পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ইনকিলাব ডেস্ক : আযানের জোরালো আওয়াজ মাদরাসার উঁচু দেয়াল পেড়িয়ে চারপাশ ঘিরে থাকা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, ছাত্রদের আবাসস্থল থেকে বেগুনি রঙের টুপি মাথায় কয়েক ডজন ছাত্র রওনা হয় মসজিদের দিকে। জোহরের নামাজ আদায় করবে তারা। প্রায় এক হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেশম পথ ধরে চীনে আসা মুসলিম বণিকরা নিংজিয়াতে যে নামাজের সূচনা করেছিলেন তার রীতিনীতিতে আজো তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সরকারি ভাবে নাস্তিকতা ঘোষিত দেশের বহু স্থানেই মাদরাসা চালানো ও ১৮ বছরের কম বয়সীদের মসজিদে প্রবেশ করা অপরাধ।
সেখানে চীন সরকারের হাল্কা ছোঁয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বানকিয়াও দাওতাং মাদরাসার প্রধান ইমাম ৩৭ বছর বয়স্ক লিউ জুন বলেন, চীনের অন্যান্য অংশÑ বিশেষ করে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় উইঘুর মুসলিম প্রধান জিনজিয়াং থেকে আসা মুসলমানরা বিশ^াস করতে পারে না যে আসলে আমরা কত স্বাধীন। তারা এখানে এলে আর যেতে চায় না। তিনি বলেন, হুই মুসলমানরা খুবই ভালো অবস্থায় আছে।
চীনে বর্তমানে মুসলমানদের সংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখ। এ সংখ্যা অনেক আরব দেশের জনসংখ্যার চাইতে বেশি। এর প্রায় অর্ধেকেরই বসবাস জিনজিয়াংয়ে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে চীন সরকার দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা সে জন্য শংকিত। অন্যদিকে চীন সরকার সেখানে ইসলামী উগ্রপন্থা বিস্তার লাভ করায় উদ্বিগ্ন।
নিংজিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটি তুলনামূলকভাবে সম্প্রতি প্রশাসনিক কাঠামো লাভ করেছে। হুই মুসলিম সম্প্রদায়ের এটি হল প্রাণকেন্দ্র। জিনজিয়াংয়ের মত অসন্তোষ সেখানে নেই, অন্যদিকে ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব ও মুসলিম আচার-আচরণের প্রতি নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়নি।
নিংজিয়া ও পাশর্^বর্তী হানসু প্রদেশে এমনকি ছোট গ্রামগুলোতেও সুন্দর মসজিদ দেখা যায়, বালক-বালিকারা মাদরাসাগুলোতে কুরআন শরীফ পড়ে, মুয়াজ্জিনেরা মাইকে পাঁচ ওয়াক্ত আযান দেয়। এটা জিনজিয়াংয়ে দেখা যায় না। সেখানে মাইকে আযান দেয়া নিষিদ্ধ।
গানসু প্রদেশে হুই মুসলমানদের শক্ত ঘাঁটি লিনজুয়া ছোট মক্কা নামে পরিচিত। সেখানে প্রতিটি ব্লকেই মসজিদ রয়েছে এবং মেয়েরা কোনো কোনো সময় বোরকা পড়ে চলাফেরা করে। জিনজিয়াংয়ে বোরকা পড়লে তাকে জেলে দেয়া হতে পারে।
৬৭ বছর বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত ট্রাক ড্রাইভার মা হাবিবু বলেন, এখানে নিবিড় মুসলিম জীবন যাপন সহজ। তার ডাক নাম মা যা মোহাম্মদ নামের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত এবং হুইদের মধ্যে ব্যাপক প্রচলিত। এমনকি এখানকার সরকারি কর্মকর্তারাও ধর্মপ্রাণ ও কুরআন শরীফ পাঠ করেন।
চীনের হুই মুসলমানরা রেশম পথ বরাবর বসবাসকারী ও চীনা স্ত্রী বিবাহ করা আরব ও পারস্যের বণিকদের বংশধর। তাদের সংখ্যা এখন ১ কোটি। জিনজিয়াংয়ের মুসলমানরা না পারলেও তারা শুরু থেকেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। জিনজিয়াংয়ের মুসলমানরা একটি তুর্কী উপভাষায় কথা বলে এবং তাদের চেহারায় ইউরেশীয় ছাপ প্রধান। পক্ষান্তরে হুইরা চীনা ভাষায় কথা বলে এবং প্রতিবেশীদের সাথে তাদের দৈহিক সাদৃশ্য রয়েছে। চীনের অধিকাংশ স্থানেই পুরুষদের সাদা টুপি ও নারীদের মাথায় স্কার্ফ পরা তাদের আলাদা করে। অনেক স্থানেই তারা চীনা জীবন যাত্রার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে শুধু মাত্র শূকরের মাংস খাওয়া পরিহার ছাড়া তাদের আর কোনো পার্থক্য নেই।
হুই মুসলিমরা ইসলামের আধুনিক রূপের অনুসারী। তাদের ঐতিহ্য যদিও আন্তঃধর্ম বিবাহ অনুমোদন করে না কিন্তু হুই পুরুষরা প্রায়ই ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বিবাহ করে এবং বলে যে তারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে।
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যের জন্য তারা ভালোভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। লিনজিয়ার মত স্থানগুলোতে মুসলমানরা সহজেই পাসপোর্ট পেতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অর্ধেকই হুই। এর বিপরীতে জিনজিয়াংয়ে প্রায় সকল উর্ধ্বতন পদেই হান চীনারা। উইঘুর তরুণদের বিদেশ যেতে পাসপোর্ট মেলে না। সরকারি কর্মচারীরা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে বা রোজার সময় রোজা রাখলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়।
