পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শেখ জামাল : প্রধান বিচারপতির ‘অবসরে গিয়ে রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থী’ বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বিতর্কের জন্ম দেয়া অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে বিকারগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত ও উন্মাদ হিসেবে অবিহিত করে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সাবেক বিচারপতি এবং প্রখ্যাত আইনজীবীরা। ‘বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে’ বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে সমর্থন করে তারা বলেছেন, হাইকোট প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করা নজিরবিহীন। শুধু তাই নয়, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করা, তাঁকে মানি না বলে হুংকার দেয়া অনভিপ্রেত, অনাকাক্সিক্ষত এবং অবিচারকসুলভ আচরণ। এই ঔদ্ধত্য কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ ধরনের ঘটনা হতাশাগ্রস্ত উন্মাদ ছাড়া কেউ করতে পারে না। আর বিচার বিভাগ কারো একক সম্পদ নয়, যা খুশি করা যাবে। বিচার বিভাগকে ধ্বংস করার এ চক্রান্ত রুখে দিয়ে জনগণের আশ্রয়স্থল দেশের বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গতকাল ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিরাজমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা আরো বলেন, বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা বিনষ্টের অপচেষ্টা চলছে। টক শো করে, দলীয় সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে, সংগঠনের মিছিলের সামনে থেকে বক্তৃতা দিয়ে ‘রায়’ লেখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রয়োজনেই এ অবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করতে হবে। তারা বলেন, রাজাকারা চলে গেছে ৪০-৪২ বছর আগে। এখন যেভাবে চলছি তাতে ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হচ্ছে। বাবার শাস্তি ছেলে ভোগ করবে? ফৌজদারি আইনে একজনের শাস্তি আরেকজন ভোগ করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন মিলনায়তনে এ সভার আয়োজন করা হয়। আলেচনা সভায় প্রধান অতিথির হিসেবে বক্তৃতা করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী। আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য দেন সংবিধান প্রণেতা ও প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, হাইকোর্ট বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী, ড. শাহদীন মালিক, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এসএম খসরুজ্জামান, জাহিদুল বারী প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সুপ্রিম কোর্ট শাখার সভাপতি জগলুল হায়দার আফ্রিক।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিচার বিভাগের সংস্কারে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার গৃহীত পদক্ষেপকে সমর্থন দিতে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সঠিক রাস্তায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। আপনাদের উচিত তাকে সহযোগিতা করা। বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে যাক আমরা চাই না। বিচার বিভাগ সম্পর্কে যখন ভালো কিছু শুনি তখন মনটা ভরে যায়। আপনারা বিচার বিভাগকে বাঁচান। দেশ রক্ষা করুন। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করুন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, পার্লামেন্টে এই বিচারককে স্যাডিস্ট বলা হয়েছে। একজন নেতা সেখানে এই বিচারককে স্যাডিস্ট বলেছেন, তাহলে স্যাডিস্ট বিচারপতিকে তারা আবার আপিল বিভাগে নিলেন কেন? তিনি যে স্যাডিস্ট, আজ তা প্রমাণ হচ্ছে। এই বিচারপতি বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে নানা কথা বলে যাচ্ছেন। যে ভদ্রলোক এটা করছেন তিনি কি ভাবছেন যে, এতে তার সম্মান বাড়বে? বাড়বে না। লোকে তাকে স্যাডিস্টই মনে করবে।
দেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনকৃত নাগরিকত্ব আইন বিষয়ে বলেন, শুনেছি এটি সংসদে পাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ বিষয়ে পত্রিকায় যে সংবাদ দেখেছি, তা খুবই বিপজ্জনক। যে কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারবে সরকার।
রাজাকারদের নাগরিকত্ব বিষয়ে ওই আইনে আছে একজন রাজাকার যদি থাকে তার সম্পদ তার ছেলেমেয়েরা পাবে না। রাজাকারা তো চলে গেছে ৪০-৪২ বছর আগে। আমরা যেভাবে চলছি তাতে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হচ্ছে। বাবার শাস্তি ছেলে ভোগ করবে? ফৌজদারি আইনে একজনের শাস্তি আরেকজন ভোগ করতে পারে না। গণতান্তিক সরকারের এসব থাকার কথা নয়, জনগণের জন্য আইন হওয়ার কথা Ñ এ বিষয়ে দেখা উচিত আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের রায় লেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের সময় নিয়ম ছিল হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকেরা এজলাসে বসে রায় ঘোষণা করবেন, আইনজীবীরা বসে শুনবেন, কোনো কিছু বাদ গেলে তো বলবেন। আর আপিল বিভাগ শুধু আদেশ অংশ ঘোষণা করতেন। পূর্ণাঙ্গ রায় আসবে পরে। তাই আমি করি না যে অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি হবে। তবে অবসরের পর রায় লিখতে হলে কোনোভাবেই আদেশ অংশ পরিবর্তন করা যাবে না। আদেশ অংশ পরিবর্তন করতে হলে রিভিউ করতে হবে।... এটা না করে ছয় মাস বা এক বছর বা দেড় বছর পর যদি কেউ রাতের অন্ধকারে রায়ের আদেশের অংশ পরিবর্তন করে তবে সেটি হবে ফৌজদারি অপরাধ। আমরা তো সেটা করলাম, সেটি ঠিক হয়নি। এ কারণেই প্রধান বিচারপতি বলছেন এটা বেআইনি। অবসর পর রায় লেখা নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, এখন তো শুনি হাইকোর্টে কেউ কেউ প্রকাশ্য আদালতে রায় দেন না, সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন, আগে এটা ছিল না, এখন মাসের পর মাস পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়া হয় না, বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি হয়, জজ সাহেব সম্বন্ধে নানা আলাপ-আলোচনা হয়। তিনি রায় লিখতে পারেন না বলেই প্রকাশ্যে রায় বা আদেশ দেন না। এখন নাকি রুল দেওয়া নিয়ে সিনিয়র জুনিয়র বিতর্ক হয়, সিনিয়র এজলাস থেকে নেমে যান, এটি দুঃখজনক-লজ্জাজনক। এজন্য দায়ী আইনজীবীরা। কারণ আইনজীবীদের দায়িত্ব কাউকে খালাস করে দেওয়া বা কাউকে শাস্তি দেওয়া নয়। তাদের দায়িত্ব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতকে সহায়তা করা।
তিনি আরও বলেন, এখন তো শুনি একেকজনের কাছে এক দেড়শ মামলা রয়েছে রায় লেখার অপেক্ষায়। এটা দুঃখজনক। একেকজনের কাছে এই বিপুল পরিমাণ রায় লেখার অপেক্ষায় থাকার কারণে বিচার বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্টের সর্বনাশ হয়েছে। এ রায় লেখা পড়ে থাকার জন্য দোষ আইনজীবীদের। আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বিচার বিভাগকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু আইনজীবীরা তা করছেন না। আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরও বলেন, আপনারা রাজনীতি করবেন কিন্তু তা আদালতের বাইরে। আদালত অঙ্গনে আপনাদের পরিচয় আপনারা আইনজীবী। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আপনারা কাজ করবেন। জুডিশিয়ারি বাঁচাতে হলে আপনাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতে হবে।
সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট কোন বিশেষ ব্যক্তির নয়, জনগণের। সংবিধানকে সমুন্নত রাখা এবং দেশের ১৬ কোটি জনগণের অধিকার রক্ষার জন্যই এই সুপ্রিম কোর্টেও সৃষ্টি। এই সুপ্রিম কোর্ট ও সংবিধানকে যারা ধ্বংসের চেষ্টা করছেন জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না। আইনজীবীদের উদ্দেশে ড. কামাল বলেন, আমি সারাজীবন দল করেছি, মন্ত্রী হয়েছি, কিন্তু কখনও সুপ্রিম কোর্টে এসে দলীয় পরিচয় দিইনি। আপনারা মন্ত্রিত্ব করেন, কিন্তু দালালি করবেন না। আত্মসম্মান বোধ রেখে যে অর্থ উপার্জন করা যায় সেটাই আইন পেশার বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেন, দলীয় পরিচয় দিয়ে যেসব আইনজীবী কোর্টে ঘুরে বেড়ান, সে রোগে আক্রান্ত না হওয়াই ভাল। বিচারক ও সরকারি কৌঁসুলি হওয়ার জন্য কি দলের দালালি করতে হবে? বিবেক ও চিন্তাশক্তির ওপর নির্ভর করে আইন পেশা পরিচালনা করুন। যদি তা না পারেন তাহলে এ পেশা ছেড়ে দিন। এ পেশায় থেকে জাতির পিতা থেকে শুরু করে অসংখ্য লোককে আইনি সাহায্য দিয়েছি, কখনও প্রতিদান চাইনি। তিনি বলেন, কিছু কিছু জজ যদি কুকর্ম করে থাকে তাদের হাত থেকে বিচার বিভাগ ও সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। ড. কামাল বলেন,অনেক আইনজীবী আছেন যারা কোটি টাকা নিয়ে জামিন এনে দেন তারা আইনজীবী নন, তারা ভাগাড়। প্রয়োজনে আন্দোলন করতে হবে। আইনজীবীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এটা অর্জন করা অবশ্যই সম্ভব।
হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের প্রশ্ন যখন আসবে তখন আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমি বারের সম্পাদক ছিলাম তখন বারের সদস্য ছিল আড়াই হাজার। এরপর ১৫ বছর জজিয়তি করেছি। এখন বারের সদস্য সাড়ে ৬ হাজার। এটা উৎসাহজনক। তিনি বলেন, এই সুপ্রিম কোর্টে আপনারা (আইনজীবী) আছেন, থাকবেন। আপনারাই ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মশাল তুলে ধরবেন। আর এর জন্য শর্ত একটাই আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বিচারপতি নজরুল বলেন, ১৫ বছর যখন হাইকোর্টের বিচারক ছিলাম তখন কেউ কখনও অন্যায় অনুরোধ নিয়ে আমার সামনে আসেননি। কারণ জানেন অনুরোধ করলে উল্টো ফল হবে। হাইকোর্টেও বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে নিমগাছ থেকে ফজলি আম আশা করা বাতুলতা মাত্র। ফজলি গাছ রোপণ করেন তাহলে ফজলি আমই পাবেন। আইনজীবীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন,উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই নীতিমালা করার জন্য আপনাদের সোচ্চার হতে হবে।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় না আর বিরাজমান পরিস্থিতি বিব্রতকর। আইনজীবী ও বিচারকদের ব্যর্থতার কারণে জনগণ বিচারের জন্য বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এদেশে বিচার প্রার্থীদের কথা কেউ বলে না। তাদের দিকে কেউ তাকায় না। একটা দেশে ন্যায়বিচার না থাকলে সমাজ থাকে না। ৭২ এর সংবিধানের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদ হুবহু পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এটি করা না হলে বিচারক নিয়োগের আইন থেকে শুরু করে আমাদের কোন কিছুই অর্জিত হবে না।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বিচারকদের রায় নিয়ে এখন প্রায় প্রত্যেক বিচারপ্রার্থী অভিযোগ করে থাকেন। এই অভিযোগের কিছু বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে। নিম্ন আদালতে পেশকাররা সবচেয়ে শক্তিশালী। তারা সেখানে কোর্ট চালায়। আর উচ্চ আদালতে বেঞ্চ অফিসাররা রাজা। বিচার বিভাগের পরিস্থিতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তাতে অচিরেই বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। বিচারকদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে কারো আত্মীয়, কারো ঘনিষ্ঠজন, কারো পরিবারের সদস্য Ñ এই হলো যোগ্যতা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।