Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে মৃত্যুর বিভীষিকা

প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন
সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে। যেসব পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারায় তারাই জানে স্বজন হারানোর বেদনা কত নির্মম, কতটা কঠিন। দুর্ঘটনার কারণে কত পরিবার নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়ে তার খবর কে রাখে! দেশের সন্তানতুল্য নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র কি সে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই দুর্ঘটনার কারণে ঝরে যায় বহু মানুষের প্রাণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের ঈদুল আজহার সময় রেকর্ডসংখ্যক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহত হয়েছেন। খবর অনুযায়ী, ৭ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৭ জন (প্রথম আলো, ১৮.৯.২০১৬)। জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল তারা ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে কমিয়ে আনবে। অথচ বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের সড়কে প্রাণহানিকে ইরাক ও আফগাস্তিানের ভয়াবহ যুদ্ধের প্রাণহানির সাথে তুলনা করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গত ৯ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরিসংখ্যান তুলে ধরেন এর নেতারা। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২১ হাজার ৮৫৫ জন। এই হিসাব মতে, গত বছর প্রতিদিন গড়ে ২৪ জন নিহত হয়েছে। এর আগের বছর ২০১৪ সালের চিত্রও একই। অবশ্য পুলিশের হিসাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় গড়ে ৬ জন। গত ঈদুল ফিতরে যাতায়াতকালে সড়ক, রেল ও নৌপথে ১২১টি দুর্ঘটনায় ১৮৬ জন নিহত এবং ৭৩৬ জন আহত হয়েছিল বলে জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে শত শত বিপজ্জনক মোড় এবং স্থান রয়েছে। এগুলো পুরোপুরিভাবে ঝুঁকিমুক্ত করা হয়নি অদ্যাবধি। সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ঢালছে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ খুব একটা হচ্ছে না। সরকারের আজ্ঞাবহ ব্যক্তি কর্তারা নি¤œমানের উপাদান দিয়ে এসব নির্মাণ করায় অল্পদিনেই খানাখন্দ তৈরি হয় সড়ক-মহাসড়কে।
আমাদের দেশে যতগুলো সমস্যা বিদ্যমান তার মধ্যে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। দিনের পর দিন যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলছে, সে তুলনায় তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা অপ্রতুল। যে সময়ে এই লেখাটি লিখছি সে সময়েও সড়কে মৃত্যুর মিছিলে ২৩টি তাজা প্রাণ চলে গেছে না ফেরার দেশে। আর লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখনও হয়ত সড়কের মরণ ফাঁদে আরো প্রাণ ঝরার খবর প্রকাশিত হবে। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয়, যে কোন দুর্ঘটনা বা অকাল মৃত্যুর জন্য আমরা আজ শংকিত। প্রতিনিয়ত গুম, খুন, অপহরণ, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে যা মনে করলে গা শিউরে ওঠে। যে কোন মানুষের মৃত্যু মেনে নেয়া যেখানে মেলা ভার, সেখানে দুর্ঘটনার মৃত্যু মেনে নেয়া কত কষ্টের তা ভুক্তভোগীর স্বজন ব্যতীত অন্যরা অনুধাবন করতে পারে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিকবিরোধী মতাবলম্বীদের দমন-পীড়নের জন্য যে স্টিমরোলার প্রয়োগ করা হয় তা যদি সড়ক-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করা হতো তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল একটু হলেও কমতো। পাঠকের মনে থাকার কথা, বছর দুয়েক আগে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামে স্কুল পড়ুয়া শিশুরা মারা গিয়েছিল। সে শোকে পুরো দেশ মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকরা তখন কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সে ঘোষণার সুফল দেশ বা জাতি আজো দেখতে পায়নি। যে ড্রাইবারের অবহেলার কারণে কোমলমতি শিশুদের তাজা প্রাণ অকালে ঝরে নিয়েছিল, সেই ড্রাইবার আজ কোথায় আর তার কী বা শাস্তি দিয়েছে সরকার তা কি আজ আমাদের মনে আছে? একটুও মনে নেই। কারণ বাংলাদেশ হলো সব সম্ভবের দেশ যা খুশি তাই করার দেশ, এখানে নিয়মনীতি, আইনকানুনের বালাই নেই। সাহস করে কিছু একটা করে ফেলতে পারলেই হলো। ব্যস! আর ঠেকায় কে? নিকট অতীতে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরিডুবিতে কয়েকশ মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। আমাদের দেশে এমন নজির কি ভাবা যায়! আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পদত্যাগ করুক এটা বলছি না, অন্তত দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিক, এটুকু তো আমরা আশা করতেই পারি। সড়ক দুর্ঘটনা যে সুনামিতে পরিণত হয়েছে, এটা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা অনুধাবন করছে বলে মনে হয় না। যদি অনুধাবন করতে পারতেন তাহলে নিশ্চয় কিছু উদ্যোগ পরিলক্ষিত হতো। