পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
উবায়দুর রহমান খান নদভী : এ বছর সউদী সরকারের রয়্যাল গেস্ট হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যারা বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদের দাওয়াতে পবিত্র হজ পালন করে এসেছেন তাদের মধ্যে আমার নামও ছিল। এর পেছনে দেশী-বিদেশী যাদেরই ভূমিকা ও অবদান আছে আমি তাদের প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে মাননীয় রাষ্ট্রদূত আল মোতাইরি ও রিলিজিয়ার এটাশে শাইখ ফাহাদ আল গামিদির প্রতি।
এর আগেও আমি মহামান্য বাদশাহর দাওয়াতে সউদী আরব সফর ও ওমরা পালন করেছি। এ বছর মূলত ইনকিলাবের মাননীয় সম্পাদকের তরফ থেকে বাদশাহর মেহমান হিসেবে হজ পালন এবং দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিনিধিত্ব করেছি। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ রাত ৮টায় রওয়ানা হয়ে আমরা রাত ৩টায় মক্কা শরিফের ক্লাসাব্লাংকা নামক প্রাসাদোপম হোটেলে পৌঁছি। আমি সউদী ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিকট পরিচিত মুখ হওয়ায় তারা আমাকে মিডিয়ার মুখোমুখি হতে বলেন।
আমি বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য বিচারপতি ফরিদ আহমদকে সাথে নিয়ে মক্কা রেডিও, সউদী নিউজ চ্যানেল, বিবিসি আরবি ইত্যাদির সাথে কথা বলি। বিচারপতি সাহেব বাংলায় বললে আমি তা আরবি করি। আমার বক্তব্য আমি আরবিতেই দেই। পরদিন বাদশাহর মেহমানদের বিষয়ে প্রকাশিত দ্বিভাষিক বুলেটিন ইসতিজাফায় আমাদের ইন্টারভিউ ছাপা হয়। কর্তৃপক্ষ আমাদের দু’জনকে এক কক্ষেই থাকতে দেয় এবং শেষ পর্যন্তই বাংলাদেশ টিমের নেতা ও মুখপাত্রের কাজ এ কক্ষ থেকেই চলে। হজের আগে এক সপ্তাহ আমরা ক্লাসাব্লাংকায়ই থাকি। এ সময় লবিতে স্থাপিত মিডিয়া সেন্টারে অন্তত ১৫টি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়াকে আমি সাক্ষাৎকার দিই। হজের মৌসুম, সবাই ব্যস্ত, আমরাও ইবাদতে মগ্ন থাকার চেষ্টা করি। মিডিয়ায় আমার সাক্ষাৎকার দেখার সুযোগ হয় না। পরদিন সউদী কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবী তরুণ, প্রবাসী বাংলাদেশী কিংবা কোন দর্শনার্থীর মুখে শুনতে পাই, তারা আমাকে শুভেচ্ছা জানান। বলেন, আমাকে তারা টিভি পর্দায় দেখেছেন, আমার কথা খুব ভালো লেগেছে ইত্যাদি।
গত বছর ওমরায় গিয়ে যেসব বিষয় নিবন্ধ আকারে লিখেছিলাম, মন্তব্য করেছিলাম এর অংশ বিশেষ এ বছর মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত স্মারকে দেখতে পাই। আমার হাতে লেখা একটি পৃষ্ঠাও তারা আরবি হস্তলিপির নিদর্শনস্বরূপ স্মারকটির ভেতর ছেপে দিয়েছেন। বিচারপতি ফরিদ আহমদসহ বাংলাদেশী প্রতিনিধিরা এটি দেখে খুব খুশি হলেন এবং আমাকে অভিনন্দন জানালেন। মিডিয়া কমিটির লোকজন এসব স্মারক সকল মেহমানকে দিলেন। এ বছর আমি হজ ব্যবস্থাপনা ও হারামাইনের খেদমত বিষয়ে আমার চিন্তাভাবনা, প্রস্তাব ও পরামর্শ লিখে ৭ পৃষ্ঠার একটি ফাইল মন্ত্রণালয়ে জমা করি। পরদিন মহাপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তার মাধ্যমে মন্ত্রী আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে গোটা হজ কর্মসূচির সাথে যুক্ত করে ফেলেন। এরপর কয়েকটি সেমিনার, পরামর্শ সভা, টিভি টকশো ইত্যাদিতে আমাকে জড়িয়ে ফেলা হয়।
