এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরাও
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লিঙ্গ সমতার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি
আলম শামস
বারো বছরের শিশু সুজন। যে বয়সে বাবা-মায়ের আদর আর বই-খাতা নিয়ে স্কুল থাকার কথা সেই বয়সে আজ লেগুনার হেলপার। ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত যাত্রী ডাকা ও ভাড়া তোলা, লেগুনাকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে চালককে সহযোগিতা করাই তার কাজ। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরা রুটে এক বছর ধরে লেগুনায় হেলপারি করছে সুজন। এই রুটে সব লেগুনাতেই তার মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক শিশু কাজ করছে বলে সুজন জানায়। সারাদিন কাজ করে পরদিন বিছানা থেকে ওঠতে পারে না সুজন। সংসারে বাবা নেই মা অসুস্থ। তাই তাকে কাজ করতে হয় সংসার চালানোর জন্য। এ সব কথা জানিয়ে সুজন বলে, ‘কামে না গেলে খামু কী? জীবনের ঝুঁকি আছে অনেক। সারাদিন গেটে ঝুইলা ঝুইলা ডিউটি করি, যে কোন সময় হাত-পা ফসকে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পেছন থেকে গাড়ি চাপাও দিতে পারে। তা জেনেও অভাবের ঘরে কয়টা টাকার লাইগ্যা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেগুনায় কাম করি।’
এসব কথা বলে সুজন আরো বলে, ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করে বড় হবো কিন্তু অভাবের তাড়নায় তা হয়ে ওঠছে না।
এমনি করে যে বয়সে হাতে বই-খাতা, চোখে স্বপ্ন, বুকে দেশগড়ার শপথ, খেলাধুলা, চঞ্চলতা, দুরন্তপনা, মায়ের স্নেহ, বাবার ভালবাসা, পরিবারের সহযোগিতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের মানবাধিকার পাওয়ার কথা। সে বয়সে হাতে চায়ের কেটলি, চোখে ধোঁয়া, বুকে হতাশা, মালিকের অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর সন্ত্রাসী-মাদকসেবীদের হাতছানিতে জড়িয়ে বিপদগামী হচ্ছে বাংলাদেশের অসংখ্য শিশু-কিশোর। এদের পারিবারিক বন্ধন বলতে কিছু নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা তাদের কপালে হয়তো কোনদিন স্পর্শ করে না। জীবন নামের তরীর মাঝি হয়ে ওঠে সুজনের মতো অনেক শিশু। ‘জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ-২০১৩’ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোন না কোন শ্রমে নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত এ জরিপে দেখা যায়, এদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুই বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শুধু তা-ই নয়, ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। এর আগে ২০০২ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে কর্মে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫ লাখ। বিশ্বে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি শিশু নানারকম ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা যায়। জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। এতে বলা হয়েছে, শিশুর বেঁচে থাকা তাদের জন্মগত অধিকার। এরই সাথে শিশুর জন্য নিচের অধিকারগুলোর কথাও মনে রাখতে হবে আমাদের। ক) স্নেহ, ভালবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, খ) পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার অধিকার, গ) অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, ঘ) খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঙ) একটি নাম ও নাগরিকত্ব, চ) পঙ্গু শিশুদের বিশেষ যতœ ও সেবা পাওয়া অধিকার, ছ) দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ ব্যবস্থা পাওয়ার অধিকার, জ) সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ্য অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঝ) শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ঞ) এ সব অধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বের সব শিশুর ভোগের অধিকার থাকবে। বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার সুরক্ষা ও তাদের বিকাশের জন্য রয়েছে নানা আইন। কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশে নানা ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশু অধিকার। সমাজ থেকে শিশু-কিশোরদের যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কথা তা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুনীতিকে পাশ কাটিয়েই শিশুদের ভারী গৃহশ্রমসহ বেআইনি কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। দেশের প্রচলিত আইনে শিল্প কারখানায় শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও জীবিকার প্রয়োজনে শৈশব অবস্থায় অনেক শিশুকে নানা ধরনের শ্রমে নিয়োজিত হতে হচ্ছে। শহর, গ্রাম উভয় অঞ্চলেই শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। সরকারের পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব মতে দেশের মোট শ্রমিকের ১২% শিশু শ্রমিক। এ হিসাবে কেবল মাত্র নিবন্ধনকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিশু শ্রমিকদের ধরা হয়েছে। অনিবন্ধনকৃত বা ননফরমাল সেক্টরে কর্মরত শিশু শ্রমিকদের হিসাব করলে এ সংখ্যা আরো বেশি। শুধু শহরাঞ্চলেই চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মাঝে ১৫ বছরের কম বয়সী যে সকল শিশু শ্রমিক কাজ করছে তাদের সংখ্যা ১৯৯০ সালে প্রায় ২৯ লাখ বলে এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী যখন কোনো শ্রম বা কর্ম পরিবেশ শিশুর দৈহিক, মানসিক, নৈতিক, মনোবিকাশের ক্ষেত্রে বাধা ও ক্ষতিকর হয়ে যায় তখন তা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে।