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের পদক্ষেপ আমরা দেখছি না বলেই একের পর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।
বাংলাদেশের মতো এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয় বলে মনে হয় না। সরকার ইচ্ছে করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গত সাত মাসে ১৪৭৩ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। তাছাড়া বিগত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৬০৭ জনের অকাল মৃত্যু হয়েছে। ২০১২ সালে ২০০৯ জন, ২০১৩ সালে ১৫৪৬ জন, ২০১৪ সালে ২১৩৫ জন, ২০১৫ সালে ২৫৮০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে শুধুমাত্র যে চালকই দায়ী তা কিন্তু নয়! পরিবহন মালিক-শ্রমিকের কাছে আজ জিম্মি হয়ে পড়ছে জনসাধারণ। যে কারণে গেটলক, সিটিং সার্ভিস, বিরতিহীন সার্ভিস নামে বহু প্রকার বাস সার্ভিস থাকলেও কাক্সিক্ষত মানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। কারণ অদক্ষ ড্রাইবার তখন আর বেশি ট্রিপ মারার ফন্দি করতে পারবে না। ঢাকা শহর যখন যানজটে জজরিত থাকে তখন কিন্তু তুলনামূলকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কম হয়। কারণ ঈদেও মৌসুমে রাজধানীর লোকাল বাস সার্ভিসগুলো বেশি ট্রিপ মারতে গিয়ে বিপন্ন করছে মানুষের জীবন। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে প্রধানতম যে কারণগুলো আমাদের কাছে প্রতিয়মান তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবগতির জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি ঃ প্রথমত, দেশের সড়ক-মহাসড়কে বিপজ্জনক বাঁক আর অবৈধ অ্যাপ্রোচ রোডগুলো দায়ী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সারাদেশের সড়কগুলোর উপর এক সমীক্ষা চালিয়ে ২০৯টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১৪৪টি বাঁককে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে সরকার। বিপজ্জনক ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে- কুমিল্লা জোনে ৮টি, সিলেট জোনে ১৪টি, চট্টগ্রাম জোনে ৩২টি, খুলনা জোনে ১১টি, বরিশাল জোনে ১২টি, ঢাকা জোনে ১৯টি, উত্তরবঙ্গের রংপুর জোনে ২২টি ও রাজশাহীতে ২৬টি। এসব বাঁক প্রশস্তকরণ ও একাধিক লেনে পরিণত করার মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলেও বছরের পর বছর ধরে সেসব পরিকল্পনা শুধু নকশা আঁকাআঁকির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ আজও নেয়া হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাধারণত ফুটপাত দখল, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, গাড়ির ত্রুটি, ট্রাফিক আইন না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করা প্রভৃতি দায়ী। অদক্ষ অবৈধ চালকের বেপরোয়া যান চালনায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে অহরহ। বলা হচ্ছে দুর্ঘটনা। অশিক্ষিত চালকের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে লাখ লাখ যানবাহন। তাদের হাতে যাত্রীর মৃত্যু হলে তাকে হত্যা বা মানুষ খুন বলা হবে না কেন? যে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে সে পরিবারটি কী অবস্থায় রয়েছে তার খবর কজন রাখে? সড়ক দুর্ঘটনায় কি শুধু একটি পরিবারেরই ক্ষতি হয় নাকি দেশ ও অর্থনীতিরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়? এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহল যত দ্রত অনুধাবন করতে পারবে ততই মঙ্গল হবে। প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র এ দায় এড়াতে পারে না। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সড়কে মৃত্যুর মিছিলের রাস টেনে ধরবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়কে মৃত্যুর বিভীষিকা

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন