পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
খালের জায়গায় খাল নেই। বেদখল এমনকি হারিয়ে গেছে বেশিরভাগ। বসতঘর, ঝুপড়ি, দোকানপাট, মিল-আড়ত, গুদাম, সুরম্য ভবনসহ হরেক অবৈধ স্থাপনা গেঁড়ে বসেছে। যা অবশিষ্ট আছে সেসব খাল-ছরা, নালা-নর্দমাজুড়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। স্তরে স্তরে পলিথিন ও প্লাস্টিক অপচনশীল বর্জ্য। অপদখলের উদ্দেশে চলছে ভরাটকাজ। খাল-ছরা-ঝরণাগুলোর চওড়া, গভীরতা, দৈর্ঘ্য কমে গেছে। মহানগরীর ৫৭টি খালের এমন মরণদশা। বছর ত্রিশ আগে চাক্তাই খালকে বলা হতো ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’। একে পুঁজি করে ঢের হয়েছে রাজনীতি। সেই সুবাদে ‘পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প’র নামে প্রতিবছর দফায় দফায় সরকারি বরাদ্দ আসে সোয়া দুই হাজার কোটি টাকা। বিদেশি ফর্মুলার নামে ‘সিল্ট ট্র্যাপ’ (বালু আটকানোর ফাঁদ) প্রকল্পও নেয়া হয়। শেষমেশ সবই গেছে চাক্তাই খালের পেটে। অসৎ অনেক কর্তাব্যক্তি ও ঠিকাদারদের পকেটে। কাজের কাজ হয়নি কিছুই।
বর্তমানে চাক্তাই খাল শুধুই নয়। প্রতিটি খাল-ছরা, নালা-নর্দমা নগরীর ‘দুঃখ’। খালের দুঃখেই ভাসছে চট্টগ্রাম। বর্ষার আগেই গত ১৪ মে থেকে সর্বশেষ ৯ জুন পর্যন্ত সাত দফায় ডুবভাসি করেছে নগরী। চসিক মেয়রের বহদ্দারহাটের বাড়ির সামনের সড়কে কোমর-সমান পানির ঢেউ বয়ে যায়। দুয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই কাদা-পানি-বালুতে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর বড় অংশ। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি যোগ হলেই ডুবছে অনেক এলাকা। বৃষ্টি ও জোয়ারের দ্বিমুখী চাপে পানিবদ্ধতা ‘ক্রনিক’ সমস্যায় রূপ নিয়েছে। ৭০ লাখ নগরবাসীর মধ্যে অন্তত ৩০ লাখই কোন না কোনভাবেই পানিবদ্ধতার শিকার। ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা, আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী ও শিল্পের কাঁচামালের গুদাম, দোকানপাটসহ পদে পদে ক্ষতি আর লোকসান হচ্ছে। বর্ষার আগেই সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী অশনি সঙ্কেতের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এবার অবস্থাদৃষ্টে আশঙ্কা করছি চট্টগ্রাম নগরী বুক-সমান পানিতে ডুবে যেতে পারে।
গতকাল শনিবার দৈনিক ইনকিলাবকে মেয়র বলেন, খাল-ছরা, নালা-নর্দমা ভরাট, অবৈধ যাবতীয় স্থাপনা নির্মাণ ও বেদখল বন্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি আরএস জরিপ খতিয়ান অনুযায়ী খালগুলো উদ্ধার এবং অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সেবা সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে। নগরীর পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম অনেক খাল অবৈধ দখলে চলে গেছে। খালগুলো বেদখল ও ভরাটের কারণে পানিবদ্ধতা সমস্যা প্রকট হচ্ছে। পুরনো খালগুলো খনন ও সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের নতুন কিছু খাল খনন করতে হবে। নগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্প সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে। তিনি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলিথিনসহ বর্জ্যে ব্যাপক ভরাট প্রসঙ্গে বলেন, কর্ণফুলীর যথাযথ ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই সাথে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এতে কর্ণফুলীর নদীর সাথে যুক্ত ১৬টি খাল এবং ২০টি উপখালসহ ৩৬টি খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন বিগ্রেডের মাধ্যমে সিডিএ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে বারবার তাগাদার পরও প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে সিডিএ’র অস্বাভাবিক ধীরগতিতে প্রকল্পকাজের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে। তবে সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ ইনকিলাবকে বলেছেন, সর্বশেষ জরিপ বিএস খতিয়ান অনুসারে খালগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকাংশে উদ্ধার করে সীমানা নির্দিষ্টকরণ হয়েছে। চার বছর মেয়াদে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরও দুই বছর রয়েছে। কার্যক্রম অব্যাহত আছে। অবশিষ্ট কাজগুলো সামনে সম্পন্ন হবে।
বেহাল খাল-ছরা
