাতে রূপান্তরিত হয়। যার ইচ্ছা রাখবে, যার ইচ্ছা না রাখবে (সূত্র ফতোয়ায়ে শামী ৭/৩১২; মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৬৯৮ ও ২৬৯৬; আবু দাউদ শরীফ হাদীস নং ২৪৪৪) তবে আশুরার রোজা ঐচ্ছিক সুন্নাত হলেও হুজুর স. কখনো এটা ছাড়তেন না বলে হাদীসে উল্লেখ আছে যেমন হযরত হাফছা রা. বর্ণনা করেন, হুজুর স. চারটি আমল কখনো ছাড়তেন না- ১. আশুরার রোজা ২. জিল হজ্ব মাসের প্রথম ৯ দিনের রোজা ৩. প্রতি মাসের বিশেষ ৩টি রোজা যেটাকে আইয়্যামে বীযের রোজা বলা হয় ৪. ফজরের পূর্বের ২ রাকাত সুন্নাত (নাসাঈ শরীফ হাদীস নং ২৪১৬, মিশকাত শরীফ হাদীস নং ২০৭০)। এছাড়াও হুজুর স. এই আশুরার রোজার উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং এর বিরাট ফজীলতের কথা হাদীসে উল্লেখ করেছেন যথা :- হযরত আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো আল্লাহর প্রিয় মুহাররম মাসের (আশুরার) রোজা আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ{মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৮১২, মিশকাত শরীফ হাদীস নং ২০৩৯}। হযরত কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আর আশুরার দিনের রোজা- আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশা করি যে, তা বিগত এক বছরের গুনাহসমূহ মুছে দিবে (মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৮০৩, মিশকাত শরীফ হাদীস নং ২০৪৪)। তবে হুজুর স. এর ইন্তেকালের আগের বছর সাহাবায়েকেরাম যখন বল্লেন, হে আল্লাহর রাসুল স. আশুরার দিন তো এমন একটা দিন যে দিনকে ইয়াহুদি- নাসারারাও সম্মান করে, তখন রাসুলে কারীম স. বলেছিলেন আগামী বছর যদি আমি বেচে থাকি তাহলে ৯ তারিখে রোজা রাখবো। কিন্তু আগামী বছর আশুরা আসার পূর্বেই হুজুর স.এর ইন্তেকাল হয়েগেল (মুসলিম শরীফ হাদীস নং ২৭২২, আবু দাউদ শরীফ হাদীস নং ২৪৪৭, মিশকাত শরীফ হাদীস নং ২০৪১)। হযরত ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে, তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো এবং এ ক্ষেত্রে ইয়াহুদিদের সাদৃশ্যতা পরিহার করো- এর আগে অথবা পরে আরেকটি রোজা রাখো (কানযুল উম্মাল হাদীস নং ২৪২২১ ও২৪২৩০)। তাই আশুরার দিনের রোজার সাথে ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখে আরো একটা রোজা রাখা উত্তম। আশুরার দিনে আরো একটি আমলের কথা হাদীসে পাওয় যায় আর তা হলো এই দিনে নিজ পরিবার-পরিজনের খাদ্য-খাবারে প্রশস্ততা আনায়ন করা যেমন হযরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারীম স. বলেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবার-পরিজনের খাদ্য-খাবারে প্রশস্ততা আনয়ন করবে আল্লাহ তা‘আলা সারা বৎসর তার রিজিকে প্রশস্ততা দান করবেন। হযরত সুফিয়ান সাওরি রাহ. বলেন, আমরা পরীক্ষা করে এর সত্যতা পেয়েছি। (মিশকাত শরীফ হাদীস নং ১৯২৬ হাদীসটি হাসান লি গাইরিহি তাই আমল যোগ্য পর্যায়ের) আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আশুরার সঠিক তাৎপর্য অনুধাবন ও এর যথার্থ ফজীলত অর্জন করার তওফিক দান করুন আমীন
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুফতি, জামি’আ ছিদ্দীকিয়া, ঈশ্বরদী, পাবনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।