তবে নিংজিয়া ও গানসুতেও সরকারি সহিষ্ণুতার সীমা আছে। সম্প্রতি তিব্বত মালভূমির পাদদেশে হুই সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকার কয়েকজন ইমাম জানান, অমুসলিমদের ইসলামে ধর্মান্তর নিষিদ্ধ, সে সাথে চীনের বাইরে কোনো মুসলিম সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা যাবে না। মসজিদ নির্মাণের জন্য বাইরে থেকে অর্থ গ্রহণ করা মানে কর্তৃপক্ষকে খেপিয়ে তোলা।
ধর্মীয় নেতারা বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা সম্ভাব্য বিরোধের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। কয়েকজন ইমাম বলেন, পার্টি কর্মকর্তারা সালাফিদের ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
লিনজিয়ার ৩শ’ বছরের পুরনো গ্রেট গংবেই ধর্মীয় স্থানের এক শিক্ষক উইং জিংচেং বলেন, চীনে সালাফি প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা সরকার ও আমাদের উভয়ের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ তারা নিজেদের মতবাদকে সঠিক বলে মনে করে।
তবে কর্তৃপক্ষ বা অন্য জাতি গোষ্ঠির লোকদের সাথে হুইদের সহাবস্থান সবসময়ই ভালো থাকেনি। উনিশ শতকে মুসলমানদের বিদ্রোহ নির্মম ভাবে দমন করা হয়। এ সময় শত শত মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সময়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলাকালে লালবাহিনী ইমামদের উপর অত্যাচার ও তাদের কারাগারে প্রেরণ, মসজিদগুলোকে অপবিত্র করে এবং ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুই ও হানদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটেছে। ২০০৪ সালে হেনান প্রদেশে জাতিগোষ্ঠিগত সংঘর্ষে অনেকে নিহত হয়। ২০১২ সালে নিংজিয়াতে সরকার কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত একটি মসজিদ ভাঙ্গার সময় পুলিশের হামলায় কয়েক ডজন লোক আহত হয়।
সাক্ষাতকারে বহু হুই মুসলিম বলে, স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ধর্মীয় নিয়ম রীতি ও ব্যক্তিগত মর্যাদা বোধ এবং ধুমপান ,মদ ও জুয়া পরিহার তাদেরকে চীনা ভাইদের থেকে পৃথক করেছে।
উঝং-এ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশে পাগড়ি রফতানিকারী টুপি কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপক ৩৫ বছর বয়স্ক মা ইউমিং বলেন, হুইরা আলাদা এলাকায় থাকে, কিন্তু আজকের দিনে অমুসলিমরাও মুসলিমদের এলাকায় আসছে আর তা আমাদের পরিস্কার খাবার ও নৈতিকতা ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে।
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হুই মুসলিমদের বাণিজ্যিক দূত হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রেরণ করছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড-এর জাতীয় উদ্যোগ নয়াসিল্ক রোড বা রেশম সড়কে এ বিষয়টির উপর জোর দেয়া হয়েছে। এ সিল্ক রোড এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের প্রাচীন বাণিজ্য পথ পুনরুজ্জীবিত করবে।
উঝং ও লিনজিয়ার মত এলাকায় চীনা কর্মকর্তারা মুসলিম উৎপন্ন সামগ্রীর বিশেষ শিল্প পার্ক করেছেন যেখানে কমমূল্যে জমি প্রদান ও কর হ্রাস করা হয়েছে। মা’র কোম্পানি ইজিয়া এথনিক ক্লদিং এমনই একটি প্রতিষ্ঠান যা সরকারের অনুকূল নীতির কারণে লাভবান হয়েছে।
কম্পিউটার চালিত একগুচ্ছ এমব্রয়ডারি মেশিনের মাঝে দাঁড়িয়ে মা বলেন, ইজিয়া এথনিক ক্লদিং-এর ৩টি কারখানা এখন বছরে ৫ কোটি হ্রাট তৈরি করছে এবং বিশে^র কম মূল্যের পাগড়ির দু’তৃতীয়াংশ চাহিদাপূরণ করছে।
এ সাফল্য কোম্পানিকে নতুন উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করেছে। তা’হল লিনজিয়াতে মুসলিম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রিয়েল এস্টেট ব্যবসা যাতে ১৯০ একর জমিতে ৬ হাজার এপার্টমেন্ট, ২টি মসজিদ, জাদুঘর ও হালাল খাদ্য প্রদর্শনী কেন্দ্র হবে।
কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মা চুনবু বলেন, আমরা বিশ^কে দেখাতে চাই যে ইসলাম একটি সহিষ্ণু, শান্তিপূর্ণ ধর্ম। এটা খবরে যেমনটি দেখানো হয় সে রকম শুধু বোরকা পরিহিত বা বোমা হামলাকারী লোকদের ধর্ম নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।