Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দলবাজিতে বন্দি বিসিএস চাকরি

উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ভাগ্য ডিসি এবং ইউএনওর হাতে প্রশাসনে তিন লাখ ৮৯ হাজার পদ শূন্য

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

সরকারি কর্মকমিশন (বিসিএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে বন্দি দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থক হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থী। প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা, কৃষিসহ অন্যান্য ক্যাডারে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েও তারা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শুধু রাজনৈতিক কারণে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, জেলা প্রশাসক এবং ইউএনওর প্রতিবেদনে আটকে যাচ্ছে চাকরি। বিসিএস নিয়োগে পর্দার আড়ালে যেন দলবাজির তুঘলকি চলছে। ফলে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে দেশে চাকরি না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এতে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে মেধাবী ছেলেমেয়েদের সেবা থেকে। আর দলবাজির নিয়োগে প্রশাসনে মেধাবী লোকজনের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে পিএসসি’র চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজম কথা বলতে রাজি হননি। তবে এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকার যখন যে নীতিমালা জারি করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তরা তখন সেই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু অনেক সরকারি কর্মকর্তা ভাবেন না তাদের ছেলেমেয়েদের একদিন চাকরি করতে হবে। সেটা না ভাবার কারণে এ রকম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে যে সরকারি কর্মকর্তারা কাজ করছেন, অবশ্যই এসব কর্মকর্তা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করবেন না। তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করলে অনেক মেধাবী স্থান পাবেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, প্রশাসনে আমলানির্ভরতার কারণে এগুলো হচ্ছে। যাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তাদেরও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ফলে তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রশাসনে মেধাহীনদের নিয়োগ দেয়ার কারণ দুর্নীতি বাড়ছে।
জানা যায়, এক সময় পুলিশের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের চাকরি চূড়ান্ত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে জেলা প্রশাসক এবং ইউএনওর প্রতিবেদনের কারণে অনেকের নিয়োগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকছে বছরের পর বছর। বর্তমান সরকারের ২৭তম বিসিএস থেকে ৪০তম বিসিএস পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩শ’ ছেলেমেয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেলেও চাকরি পায়নি। অনেকে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা চাকরি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। মামলার রায় পেয়েছে কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না বলে জানা গেছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে প্রতিবেদন দিয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। আবার পিএসপি থেকে সুপারিশ করার পরও গেজেটে নাম প্রকাশ করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনে মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩টি পদে জনবল রয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনে মোট তিন লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য রয়েছে। এদিকে সন্তানের বিসিএস প্রশাসনে নিয়োগের জন্য অনেক বিএনপি নেতা সরকারি দলে যোগদান করেছেন। আবার অনেক এমপি ও মন্ত্রী সুপারিশযুক্ত ডিও লেটার দেয়ার পরও প্রশাসনে চাকরি পাচ্ছেন না।

৩৭তম বিসিএস কৃষি ক্যাডারে পাস করা শিক্ষার্থী বেনজির ইকবাল যার রোল-০২১১৮৫। গত ২০১৯ সালে গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন জমা দিয়েছেন। সেই আবেদন আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। বেনজির ইকবালের বাবা ইকবাল হোসেন চাঁদ দুই বছর আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের আধা-সরকারি ডিওসহ সুপারিশপত্রও জমা দিয়েছেন। তারপরও কাজ হচ্ছে না। কিন্তু সেই সময়ে দায়িত্ব পালন করা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল কাদের কর্মকর্তার দুই রকম প্রতিবেদন দেয়ার কারণে বড় সমস্যা। এছাড়া বগুড়ার নাহিদ হাসান ৩৩-৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধা তালিকায় পাস করেছেন। কিন্তু বগুড়ায় বাড়ি হওয়ার কারণে চাকরি হয়নি। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ছাত্রদলের নেতার ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন পরে প্রতিবেদনের কারণে চাকরি হয়নি।

একইভাবে ২৭তম বিসিএস থেকে ৪০তম বিসিএস পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৩শ’ জন উত্তীর্ণ মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াদের নামে প্রতিবেদন দিয়েছেন সারাদেশের ডিসি ও ইউএনওরা বলে জানা গেছে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, আসলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পিএসসিসহ সকল নিয়োগে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর মেধাহীন দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিচ্ছে। কারণ তারা দলীয় মেধাবী। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ডিসি ও ইউএনওদের এমন প্রতিবেদন জমা দিতে হতো না। তখন পুলিশ যে প্রতিবেদন দিত সেই আলোকে নিয়োগ হয়ে যেত। আর এখন পুলিশের গোপনীয় প্রতিবেদনেও মেধাবীদের চাকরি হচ্ছে না। আগামী বিসিএস পরীক্ষাগুলো নিয়ে আমরা ভাবছি। তিনি বলেন, আমার ছাত্রদলে সাধারণ সম্পাদক ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করেছে। তার রোল-(০৭৯২২৫) পরে তাকে নন-ক্যাডারে চাকরি দেয়া হয়। তিনি চাকরি করেননি।

