Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাঙন তীব্র, প্রতিরোধে অর্থ নেই

অতিবৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়ছে

প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : দেশের নদ-নদী ভাঙন তীব্র হয়েছে। ভাঙন রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপই নিতে পারছে না পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ঘর-বাড়ী, আবাদি জমি, খেতের ফসল সব হারিয়ে মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ছে। আর সীমান্ত নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত পরিবারের সাথে রাষ্ট্রও ক্ষতির কবলে পড়ছে। দেশের মূল্যবান ভূমির মালিকানা চলে যাচ্ছে ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৩৭২ কোটি টাকা জরুরি বরাদ্দের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরও আরও ৪৩৮ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার পাঠিয়েছেন পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। গত ১৯ সেপ্টেম্বর এই ডিও পাঠানো হলেও গতকাল (রোববার) পর্যন্ত এর কোন জবাব মেলাতো দূরের কথা, উল্টো জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজের জন্য মূল বরাদ্দের ৩৭২ কোটি টাকার অনুমোদনই এখন পর্যন্ত দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যেই সরকারি ও বেসরকারি মিলে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে চলে গেছে।
এদিকে দেশের কোন এলাকায় নদীন পানি হ্রাস পাওয়ায় এবং অনেক এলাকায় বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে নেমে আসা পানির চাপে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে নদ-নদী ভাঙন তীব্র হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, পুনর্ভবা, টাংগন, মহানন্দা, ইছামতি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব নদীর পানি আগামী ২৪ ঘন্টায় আরও বাড়বে বলে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রর তথ্য থেকে জানা গেছে। তবে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে। এসব নদ-নদীতে যেভাবে ভাঙন দেখা দিয়েছে তা ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি কোন কাজ করতে পারছে না। এছাড়াও মনু, মাতামুহুরি, ফেনী, চুঁনকুড়ি, গড়াই ও সন্ধ্যা নদীর ভাঙনও তীব্র হয়েছে।
নদী ভাঙনের এই তীব্রতার বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রীর ডিওতে উল্লেখ করা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একেবারেই নীরব। এতে করে নদী পারের মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে পাউবো’র মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ের গেছে যে, জরুরি কাজের অর্থ না পেয়ে মাঠ প্রশাসনের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্বাহী প্রকৌশলী ইনকিলাবকে বলেন, পাউবো’কে লিখিতভাবে তিনদফা জানিয়েও কোন কাজ হয়নি। বরং নদী ভাঙন তীব্র হওয়ায় স্থানীয় লোকজন মারমুখী হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় শুধু আমি নই, অনেক জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর পক্ষে এলাকায় অবস্থান করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারদের বকেয়া পরিশাধ, রোয়ানো ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মেরামতের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রী ডিও’র মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে অতিরিক্ত ৪৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছেন। কিন্তু অতিরিক্ত বরাদ্দ পাওয়াতো দূরের কথা, মূল বরাদ্দই অনুমোন না হওয়ায় নদী ভাঙন প্রতিরোধে সব ধরনের জরুরি কাজ আটকে রয়েছে। রোয়ানো ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে কোন ধরনের টেন্ডার করতে পারছে না বলে পাউবো’র এক কর্মকর্তা জানান।
এই কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে পাউবো’র জরুরি ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য প্রয়োজন ৩৬শ’ কোটি টাকা। সেখানে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে অনুন্নয়ন ও রাজস্ব খাত থেকে এ জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৩৭২ কোটি টাকা। তাও আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অভাবে এই টাকা উত্তোলন করা যাচ্ছে না। আরও জানা যায়, গত ৩ বছরে সারাদেশে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে তার মধ্যে এখনও পাউবো’র কাছে ঠিকাদারদের পাওনা রয়েছে ৯৭৩ কোটি টাকা। অনেক ঠিকাদার পাওনা না পাওয়ায় এখন আর বাকিতে কাজ করতে চায় না।
