Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিপদসীমায় যমুনা-তিস্তার পানি

বিভিন্ন স্থানে বন্যা ও অব্যাহত ভাঙন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে যমুনা ও তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, চৌহালী ও কাজিপুর উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। লালমনিরহাটে গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার ভাঙনে ১১টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে দুই উপজেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান : গতকাল শনিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গেজ রিডার আব্দুল লতিফ বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১.২৩ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র স্রোতের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে শহররক্ষা বাঁধ এলাকার বিভিন্ন স্থানে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়ছেন এসব এলাকার অন্তত ১৫ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার বীজতলা, সবজি বাগান, পাট ও তিলক্ষেত। চৌহালীর বিনাইন গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, যমুনা চোখের সামনে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। ভাঙনের কারণে আমরা ঘরবাড়ি সরানোর কাজে ব্যস্ত। গত বছর ভাঙনে ঘরবাড়ি সরিয়ে এনে এখনো ঠিকভাবে দাঁড় করাতে পারিনি। আবারও ভাঙনে সরিয়ে নিতে হচ্ছে।
একই গ্রামের সাইফুল বলেন, নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এরই মধ্যে অন্তত ১৫টি বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়েছে। আরো অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কমিউনিটি ক্লিনিক ভাঙনের মুখে রয়েছে। তবুও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেখা পাচ্ছি না। বাঁধ নির্মাণের কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।

চৌহালী উপজেলার ভাঙনরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইল পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিনাইন এলাকায় ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। চৌহালী দক্ষিণ এলাকা রক্ষায় ৪৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে এ এলাকায় ভাঙন থাকবে না।

লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান : গতকাল শনিবার বিকেলে পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চর অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শনিবার বিকেলে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ (বিপদসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ব্যারাজ রক্ষায় ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সূত্র জানায়, গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে শনিবার সকাল ৬টা থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সর্বশেষ বিকেল সাড়ে ৫টায় পানি ৫২ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার স্পর্শ করে। ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে তিস্তার পানি।

জানা যায়, তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, সিঙ্গামারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুণ্ডা, ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে।

আদিতমারীর মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, তিস্তার পানি কয়েক দিন থেকেই বাড়ছে। শনিবার সকাল থেকে পানিপ্রবাহ ব্যাপক পরিমাণ বেড়েছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। পানি থেকে বাঁচতে কিছু পরিবার উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের ঢল অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো সময় তিস্তায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে তিনি জানান।

শেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান : ঢলের পানিতে ভোগাই, চেল্লাখালী, মহারসী, মালিঝিসহ সব নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। পানির তোড়ে নালিতাবাড়ী পৌরসভার শিমুলতলা, নিজপাড়া এলাকায় একটি কালভার্ট ও অন্তত ১ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাঁচা বাঁধ ভেঙে পৌর এলাকাসহ অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হেয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক বাড়িঘর, ২শ’ হেক্টর জিমর আমন ধানের বীজতলা, বেশ কিছু মাছের পুকুর পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলার দীঘিরপাড় অংশসহ অন্তত তিন কিলোমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঝিনাইগাতী বাজারের ব্যবসায়ীসহ ৩০টি গ্রামের হাজারও মানুষ। এখানে অর্ধশত হেক্টর জমির আমন বীজতলা ও শতাধিক মাছের ঘের ও পুকুর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্থানীয়রা স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের দাবি জানালেও তাদের কথা শোনার যেন কেউ নেই। তাই প্রতি বছর এভাবে বাঁধ ভেঙে বন্যার পানিতে ফসল, ঘরবাড়ি ক্ষতির সম্মুখীন হন তারা।

শহররক্ষা বাঁধ ভেঙে গত বুধবার সকাল থেকে নালিতাবাড়ী পৌরসভার শিমুলতলা, নিজপাড়া এলাকায় বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক জায়গায় বাঁধ উপচে পানি নাকুগাঁও স্থলবন্দর সড়কের শিমুলতলা, চারআলী, নিজপাড়া, আড়াইআনি সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ঝিনাইগাতী বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী শুকুর আলী জানান, তার দোকানে ঢলের পানি ঢোকায় প্রায় ৩০ হাজার টাকার মালামাল ক্ষতি হয়েছে। ঝিনাইগাতী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, মহারসী নদীতে স্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় ঢলের পানি এসে শহরে ঢুকে প্রত্যেক বর্ষাকালেই একাধিকবার ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যেই শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান ব্যবসায়ী সংগঠনের এই নেতা।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঢলের পানিতে বেশ কিছু এলাকার পুকুর প্লাবিত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণের কাজ চলছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানি বিভিন্ন এলাকাতে প্রবেশ করেছে। এতে প্রায় ২৫ হেক্টর জমির বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আশা করছি, পানি দ্রুত নেমে যাবে, এতে ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জিয়াসমিন খাতুন জানান, পানি কমে গেলে বাঁধ নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণ করেন।

বগুড়া ব্যুরো জানায় : গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত শুকনো মৌসুমের পর থেকে শুরু হওয়া লাগাতার বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের ছোট-বড় সব নদীই এখন পানিতে টইটম্বুর। উত্তরে পঞ্চগড় থেকে দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ, পূর্বে কুড়িগ্রাম থেকে পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত ছোট-বড় ৫০টির মতো নদ-নদীর প্রত্যেকটির পানিতে ভরপুর অবস্থার জন্য শুধু যে মৌসুমি বৃষ্টিই কারণ তা কিন্তু নয়। আসল কারণ বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে সৃষ্ট একাধিক নিম্নচাপের প্রভাবে লাগাতার বর্ষণ। যার প্রভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের হিমালয়ের পাদদেশ শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, আসাম অঞ্চলে অনেক বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে এবার।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে, রীতিমতো বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সেখানে। আর সঙ্গত কারণেই ভারত নিজের গরজেই ভাটিতে বাংলাদেশের উত্তরে যেসব পয়েন্ট দিয়ে নদীগুলো প্রবেশ করেছে সেগুলোর বাঁধ, স্পার, ওয়াটার পাস গেটগুলো খুলে দিয়েছে চলতি আষাঢ় মাসের শুরুতেই। এর ফলে উজান থেকে ভারতীয় পানির ঢল উত্তরের নদ-নদীগুলোকে ভরিয়ে তুলেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বগুড়ার ইতিহাস গবেষক আব্দুর রহিম বগরা জানালেন, খরা মৌসুমে পানি আটকানো আর বর্ষাকালে তা ছেড়ে দেয়ার ভারতীয় রীতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলাদেশের পদক্ষেপ কী এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সরকার ফারাক্কা পয়েন্টে পদ্মা নদীতে ফাঁস জাল স্থাপন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল এমন তথ্য শোনা যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল যেন প্রজনন মৌসুমে ইলিশের ঝাঁক যেন ডিম ছাড়ার জন্য ভারতীয় অংশে যেতে না পারে।

তার মতে, এ ধরনের কিছু শক্ত পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তান আমলে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে পারেনি। উত্তরের অন্যান্য নদীতেও পানি আটকানোর চিন্তা থেকে বিরত থাকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলক চালুর কথা বলে ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প চালুসহ ব্রহ্মপুত্র ব্যতীত প্রায় সব নদ-নদীর উৎসমুখেই কিছু না কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত, যার খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিপদসীমায় যমুনা-তিস্তার পানি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