হজের দু’দিন আগে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে হজে আগত বিশ্বের ৫৫ জন নির্বাচিত চিন্তাবিদ, সম্পাদক ও বিশিষ্টজনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করি আমি। পাকিস্তানের সাবেক তথ্যমন্ত্রী মুহম্মদ আলী দুররানী, ভারতের সাংবাদিক সমিতির নেতা, মালয়েশিয়ার হিজরত টিভির সিইওসহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন। আমি বক্তৃতার পাশাপাশি আমার লিখিত প্রস্তাবাবলীও জমা দিই। বৈঠক শেষে একটি কমিটি ঘোষণা করা হলে দেখি আমাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জিলহজের ৮ তারিখ রাতে আমরা আরাফাতে চলে যাই। ৯ তারিখ সারাদিন অবস্থান করি। এদিন ইচ্ছা করেই কোন মিডিয়ার মুখোমুখি হইনি। সূর্যাস্তের পর মুজদালিফা চলে যাই। খুব ভোরে যখন মিনায় পৌঁছি তখন আমাদের তাঁবুতেই বাদশাহর লোকজন ছিলেন। জামারার সবচেয়ে নিকটবর্তী তাঁবুটিতে আমাদের রাখা হয়েছিল। তাঁবুর মুখে ‘মন্ত্রীর অফিস’ নাম দেয়া কক্ষটি দামি আসনে পরিপূর্ণ। এরই পাশে ছিল সউদী রাষ্ট্রীয় নিউজ চ্যানেল আল-আখবারের লাইভ স্টুডিও। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফওয়াজ আল খালিফি আমাকে বললেন, হজের উপর লাইভ যে অনুষ্ঠান চলছে এতে আপনি অতিথি আলোচক। ১০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে চলে আসুন। আমি এলাম। প্রায় ৫০ মিনিট অনুষ্ঠানে হজ, ইতিহাস, অভিজ্ঞতা, উপলদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা বললাম। আমার সাথে ছিলেন বসনিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি ও কিরগিজিস্তানের ইসলামিক সেন্টারের চেয়ারম্যান। উপস্থাপক শাইখ গানিম আমাকে পরিচিত করলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম ও ইসলামী লেখক হিসেবে। ১০ দিন ধরে একটানা চালু এ অনুষ্ঠানের নাম ‘ইয়াওমিয়াতুল হাজ’ মানে হজের দিনপঞ্জি। আরাফাত, মুজদালিফা, মিনা, মক্কা, মদীনা, বাংলাদেশ ও সউদী আরব সম্পকর্, বিশ্ব মুসলিম কোন প্রসঙ্গ বাদ গেল না। এ প্রোগ্রামটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দর্শক শ্রোতারা এতে নিজেদের যুক্ত করতে পারেন। ফেসবুক, টুইটার, ই-মেইল, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে মন্তব্য পাঠাতে পারেন। যাদের মন্তব্য সেরা হবে এমন ৬ জনকে আগামী বছর বাদশাহর তরফ থেকে হজ করানো হবে। পরদিন দেখা গেল আমার বক্তব্যের উপর সবচেয়ে বেশি মন্তব্য এসেছে। শাইখ গানিম তাঁবুতে এসে আমাকে অভিনন্দিত করলেন। শেষদিন বাছাইপর্ব। বিশ্বের নানা দেশ থেকে টুইটবার্তা পাঠিয়ে যে ৬ জন বিজয়ী হলেন তাদের নাম প্রোগ্রাম থেকে প্রচারিত হবে। এটি ছিল ১০ দিনের সরাসরি সম্প্রচারের শেষদিন। এদিন ধর্মমন্ত্রী আলে শাইখ প্রোগ্রামে এসেছিলেন। হজের মূল প্রোগামে দীর্ঘ সময় লাইভ প্রচারিত হওয়ায় গোটা আরবে আমার চেহারা পরিচিত হয়ে যায়। অনেকেই আমাকে দেখেই চিনে ফেলেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেখা হলেই বলেন, খুব সুন্দর বলেছেন।তথ্য, সংবাদ, জ্ঞান ও সংস্কৃতিমূলক কাজে অংশগ্রহণের জন্য আমাকে কর্তৃপক্ষ একটি এওয়ার্ড প্রদান করেন। এটি মক্কা ওয়াচ টাওয়ারের মডেল।
বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদের মেহমান হয়ে এবার ১৪৩৭ হিজরি মোতাবেক ২০১৬ সালে হজ পালন করার অবসরে হোটেলের রয়্যাল স্যুটে বসে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে দীর্ঘ লেখা তৈরি করেছিলাম। মিনিস্ট্রির লোকজন সেটি নানা জায়গায় পাঠালেন। জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে বলে পরে জানতে পারি। ফেরার পথে কপি সংগ্রহ করে দেন একজন তরুণ সউদী কর্মকর্তা। হজ ও পবিত্র দুই মসজিদের বর্তমান অবস্থার উপর বিস্তারিত লেখার জন্য সউদী কর্মকর্তারা এবারও আমাকে অনুরোধ করলেন। আমি দেশে ফিরে লিখব এবং এসবের কপি ঢাকাস্থ রিলিজিয়াস এটাশে অফিস, দূতাবাস ও সউদী আরবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাব বলে আশ্বস্ত করলাম।
