পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সংবাদের শিরোনামগুলো চটকদার। গল্পগুলোও মুখরোচক। গ্রেফতারের পর পলকেই ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলতে থাকে হেট কমেন্ট ও ডিবেট। সমকালিন কঠিন বাস্তবতা ভুলে নেটিজেনরা ব্যস্ত থাকছেন পড়ছেন গ্রেফতারকৃত আসামিদের নিয়ে। দিন-রাত হরদম ব্যস্ত থাকছে টিভি মিডিয়া। অতিমারী করোনায় ক্রমোর্ধ্ব মৃত্যুর ঘটনাও যেন এসবের কাছে তুচ্ছ। সবকিছু ছাপিয়ে আড্ডা, বাসা, অফিসপাড়ায় এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মূখ্য হয়ে উঠছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কাকে ধরেছে। কি কি ‘উদ্ধার’ করা হয়েছে, তার অতীত বর্তমান লাইফস্টাইল কেমন ইত্যাদিতে নিবদ্ধ থাকছে মানুষের কৌতুহল। স্বজনদের নিত্য-মৃত্যুর বিভীষিকা ছাপিয়ে এই আলোচনাই পরিণত হচ্ছে ‘জাতীয় ইস্যু’তে। জাতির চোখ নিবদ্ধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় নিয়ে।
সচেতন মানুষের প্রশ্ন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী হঠাৎ করেই এসব বিষয় নিয়ে তৎপর হয়ে উঠলো কেন? যাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তারা কারা? তারা যদি এতোটাই ‘ঘৃণ্য অপরাধী’ হয়ে থাকবেন তাহলে এতোদিন তাদের ধরা হলো না কেন? কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা কথিত এসব ‘অপরাধ’ সংঘটন করে চলেছেন? তাদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? সামনে এনে তাদের মুখোশ কেন উন্মোচন করা হচ্ছে না? দুর্নীতি, অর্থপাচার, মাদক, স্বাস্থ্য সেবা, কঠোর লকডাউনে মানুষের দুর্ভোগ, আইনশৃঙ্খলার অবণতি ইত্যাদি বিষয়গুলো কি তাহলে চিরতরে বিনাশ হয়ে গেছে? আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা কি আর কোনো কাজ কিংবা ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ খুঁজে পাচ্ছেন না? ইত্যাদি হাজারও প্রশ্ন তুলছেন সমাজ বিশ্লেষক, সচেতন নাগরিক, পেশাজীবীগণ।
ঘটনাপ্রবাহের হিসেবটি চলতিবছর এপ্রিল থেকে ধরা যেতে পারে। ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশান ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট উদ্ধার করা হয় কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ। এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা, এর সঙ্গে একটি শিল্পপরিবারে সদস্যের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা এ বিতর্কে কোনো কোনো মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যম মশগুল থাকে পুরো দুই সপ্তাহ। এ ঘটনায় মামলা হয়। যদিও মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে মৃত মুনিয়ার ভালো-মন্দ নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ চলেছে মাসব্যাপী।
রেশ না কাটতেই ১৭ মে জাতীয় দৈনিক পত্রিকার নারী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে ‘আটক’ করা হলে সৃষ্টি হয় নতুন ইস্যু। তার বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টস’র কয়েকটি ধারায় মামলা দেয়া হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যম সরগরম থাকে দুই সপ্তাহ। ব্যক্তি রোজীনার পেশাগত সাফল্যের ‘কাউন্টার’ দিতে আমলাদের একটি চক্র তার ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা, সহায়-সম্পদ নিয়েও পাল্টা প্রচারণায় লিপ্ত হয়। বিষয়টি সপ্তাহ দুই স্থায়িত্ব পায়।
গত ৮ জুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ‘নতুন আইটেম’ হয়ে ওঠেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। ওইদিন গভীর রাতে সাভার আশুলিয়ার বোটক্লাবে পরীমনি নির্যাতিত হয়েছেন। তাকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে মর্মে মামলা করেন পরীমনি। এ মামলায় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক নাসিরউদ্দিন মাহমুদসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর জের ধরে পরীমনির বিলাসীজীবন, বেহিসেবি জীবনযাত্রা, মান, আয়-উপার্জন,ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র নানারঙে চিত্রিত হয় মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, বাংলাদেশের আর কোনো সমস্যাই নেই।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বশেষ ‘অর্জন’ হলেন ‘হেলেনা জাহাঙ্গীর’। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারদলীয় সংগঠনের একটি উপ-কমিটিতে থেকে নিজে ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামক আরেকটি সংগঠনের নেতা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। মূল দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এ ধরণের কোনো সংগঠন অনুমোদন দেয়নি। অপরাধটি রাজনৈতিক হওয়ায় দল তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। তদুপরি তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় গত ২৯ জুলাই রাতে গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর বাসা থেকে আটক করা হয়। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান-র্যাব চার ঘণ্টা তার বাসায় অভিযান চালায়। ৩০ জুলাই ক্ষুদেবার্তায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করার কথা জানায়। ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্মানহানি করার অপচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। তার বাসায় বিপুল পরিমাণ মাদকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত জিনিসপত্রের মধ্যে হরিণের চামড়া, ওয়াকিটকি, কিছু বৈদেশিক মুদ্রা, চাকু, ক্যাসিনো সামগ্রী এবং ফ্রিজে মদ রয়েছে। ওই সন্ধ্যায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়। এছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনসহ চারটি ধারায়ও মামলা হয়। সর্বশেষ পৃথক ৪ মামলায় ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে হেলেনার।
বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর গুরুতর যেসব অপরাধ করেছেন- সেগুলো চাপা দেয়ার লক্ষ্যেই হালকা-চটুল অভিযোগে মামলা হলো কি না? যদি অপরাধ হয়েই থাকে সেগুলো কি হেলেনা জাহাঙ্গীর শুধু ২৯ জুলাই রাতেই করেছেন? তিনি তো দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় ‘জয়যাত্রা’ নামক আইপি টিভির আড়ালে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, বø্যাকমেইলের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের মতো অপরাধমূলক কর্মকান্ড করছেন। এতোদিন তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলো না কেন? যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও ব্যক্তিগত সহযোগিতায় হেলেনা জাহাঙ্গীর অপরাধমূলক কর্মকান্ড করেছেন তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হয়নি কেন?
গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে চিত্রনায়িকা একাকে। আইনজীবীদের মতে, মামলাটিতে যদি সঠিক ধারার প্রয়োগ না হয় তাহলে আইনের ফাঁকে পাড় পেয়ে যেতে পারেন একা। মাদক সেবন, উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের চটকদার কাহিনী বেরিয়ে আসছে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মৌয়ের। সামাজিক অবক্ষয়ের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত এসব। যা দেখভাল করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৈমিত্তিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার ইশরাত রফিক ঈশিতাকে নিয়ে চলছে জম্পেশ আলোচনা। এই নারী কখনও ডাক্তার, কখনও শিক্ষাবিদ, সামরিক কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা চালিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে যাচ্ছে এসব তরুণীদের কান্ড-কীর্তিতে। এসব দেখা এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৈমিত্তিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু করোনার এই ক্রান্তিকালে জীবনযাত্রার কঠিন বাস্তবতায় আকস্মিক এ ধরণের ঘটনার পেছনে ছোটার কি মাহত্ম্য রয়েছে? এটা কি তাদের বড় অপরাধ চেপে রাখার জন্য?
সচেতন সমাজ প্রশ্ন তুলছেন, এসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিউৎসাহী ব্যক্তিদের পদোন্নতি, প্রাইজপোস্টিংয়ের সুবিধার্থে অ্যাচিভমেন্ট দেখানোর জন্য নয়তো? নাকি সমাজের এলিট পার্সনদের ব্যক্তিগত অপরাধ এবং কুৎসিত অন্ধকার দিকগুলো চাপা দিতে মুনিয়া, হেলেনা, পিয়াসা, একা, ঈশিতাদের সামনে আনা হচ্ছে। বড় অপরাধীদের আড়ালে রাখতেই কি নৈমিত্তিক ঘটনাগুলো ‘বিরাট অপরাধ’ ও ‘গর্হিত অন্যায়’ হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে? মানুষ আসলে সত্যিকার অপরাধের উদঘাটন চায়। আড়ালে রয়ে যাওয়া অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন চায়। ছোট অপরাধে গ্রেফতার দেখিয়ে বড় অপরাধ থেকে পাড় পাইয়ে দেয়ার জন্য গ্রেফতার-রিমান্ড চায় না।
কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যেনতেন একটা অভিযোগ এনে মামলা দায়ের হলে আইনগত দুর্বলতা থেকে যায়। এসব মামলা টেকে না। উপরন্তু মামলা তদন্তের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যস্ত থাকতে হয়। আদালতে মামলা জট বাড়ে। এতে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা হয় না। এমন মন্তব্য করেছেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, এখন একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে, টেলিভিশনে যারা টক শো করেন তাদের কিছু একটা বের হলেই মুহূর্তে তিনি হিরো থেকে ভিলেন হয়ে যান। সাহেদ, সাবরিনা, হেলেনারাই এর প্রমাণ। ধরা পড়ার আগে তাদের অপরাধ কোথায় ছিলো? কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন? তিনি বলেন, যারা সাবরিনা, সাহেদ, হেলেনাদের তৈরি করেন তাদেরকে ধরা প্রয়োজন। চাকু, হরিণের চামড়া, ক্যাসিনো-বিয়ার উদ্ধার দিয়ে নয়-বরং তারা গুরুতর কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিনা সেটি দিয়ে ধরা হোক। যার যে অপরাধ সেই অপরাধ দিয়েই তাকে গ্রেফতার করা যেতে পারে। অবাস্তব অভিযোগে গ্রেফতার করা হলে আইনের শাসন খেলো হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নাগরিকের আস্থা হারায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।