পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব
আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে করহার ১ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে পোশাক খাতের দুই সংগঠন
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা চলমান রাখতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, শুল্ক ও ভ্যাট আহরণ ব্যবস্থার সংস্কার ও যুগোপযোগী করতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের উন্নতি, বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে এডিআর ব্যবস্থার ব্যবহার বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ সুযোগ তৈরি,ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার। করোনা মহামারি পরিস্থিতি ও এলডিসি-উত্তর সময়ের জন্য সহায়ক ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন খুবই জরুরি।
গতকাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব মন্তব্য করেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পমন্ত্রী এম এ মান্নান। এতে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন, বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশ’র প্রধান ড. নাজনীন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ এমএস সিদ্দিকী, রাশেদ মাকসুদ খান, ডিসিসিআইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি এনকেএ মবিন, সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি খাত একযোগে নিরলসভাবে কাজ করছে। অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা একান্ত অপরিহার্য। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অর্থনীতির পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের জনগণের সার্বিক উন্নয়নের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। কর-শুল্কসহ অন্যান্য নীতিতে সংস্কার ও যুগোপযোগীকরণে দেশের বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে সরকার। জনগণকে মহামারি থেকে সুরক্ষা দিতে টিকাদান কার্যক্রম গ্রামীণ পর্যায়ে স¤প্রসারণ করেছে বলেও জানান তিনি।
সাবেক গভর্নর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাত অনুকরণীয় ভ‚মিকা পালন করেছে। জিডিপিতে করের অবদান বৃদ্ধি ও পণ্য রফতানি বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ যথাক্রমে নেপাল ও ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে। এছাড়াওক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তনে মতামত দেন তিনি।
পিআরআই’র চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ের ফলেই আমাদের অর্থনীতি আজ এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তবে বিনিয়োগকারী ও উৎপাদনকারীদের স্বার্থ বিবেচনার পাশাপাশি ভোক্তাদের বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে, যা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়।
তিনি বলেন, টেকসই ম্যাক্রো অর্থনীতি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনা মহামারি সত্তে¡ও আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েনি, যদিও কিছুটা স্থবিরতা দেখা গেছে। রফতানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সঙ্গে এফটিএ, আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিসহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ওপর জোর দিতে হবে। তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও তাদের মতো নীতিমালার পাশাপাশি প্রণোদনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে ৯ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে রফতানি প্রায় ৪-৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
রিজওয়ান রাহমান বলেন, মহামারি কারণে দেশের জিপিডি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার ৩৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ৩৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। এ সময় দারিদ্রের হার ৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছেন প্রায় ২ দশমিক ২৬ মিলিয়ন মানুষ। মহামারির নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্তে¡ও দেশের অর্থনীতি গত ৬ মাসে মোটামুটি সঠিক পথেই পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৬ ও ২০৪১ সালের প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের সরকারি-বেসারকারিখাতকে একযোগে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের আমাদের রফতানি প্রায় ৪-৬ বিলিয়ন ডলার কম হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টিকে আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানোর পাশাপাশি করের হার বৃদ্ধি করতে হলে, দেশের শুল্ক ও ভ্যাট আহরণ ব্যবস্থার সম্প‚র্ণ অটোমেশন খুবই জরুরি। দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতার সূচকে উন্নয়ন, স্থানীয় বেকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উন্নতি, বাণিজ্যবিরোধ নিষ্পত্তিতে এডিআর ব্যবস্থার ব্যবহার বাড়াতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ একান্ত অপরিহার্য। একইসঙ্গে রফতানির বাজার স¤প্রসারণের লক্ষ্যে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ও রফতানি উন্নয়ন ফান্ডের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ার সহজ এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুততর সহিত পিটিএ ও এফটিএ স্বাক্ষরের বিষয়টি ভাবতে হবে। করোনার কারণে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রহমান।
তিনি বলেন, এ খাতের উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা সহায়তা পাওয়া নিশ্চিতকরণ, সহায়ক নীতি সহায়তা প্রদান, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে ঋণ দেয়ার সময়সীমা অন্তত ৩ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, দারিদ্র বিমোচনসহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতে আপডেটেড তথ্যের অপার্যপ্ততার কারণে নীতিমালা প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতা সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মহামারি মোকাবিলায় লকডাউনের ফলে সমাজের অনেক মানুষ নতুন দারিদ্র সীমায় চলে আসতে পারে, তা মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে প্রণোদনা প্যাকেজক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নিকট কী করে পৌঁছানো যায় তার প্রতি আরও যত্নবান হওয়ার আহবান জানান তিনি।
বিনায়েক সেন বলেন, কৃষিখাত, ম্যানুফেকচারিং এবং সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিগত বছরগুলোতে উন্নীত করেছে। তবে এলডিসি পরবর্তী সময়ের জন্য দেশের কর ও শুল্ক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানো এবং ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ পর্যালোচনা প্রভৃতি বিষয়সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন বলেন, এলডিসি হতে বাংলাদেশের উত্তরণ আমাদের রফতানির জন্য একটি বড় হুমকি, তবে অতীতে অন্যান্য দেশগুলো বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, রফতানির বহুমুখীকরণ এবং এফটিএ ও অন্যান্য বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা মোকাবিলা করেছে, তবে এজন্য সরকারকে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং এলডিসি গ্রাজুয়েশন মোকাবিলায় আগামী ২-৪ বছর আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। লিকুইডেটে ম্যানেজমেন্ট-এর ক্ষেত্রেক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের বেশি প্রাধান্য দেয়ার পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের আরও অধিক হারে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।