অন্যদিকে, নগদ অর্থ না থাকায় বাকিতে কাজ করাতে যেয়ে পাউবো’র লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হচ্ছে। এতে করে অনিয়ম বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে দুর্নীতি। রক্ষণাবেক্ষণ কাজে না মাত্র যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার একটি অংশ চলে যায় পানিতে, আর বাকিটা যায় পাউবো’র অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের পকেটে। পাউবো’র এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় জেরালোভাবে তুলে ধরায় বেকায়দায় পড়েছেন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই।
জানা যায়, পাউবো’র জরুরি কাজে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে তা সংস্থাটির ৯টি জোনের ৭৮টি ডিভিশনে ভাজ করে দেয়া হয়। এবছর রোয়ানো ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে পাউবো’তে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকেই তদবির করেছেন এবং করছেন। তদবিরকারীদের প্রত্যেকেই চান তার এলাকার জরুরি কাজে বরাদ্দ বাড়ানো হোক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ইনকিলাবকে বলেন, নদী ভাঙন থেকে দেশের মূল্যবান ভূমি রক্ষা করতে হলে জরুরি ও মেরামত কাজে অর্থ বাড়াতে হবে। তার মতে, দেশের-নদী ভাঙন তীব্র হলেও পাউবো এখন পর্যন্ত কোন অর্থ পায়নি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মূল বারাদ্দের অনুমোদনসহ অতিরিক্ত আরও ৪৩৮ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীর কাছে। আসা করছি, দ্রুত এই অর্থ পাওয়া গেলে নদী ভাঙন রোধ, বন্যা ও রোয়ানোর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করা যাবে। তিনি বলেন, অর্থ প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলে নদী ভাঙনে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে।
এ দিকে যশোর থেকে রেবা রহমান জানায়, প্রায় ২০দিন পর আবার যশোরের কপোতাক্ষ নদে ঝিকরগাছা পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় ২৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম। তিনি জানান, ৪ দশমিক১১ সেন্টিমিটার হচ্ছে বিপদসীমা। নদে পানির উচ্চতা রয়েছে ৪ দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার। নদের ঢালুপথ বন্ধ হয়ে আছে । পলি জমে ভাটিতে পানি সরছে না। যার কারণে পানি বিপদ সীমার উপরে উঠছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামীকে একাধিকবার টেলিফোন করে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এলাকাবাসীদের কথা, কপোতাক্ষ নদপাড়ে ঝিকরগাছা পয়েন্টে লোকালয়ে পানি উপচে ততটা ক্ষতি হয়নি, কেশবপুর পয়েন্টের মতো।
কেশবপুর ও মনিরামপুর পয়েন্টে কপোতাক্ষ নদপাড়ে অবস্থা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা একেবারেই ঢিলেঢালা। দুর্গতি মানুষের দুর্গতি কমছে না। এদিকে ভবদহ এলাকার পানিবন্দীদের দুর্দশা সামান্য লাঘব হলেও আবার যে কোন সময় পানিবন্দী হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে টিআরএম চালু করার দাবি জানিয়েছেন পানিবন্দীরা। তাদের কথা, শ্রীনদী ও হরিহর নদীতে পানি প্রতিবন্ধকতায় বিরাট এলাকায় পানিবদ্ধতার সৃষ্টি। শ্রীনদী ও হরিহর নদীতে ড্রেজিং শুরু হলেও পানি সরছে না ভবদহের গেট দিয়ে। একটি স্ক্যাভেটর দিয়ে পানি সরানোর খেলা করা হচ্ছে। ভবদহের আশেপাশে মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার বিরাট এলাকায় আড়াইশ’ গ্রাম প্লাবিত হয় এবার। পানিবন্দীদের মাঝে শ্লোগান ওঠে ‘পানি সরাও, মানুষ বাঁচাও’। তারপরেও পানিবন্দীদের দুর্গতি স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ একেবারেই ঢিলেঢালা।
ভবদহের পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে যশোরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করেছে পানিবন্দী কয়েক হাজার মানুষ। গতকাল (রোববার) দুপুরে যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার মানুষ এই কর্মসূচি পালন করেন। কার্যালয় ঘেরাও শেষে তারা পানি নিষ্কাশনসহ পাঁচ দফা দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। বিগত বর্ষার পর এই তিন উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি এ কর্মসূচির আয়োজন করে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