এ দিকে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল কাদের গত ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত পাঠানো প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজির ইকবাল ৩৭তম বিসিএস উত্তীর্ণ রোল নং-০২১১৮৫। তার পিতা মো. ইকবাল হোসেন চাঁদ, তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং বর্তমানে তিনি বণিক সমিতির সহ-সভাপতি। ২০০৭ সালে তিনি উপজেলা বিএনপিসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে সংসদ নির্বাচনে কাজ করেছেন। এর পর একই বছরের ৭ জুলাই আবার একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, তার পিতা একজন ব্যবসায়ী, কোনো রাজনীতিক দলের সঙ্গে সক্রিয় নন মর্মে স্থানীয় এমপি একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। তার পরিবারের কোন সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নয়। এভাবে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, কোন প্রেক্ষিতে কী নিয়োগ দিয়েছে সেটা আমার জানা নেই। এটি নতুন কিছু নয়, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আমাদের ছাত্রলীগের অনেক মেধাবী চাকরি পায়নি। তবে আমি বলব মেধাবীদের নিয়োগ দিচ্ছে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের পরিসংখ্যান এবং গবেষণা কোষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, ২০২০ সালের জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরিসংখ্যান নিয়ে স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস-২০২০ বই থেকে এ তথ্য জানা গেছে। প্রশাসনে মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি। এর মধ্যে বর্তমানে প্রশাসনে মোট তিন লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য। এতে বলা হয়, শূন্যপদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৬০৩টি প্রথম শ্রেণির, ৩৯ হাজার ২৮টি দ্বিতীয় শ্রেণির, এক লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি তৃতীয় শ্রেণির এবং ৯৯ হাজার ৪২২টি চতুর্থ শ্রেণির পদ রয়েছে।

মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পর্যায়ে ১৭ হাজার ৭৩৯টি পদের মধ্যে শূন্য পাঁচ হাজার ৬৮টি, সংস্থা ও অধিদফতর পর্যায়ে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৬২৬টি পদের মধ্যে শূন্য দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৬টি। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে ১৪ হাজার ৮৫১টি পদ খালি রয়েছে, এখানে মোট পদের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৩৩টি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেশনগুলোতে চার লাখ ১১ হাজার ৪৭০টি পদের মধ্যে এক লাখ ২৭ হাজার ৭০০টি পদ খালি ছিল। ২০১৯ সালের শূন্যপদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। এর আগের বছর তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ খালি ছিল। ২০১৭ সালে পদ খালি ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ২৪৭টি। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি। নারী-পুরুষ ভেদে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান প্রশাসনে মোট কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৫ লাখ চার হাজার ৯১৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১০ লাখ ৯০ হাজার ৫০১ জন এবং নারী চার লাখ ১৪ হাজার ৪১২ জন। নারীদের হার ২৭ শতাংশ। প্রথম শ্রেণির পদে নারী ৩৭ হাজার ২৭৯ জন এবং পুরুষ এক লাখ ৪৬ হাজার ৯৫০ জন। দ্বিতীয় শ্রেণির পদে পুরুষ এক লাখ ২২ হাজার ২৩০ জন এবং নারী ৪৮ হাজার ৫৩৬ জন। তৃতীয় শ্রেণির পদে পুরুষ ছয় লাখ ১২ হাজার ১৮৪ জন এবং নারী দুই লাখ ৮৩ হাজার ১৩৩ জন। চতুর্থ শ্রেণির পদে নারী ৪৫ হাজার ৪৬৪ জন এবং পুরুষ দুই লাখ নয় হাজার ১৩৭ জন। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার অধীনে ৫৯২টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের মোট জনবল ৪৭ হাজার ৩২৩ জন। এছাড়াও পাঁচ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ১০টি প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেখানে মোট জনবল ৯০০ জন। এদিকে বিসিএস পরীক্ষার উত্তীর্ণ হয়েও দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সন্তানরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সে বিসিএস পরীক্ষা গুলো হচ্ছে, ২৭তম বিসিএস থেকে ৪০তম বিসিএস পর্যন্ত ছেলেমেয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেলেও চাকরি পাচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিসিএস


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