পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
২০১৯ সালের নভেম্বরে কাফি খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ড. আশরাফ। সে সময় কাফি খান ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কাফি খান বলেছিলেন, “আমি ২০২০ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই। ট্রাম্পের মত একজন খারাপ লোক যাতে আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে না পারে সেই ব্যালট যুদ্ধে অংশ নিতে চাই। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের এক সময়ের সংবাদ পাঠক এবং অভিনেতা ও বাচিক শিল্পী কাফি খান বৃহস্পতিবার বিকালে মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনে ভার্জিনিয়া সেন্টার হাসপাতালে কাফি খান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে জানিয়েছেন তার ছেলে রাফি খান।
সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এর প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করা কাফি খান দীর্ঘদিন প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। যুক্তরাষ্ট্র সময় শুক্রবার জুমার নামাজের পর সুগারল্যান্ড রোডের অ্যাডামস সেন্টার মসজিদে তার জানাজা এবং এরপর মুসলিম গোরস্থানে দাফন করা হয়। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক কাফি খান ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নেন ১৯৯৪ সালে। তারপর যুক্তরাষ্ট্রেই পরিবার ও স্বজনদের সান্নিধ্যে অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন। মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা প্রবাসী লেখক-বিজ্ঞানী ড. আশরাফ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, “দুদিন আগেও (মঙ্গলবার) প্রবাসীদের এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অসুস্থ কাফি খান বিছানায় শুয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাহজাহান’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, “সে সময় তাকে বিমর্ষ দেখালেও এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন সেটা কেউ বুঝতে পারিনি।”
কাফি খানের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার বারাসাত এলাকার কাজীপাড়া গ্রামে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্ম ১৯২৯ সালের ১ মে। রেওয়াজ অনুযায়ী এক বছরের হিসাব নেই। অর্থাৎ আসল জন্মসাল ১৯২৮। গ্রামের স্কুলে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পড়াশোনা করেছেন। বারাসত গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে পাস করেন ম্যাট্রিক। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ড. এনামুল হক। তারপর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করে বিকমে ভর্তি হন। সেটি ছিল ১৯৪৬ সাল; অস্থির সময়। সরকারের লেবার কমিশনার অফিসে টি-গার্ডেন সার্ভে অফিসের ইনভেস্টিগেটর হিসেবে চাকরি নিলেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং এর ফলে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে তখনই তিনি ঢাকায় চলে আসেন বড় ভাইয়ের সঙ্গে। পরিবারের বাকি সবাই থেকে যান ভারতে। ঢাকায় এসে পাকিস্তানের রাজস্ব বিভাগে কেরানির চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন কাফি। পাশাপাশি ১৯৫১ সালে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা শাখায় বেতার-নাটকে কণ্ঠদানও শুরু করেন। এছাড়া ঢাকায় মঞ্চনাটকের অন্যতম সংগঠক হিসেবেও কাজ করতে থাকেন।
১৯৬৬ সালে কাফি খান প্রথমবার ভয়েস অব অ্যামেরিকার বাংলা বিভাগের কর্মী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত ছিলেন। তৎকালীন কিছু প্রবাসীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে জনমত গঠনে কাজ করেন তিনি। ১৯৭৫ এর সাতই নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলে কাফি খানকে তার প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। কাফি খান সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়বার ভয়েস অব আমেরিকার চাকরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হন কাফি খান। মঞ্চনাটক, কবিতা আবৃত্তি ও বেতার অনুষ্ঠান ছাড়াও, ষাটের দশকে ঢাকায় বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। দেশভাগের পর হিন্দুরা চলে যাওয়ায় সাংস্কৃতিক জগতে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। কাফি খানের আবৃত্তির দিকে ঝোঁক ছিল। স্কুলে বাংলার এক বদলি শিক্ষক গতানুগতিক কবিতা পাঠের বদলে রবীন্দ্রনাথের ‘ নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ’ আবৃত্তি করে শুনিয়ে আবৃত্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিলেন ।