আমি একদিন রাজধানী ঢাকার এক রেস্টুরেন্টে চা পান করতে গিয়েছিলাম। একটি ছোট্ট ছেলে টেবিলে এসে বলল স্যার কি খাবেন। ছেলেটাকে চা আনার অর্ডার দেই। ছেলেটা চা নিয়ে আসার সময় এক কাস্টমারের সাথে ধাক্কা খেয়ে চায়ের কাপ পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রেস্টুরেন্ট মালিক সেই ছোট্ট কর্মচারীকে মারলেন। তার অপরাধ সে চায়ের কাপ ভেঙে ফেলেছে। এটি শুধু এই রেস্টুরেন্টের দৃশ্য নয়। প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে এরকম অনেক ঘটনা। এই বয়সে যার পড়ালেখার কথা সে চায়ের দোকানে পেটের দায়ে শ্রম বিক্রি করছে। জীবনের কোন মূল্য নেই এই শিশু শ্রমিকদের।
১৯৯১ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের এই শিশু সনদ অধিকারটি কার্যকর হয়। দীর্ঘ ২৫ বছর এই সনদটি বাংলাদেশে অনুশীলন হয়ে আসছে তবুও আমাদের দেশে এখনো শিশুবান্ধব যথাযথ পরিবশে তৈরি হয়নি। ১৯৭৪ সাল হতে অধ্যাবধি অনেক আইন প্রণয়ন হলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োগ হচ্ছে না। শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায় শিশু শ্রমিকের কঠিন ও বিপজ্জনক কাজে শ্রম দিচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, লেগুনা ও বাসে গাড়ির হেলপার, চায়ের দোকানের কর্মচারীসহ নানরকম শিশু শ্রমিকের দেখা যায়। অনেকেই এই ছোট্ট বয়সে গাড়ির ড্রাইভিং করে যা বাংলাদেশের ড্রাইভিং আইন ও শিশুশ্রম আইন পরিপন্থী। অনেকেই আছে যারা পাথর শ্রমিক। যারা সামান্য মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে থাকে। তারা পায় না পড়ালেখা করার সুযোগ। সিলেটের চা বাগানে একই চিত্র অবহেলায় বেড়ে ওঠে তাদের জীবন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা তাদের পরিবারের অর্থ চাহিদা পূরণ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং আইএলও’র জরিপ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে ৪৭ ধরনের। এরমধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করছে শিশুরা। শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৭৩ দশমিক ৫০ শতাংশ পুরুষ শিশু এবং ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ নারী শিশু।
শিশু শ্রমিকের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে এবং ৯৩ দশমিক ৭০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে মোটর ওয়ার্কশপের কাজ, ওয়েল্ডিং, গ্যাস কারখানা, বেলুন কারখানা, লেদ মেশিন, রিকশা চালানো, বিড়ি শ্রমিক, বাস-ট্রাক-টেম্পু-লেগুনার হেলপার, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহশ্রমিক, এমব্রয়ডারি, জাহাজ শিল্প, চিংড়ি হ্যাচারি, শুঁটকি তৈরি, বেডিং স্টোরের শ্রমিক, ইটভাঙা শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, ট্যানারি, যৌনকর্ম, চোরাচালানি, ব্যাটারিসহ রাসায়নিক কারখানা, লবণ কারখানা, ভ্যান চালক, ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রবহন কাজ অন্যতম এবং রং মিস্ত্রিসহ আরো বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক ও ঝঁকিপূর্ণ কাজ। অভাবের তাড়নায় বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে শিশুরা। জ্বলন্ত কয়লা বয়লারের লেলিহান আগুনের শিখা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে শিশুরা।
শিশু চিকিৎসক ডা. জহুরুল হক সাগর বলেন, শিশুকাল হল মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। জীবন গঠন, শিক্ষা গ্রহণ, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সময়ই হলো শিশুকাল। আর তখন যদি শিশুর পক্ষে উপযুক্ত নয় এমন কঠিন, বিপজ্জনক, ঝঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পরে তবে ওদের শারীরিক ও মানসিক গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করতে গিয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। শিশুর কাশি, যক্ষা, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিসসহ হৃদরোগ, নানারকম স্কিন ডিজিজ এবং কিডনির জটিলতা এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। তবে আশার কথা হলো : সরকারও শিশুশ্রম নিরসনে এবং জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এতে করে বর্তমানে জনগণ পূর্বের তুলনায় শিশুশ্রম বন্ধের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। এই সচেতনতা মানুষকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োজিত করা যাবে না। সংশ্লিষ্টদের মতে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাবে শিশুশ্রম নিরসনে কার্যকর কৌশল কর্মপন্থাও যেমন ঠিক করা যাচ্ছে না তেমনি শিশুশ্রম নিরসনে ঘধঃরড়হধষ চষধহ ড়ভ অপঃরড়হ (ঘচঅ) [২০১২-২০১৬]-এর আওতায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের সাফল্য চাপা পড়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের জন্য সরকার, মালিক পক্ষ, শ্রমিক পক্ষ ও সুশীল সমাজের সমন্বয়ে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার একটি গুরুতর ও জটিল সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় এখনই সমন্বিত একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে শিশু অধিকার বিষয়ক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। তাই শিশুশ্রম নিরোসনে প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের যথাযথ হস্তক্ষেপ আর সচেতনতা। এই জনসচেতনতা আর প্রশাসনের যথাযথ আইন ও শ্রম শিশুদের ভবিষ্যৎ গঠনকল্পে বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগই পারে শ্রমিক শিশুদের সোনালী এক প্রভাতের আলো দেখাতে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।