উঁচুনিচু পাহাড়-টিলাময়, সমতল, ঢালু, সাগর-উপকূল, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, খাল-ছরা, ঝরণা, হ্রদ, অনেকগুলো দীঘি-পুকুর মিলিয়ে দুইশ’ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চট্টগ্রাম নগর ও এর আশপাশের এলাকাটি ভিন্নধরনের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। সমুদ্রের কিনারে থাকায় মৌসুমী বায়ুর প্রভাব প্রথমেই পড়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই নগরীতে। তাছাড়া সামুদ্রিক জোয়ার-ভাটার নগর। প্রাচীনকাল থেকেই শহর চট্টগ্রাম এবং কর্ণফুলী নদীর মোহনার সাথে সংযুক্ত ২০টি প্রধান খালসহ মোট ৫৭টি খাল ও ছরা পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবেই সমাধান দিয়ে আসছে। যা নগরীতে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা শিরা-উপশিরা। অথচ কোন খাল এখন ‘সুস্থ’ ও ‘অক্ষত’ নেই।
সাদার্ন ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রো-ভিসি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম প্রফেসর এম আলী আশরাফের গবেষণা, দেশি-বিদেশি সংস্থার জরিপে নগরীর খাল-ছরাগুলোর সেকাল-একালের হালচাল ফুটে উঠেছে। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের প্রথম ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরির সময়ে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান জনসস্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি কয়েক বছর ধরে ৫৭টি খালের উপর মাঠ জরিপ চালায়। শহরের দক্ষিণে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে পূর্বে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ৩৪টি মূল খালের ম্যাপ তৈরি করে।
এতে খালগুলোর গতিপথের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য, তথ্য-উপাত্ত বা প্রটোকল বর্ণিত আছে। গত ২০১৭ সালে নতুন ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরির জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা নিয়োজিত নেদারল্যান্ডসের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ চালায়। ১৯৬৯ সালের সেই একই স্থানসমূহে পরিচালিত জরিপে আগের ৩৪টি খালের মধ্যে অস্তিত্ব মিলেছে ২২টি খালের। বাদবাকি ১২টি খাল গায়েব! অথচ আরএস, সিএস, পিএস, বিএস ভূমি-জরিপ রেকর্ড, ম্যাপ-খতিয়ানে ৩৪টি খালই রয়েছে। এমনকি হিসাবে থাকা ২২টি খালের মধ্যে ১৩৯টি বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্থাপনা মিলেছে বিদেশি সংস্থার জরিপে।
৪৭ বছরের ব্যবধানে বন্দরনগরীর ১২টি খাল কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেল এই প্রশ্নের সুরাহা মিলেনি আজও। সরকারি কোন সেবাসংস্থা, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে জবাবদিহিতা ও দায় গ্রহণ করেনি। বিষয়টি প্রকাশ পেলে নাগরিকমহলে দাবি উঠে, আরএস, সিএস, পিএস রেকর্ড খতিয়ান মূলে অবিলম্বে খালগুলোকে খালের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হোক।
দখলবাজদের বিরুদ্ধে নেয়া হোক কঠোর আইনি ব্যবস্থা। কেননা নগরীতে পানিবদ্ধতার দুঃসহ দুর্ভোগের পেছনে প্রাকৃতিক খাল-ছরাগুলো বেদখল, ভরাট ও দূষণই প্রধানত দায়ী। চাক্তাই খাল ছাড়াও রাজাখালী, ফিরিঙ্গিবাজার, গয়নাছরা, কলাবাগিচা, হিজড়া, মির্জা, বির্জা, মহেশখাল, মরিয়মবিবি, মধ্যম-বদর, টেকপাড়া, জামালখান সাব-এরিয়া, রহমতগঞ্জ, খন্দকিয়া ইত্যাদি খাল-ছরা দখল, ভরাট, দূষণে সবচেয়ে বেহালদশা। খাল-ছরাগুলোর সাথে যুক্ত নালা-নর্দমা ভরাট, দখল, অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে নির্বিচারে। মহানগরীজুড়ে পানি নিষ্কাশনের পথ অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আশিক ইমরান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, মহানগরীর খালগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনরুদ্ধার করা জরুরি। যে কোন বাধা-বিপত্তির ঊর্ধ্বে উঠে সমন্বিতভাবে তা করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। দখল-ভরাট-দূষণমুক্ত করে খাল-ছরাগুলো স্বাভাবিক ও সচল করা না হলে চট্টগ্রামকে পুরোপুরি পানিবদ্ধতামুক্ত করা সম্ভব নয়। খালগুলো উদ্ধারের সাথে সাথে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম জিয়া হাবিব আহসান বলেন, চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রকৃতির প্রাণ খাল-ছরা। দীর্ঘদিন পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ। খালগুলোর টুঁটি চেপে ধরে ছোট্ট নালায় পরিণত করা হয়েছে। অনেক জায়গায় খালের অস্তিত্ব নেই। বেআইনিভাবে নির্মিত হয়েছে দালানকোটাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। খাল-নালা-নর্দমা অবৈধ দখলবাজদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সেগুলো দলিলমূলে ফিরিয়ে আনতে হবে। জনস্বার্থে চসিক, সিডিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনসহ নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে সমন্বিত ভূমিকা রাখতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।