Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বৈদেশিক সাহায্য ও রেমিটেন্সে ভাটা

প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সরকারের বৈদেশিক সাহায্য ও রেমিটেন্সে ভাটা পড়েছে। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির লক্ষ্যমাত্রা ৬০০ কোটি ডলার নির্ধারণ করলেও প্রতিশ্রুতি পায়নি এক-চতুর্থাংশও। এই সময়ে মাত্র ১৪৬ কোটি ৭০ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঋণ হিসেবে ১৩০ কোটি ডলার ও অনুদান হিসেবে ১৫ কোটি ডলার এসেছে। আর তাই চলতি অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল তা পূরণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে আশঙ্কা করছে খোদ ইআরডি। এ অবস্থায় লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমনকি সংসদে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক সহায়তা ছাড়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে একই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত রেমিটেন্সেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি প্রবাসীরা সবমিলিয়ে ৮৬৪ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের একই সময়ে পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭৩ কোটি ডলার। এ হিসাবে এই সাত মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ০৫ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতনের প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্সে।
বৈদেশিক সহায়তা প্রতিশ্রুতি লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৬০০ কোটি ডলার বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ৬ মাসে মিলেছে ১৪৬ কোটি ৭০ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। একই সঙ্গে এই সময়ে অর্থ ছাড়ের গতিও রয়েছে শ্লথ। যেখানে চলতি অর্থ বছরে ৪৩৬ কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য ছাড় পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে পাওয়া গেছে মাত্র ১৬৯ কোটি ডলার অর্থ। আর এ সব কারণে বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্য পূরণে সরকারি কর্মকর্তারা সংশয়ের মধ্যে আছেন।
বৈদিশক সাহায্যের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কারণে সরকার বড় বড় প্রকল্পের বিপরীতে বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি এবং অর্থ ছাড় কোনটিই ঠিকঠাক মত পাচ্ছে না। গত ৬ মাসে ছোট ছোট কিছু প্রকল্পের বিপরীতে সামান্য কিছু অর্থ ছাড় এবং প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
অর্থনীতি সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক কর্মকর্তা বলেন, এ পরিস্থিতির জন্য ইআরডির কর্মকর্তারা নয়, বরং দায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির প্রকল্পে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ কারণে দাতা সংস্থাগুলো সরকারকে অর্থ দিতে ভয় পাচ্ছে। কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়মের খপ্পরে পড়েছে পুরো বৈদেশিক সহায়তার অর্থ।
অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে বিশ্বব্যাংক। তারা ৬৫ কোটি ১৪ লাখ ডলার ছাড় করেছে। এর মধ্যে ৩৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার ঋণ এবং বাকি অর্থ অনুদান। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৪৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) পাঁচ কোটি ২৭ লাখ ডলার এবং জাপানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ২৪ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার, চীন দুই কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার, কোরিয়া দুই কোটি ১৪ লাখ ১০ হাজার ডলার ছাড় করেছে। এ ছাড়া রাশিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ কয়েকটি প্রকল্পে ১২ কোটি ৬৪ লাখ ডলার ছাড় করেছে।
এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্সেও। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ১১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত মাস ডিসেম্বরের চেয়ে ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ কম। আর গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। সংসদে গত সোমবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের বাজেটের বাস্তবায়ন চিত্র তুলে ধরে জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় এক দশমিক ৯৩ শতাংশ কম। গত বছর মোট রেমিটেন্স আহরণ হয়েছে তিন হাজার ৯৩৩ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের এই সময়ে ছিল চার হাজার ১১ দশমিক ১১ কোটি টাকা।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার প্রভাবেই রেমিটেন্সের এই নিম্নগতি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান। তিনি বলেছেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সউদী আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় তেল উত্তোলনকারী প্রধান এই দেশগুলোর অর্থনীতি সঙ্কটের মুখে পড়েছে। এতদিন এই দেশগুলোতে আমাদের প্রবাসীরা ওভারটাইম করে বাড়তি উপার্জন করতেন। সেটা দেশে পাঠাতেন। এখন আর সেই কাজ পাচ্ছেন না তারা। সঙ্কটে পড়ে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে ওই দেশগুলো।
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি আছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে সউদী আরব থেকে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশটি থেকে। মোট রেমিটেন্সের ৬৫ শতাংশই পাঠান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশীরা। এছাড়া রিংগিতের দরপতনের কারণে মালয়েশিয়া থেকেও কম রেমিটেন্স আসছে বলে জানান ছাইদুর রহমান।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের গত ২ জানুয়ারির তথ্য অনুয়ায়ী, প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ২৯ দশমিক ৬৯ ডলারে বিক্রি হয়েছে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তেলের দর কমছে। সম্প্রতি এই দর ২২ দশমিক ৪৮ ডলারেও নেমে এসেছিল। তেলের এই অব্যাহত দরপতনে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে অস্থিরতা। বড় পুঁজিবাজারগুলোকেও দরপতন দেখতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে গত জানুয়ারিতে ১১৫ কোটি ২০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছে। আগের ডিসেম্বরের তুলনায় যা ১৬ কোটি ৬ লাখ ডলার এবং গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯ কোটি ১৩ লাখ ডলার কম। জানুয়ারিতে রেমিটেন্স কমায় অর্থবছরের হিসাবে সাত মাসের হিসাবেও কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা কমে ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কমলেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৭ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের উপরে। এদিয়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বৈদেশিক সাহায্য ও রেমিটেন্সে ভাটা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