মক্কায় থাকতেই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বাদশাহর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ নিতে আমাকে বললেন। আমি তাদের বললাম, বাংলাদেশের টিমে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হলেন আমার রুমমেট বিচারপতি ফরিদ আহমদ। তাকেই বাদশাহর প্রাসাদে নেয়া হোক। বিচারপতি মহোদয় ছাড়া যেতে চাইলেন না। অতএব, এজন্য কর্মকর্তাদের নিতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা। অবশ্য প্রাসাদে আমি আগেও গিয়েছি। আমার অন্য এক হজের সময় মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের সাথে। তখন বাদশাহ ছিলেন ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ। বাদশাহ আবদুল্লাহর সময়ও একবার প্রাসাদে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। পরদিন ছাপা কার্ড এল। দাওয়াতনামা। কর্মকর্তাদের বহরে সরাসরি যাওয়া। বাকিদের আগে মক্কার হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। সেখান থেকে সোজা পর্বত চূড়ায় অবস্থিত মিনা প্রাসাদে। সউদী রাজপরিবার সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ, গোত্রপতি ও সরকারের উচ্চপদস্থ লোকজন, বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন দেশের মেহমান প্রতিনিধি মিলিয়ে অন্তত হাজার খানেক অতিথি দরবার হলে সমবেত। এটি মূলত বাদশাহর ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়। বাদশাহ এলেন, দশ মিনিটের লিখিত বাণী পেশ করলেন এবং প্রথম সারির মেহমানদের সাথে মোসাফাহা ও শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। খুব নিকটের লোকেরাই বুক মিলালেন ও চেহারার উপর দোল খাওয়া রুমালে চুমো খেলেন। অতি অল্প কিছু লোক তার সাথে ছবি তুলতে সক্ষম হলেন কেবল ‘দিওয়ানে মালিকি’ বা রাজদরবারের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পূর্বঅনুমোদিত গেজেটে। ফটো সেশনের বিস্তারিত পরে মেহমানদের পাঠানো হবে বলে ই-মেইল ও মোবাইল নাম্বার রাখা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ফিরে আসার দিন এয়ারপোর্টের পথে যখন যমযমের পানি, খেজুর ও রয়াল গেস্টে হজ করার স্মারক, আতর, তসবিহ সম্বলিত ক্রেস্ট সদৃশ্য বক্স মেহমানদের হাতে তুলে দেয়া হয় তখন রয়্যাল গেস্টদের গোটা হজ কার্যক্রমের দৃশ্য ধারণ করা পেনড্রাইভও তারা দিতে ভুলেননি। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বৈঠক, টকশো, প্রাসাদ ইত্যাদির বিস্তারিত ছবি-ভিডিও সহসাই পাওয়া যাবে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জানালেন প্রটোকলের এক তরুণ কর্মকর্তা । তিনি আমাকে ফোন করে ঢাকায় পৌঁছার সংবাদও জানতে চেয়েছেন। গত ক’দিনে আরো তিনজন কর্মকর্তার ফোন পেয়ে আমি আনন্দিত। এ দাওয়াত পেয়ে হজ করে এবং নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে পেরে আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে অসীম শুকরিয়া আদায় করছি। আমি মহামান্য বাদশাহ ও তার সরকারের প্রতিও কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় ও জীবন চলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সঠিক পথ অবলম্বনের তওফীক দান করুন।
আমি বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলের সকল সদস্যকে মোবারকবাদ জানাই তাদের সৌজন্য ও সুন্দর সাহচর্যের জন্য। বিশেষ করে স্মরণ করি আমার কর্মক্ষেত্র দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মন্ত্রী মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)কে। যিনি আরব বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য মসৃণ পথ রচনা করে গেছেন। বহু নামী দামী আরব শাসকের সাথে যার ব্যক্তিগত ও গভীর সম্পর্ক ছিল। মাননীয় সম্পাদক এ সফরে আমাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন, রাজকীয় মেহমানদারির পাশাপাশি নিজের খুশিমত ছুটোছুটি করার রসদ জুগিয়েছেন। এ সফরে আরো যারা নানাভাবে জড়িয়ে আছেন পবিত্র মদীনার রওজা মোবারকে উপস্থিতির সময় আমি তাদের সবার তরফ থেকে সালাম পেশ করেছি। দোয়া কবুলের স্থানে আল্লাহর দরবারে সবার জন্য দোয়া করেছি। তিনি যেন আমাদের সকল আকুতি কবুল করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।