ঢাকায় বেতার নাটকে অংশগ্রহণের পাশাপাশি কাফি খান তরুণ শরফুল আলম , কাজী নূর - উস - সোবহান , শেখ মুহিতুল হকসহ আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি শৌখিন নাট্যগোষ্ঠী গড়ে তুললেন। লক্ষ্য , মঞ্চাভিনয়কে জনপ্রিয় করে তোলা এবং কলকাতার মতো স্থায়ী একটি মঞ্চ গড়ে তোলা। নাটকের রিহার্সেল ও মঞ্চায়নের খরচ মেটানো হতো চাঁদা তুলে। এ কাজে সহযোগিতা করতেন হাবিবুল হক ( তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের একান্ত সচিব ), বি এ খান , পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল হক , খলিল আহমেদ ( অভিনেতা বুলবুল আহমেদের বাবা ও সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি ) প্রমুখ । এই নাট্যগোষ্ঠীর প্রথম মঞ্চনাটক ছিল বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘ নার্সিং হোম ’ । এর পর একে একে আসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ কালিন্দী ’, ‘ দুই পুরুষ ’, ‘ শাজাহান ’, অধ্যাপক নূরুল মোমেনের ‘ যদি এমন হতো ’ ও ১৯৫৬ সালে শরৎচন্দ্রের ‘ দেবদাস ’ । সে সময় ঢাকায় রক্ষণশীল মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কাউকে পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সৌভাগ্যবশত এগিয়ে এসেছিল কয়েকটি পরিবার। ‘ নার্সিং হোম ’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার তদানীন্তন মহাপরিচালক জয়নাল আবেদিন সাহেবের স্ত্রী নূরুন্নাহার , শ্যালিকা ক্কমর আখতার , বি এ খানের মেয়ে মমতাজ লিলি খান এবং মনিমুন্নেছা নামে এক কলেজছাত্রী। নাটকগুলোর নির্দেশনায় ছিলেন শরফুল আলম ।
১৯৫৬ সালে কাজী নূর - উস - সোবহানের নির্দেশনায় ‘ রক্তের ডাক ’ নামে একটি নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের একটি সিনেমা হলে। দেবদাস নাটকটির নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কাফি খান। পার্বতীর ভূমিকায় শরফুল আলমের স্ত্রী মাসুদা আলম। তাঁরা দুজনেই এখন প্রয়াত। ছেলেদের হলের নাটকে মেয়েদের অভিনয় করার রেওয়াজ ছিল না। ফলে জগন্নাথ কলেজ হলের পক্ষ থেকে ১৯৫২ সালে কার্জন হলে মঞ্চায়িত ও কাফি খান অভিনীত ‘ বিশ বছর আগে ’ নাটকে মেক আপ দিয়ে ছেলেদের মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করানো হয়েছিল। অন্যান্য যেসব স্থানে তাঁরা নাটক মঞ্চায়ন করতেন তার মধ্যে মাহবুব আলি ইনস্টিটিউট ছিল উল্লেখযোগ্য । ঢাকায় বহু পরিশ্রম করে ‘ মুখ ও মুখোশ ’ নামে প্রথম বাংলা সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন আব্দুল জব্বার খান। এরপরই ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ( এফডিসি ) প্রথম তলার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সেই সময়ে নাজিমুদ্দিন রোডে রেডিও অফিসের পাশেই ছিল ‘ আবন মিয়ার রেস্টুরেন্ট ’ । সেখানে রেডিওর শিল্পী - কলাকুশলীরা বসে আড্ডা দিতেন। তাঁদের মধ্যে থাকতেন বিনোদনমূলক সাপ্তাহিক ‘ চিত্রালী ’ পত্রিকা সম্পাদক এস এম পারভেজ। তরুণ কবি সৈয়দ শামসুল হকও সেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন। সবাই মিলে ঠিক করলেন একটি সিনেমা তাঁরা বানাবেন।
সেই মতে ১৯৫৬ সালে এফডিসিতে প্রথম একটি বাংলা ছবি নির্মিত হলো। সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনি নিয়ে ‘ মাটির পাহাড় ’ । পরিচালক এস এম পারভেজ , নায়ক কাফি খান , দুই নায়িকা সুলতানা জামান ও রওশন আরা । রাজস্ব বোর্ডের চাকরিতে যুবক কাফি খানের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতনরা সহযোগিতা করতেন। তারপরও বাংলা সিনেমার জন্মলগ্নে নায়ক চরিত্রের জন্য যে সময় দেওয়ার প্রয়োজন হতো , তা তাঁর পক্ষে দেওয়া দুরূহ ছিল। ‘ মাটির পাহাড় ’- এর পর সিনেমায় ছোটখাটো পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করতে থাকলেন। ‘ পাকিস্তান অবজারভার ’ পত্রিকা সম্পাদক ওবায়দুল হকের ‘ দুই দিগন্ত ’, মহীউদ্দিনের ‘ তোমার - আমার ’, খান আতাউর রহমানের প্রথম ছবি ‘ অনেক দিনের চেনা ’ ও পরের ‘ রাজা সন্ন্যাসী ’, কাফি খান অভিনীত তেমনি কয়েকটি সিনেমা ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।