পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মোবায়েদুর রহমান : অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলে একটি বাংলা সিনেমা দেখানো হয়েছে। ছবিটির নাম ‘শঙ্খচিল’। বলা হয়েছে, এটি নাকি ভারত-বাংলা যৌথ প্রযোজনার ছবি। কোনো রকম বিজ্ঞাপন খরচ ছাড়াই কোনো ভারতীয় (লোকদেখানো যৌথ প্রযোজনা) বাংলা সিনেমা বাংলাদেশে যে এত বিপুল পাবলিসিটি পেতে পারে সেটা এবারই প্রথম দেখলাম। একটি সিনেমার প্রমোশনাল অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক জগতের লোকজন ছাড়াও বিডিআরের মহাপরিচালক কিভাবে বক্তব্য রাখতে পারেন সেটি মানুষের বোধগম্য নয়। তাও হতো যদি সেটি বাংলাদেশের জয়গানে উচ্চকিত হতো। ভারতীয় বাংলা ছবিতে ভারত বিভক্তি নিয়ে সিনেমা করার একটি বাতিক ভারতীয় বাংলা ছবির পরিচালকদের মাঝে লক্ষ করা যায়। আরেকটি প্রবণতা হলো হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। ওরা যখনই পলিটিক্যাল টাচ্ দিয়ে কোনো ছবি বানায় তখনই ভারত বিভক্তি এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সেখানে অবধারিতভাবে থাকবেই। শঙ্খচিলও তার ব্যতিক্রম নয়।
তা ওরা এই বিষয়টি নিয়ে ছবি করুক, তাতে বাংলাদেশের জনগণের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু যখন ঐসব বক্তব্য ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করা হয়, তখনই আসে হাজারো প্রশ্ন।
কেন ভারত ভাগ হলো? কেন বাংলা ভাগ হলো?
এই দুটি প্রশ্ন নিয়ে ভারতের এসব সিনেমায় রীতিমতো মাতম করা হয়। কয়েক মাস আগে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি ছবি ‘রাজকাহিনী’তেও এই ধরনের বিলাপ করা হয়েছে। রাজকাহিনীতে পাঞ্জাবের বিভক্তি নিয়েও কথা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আমরা চোখ-কান বন্ধ রাখতে পারি না। কারণ এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। ভারতীয় ছবির বাংলাদেশে দেখানো হোক আর না হোক, আমাদের দেশের মানুষ, যারা ইচ্ছা করেন, তারা অতি সহজেই ভারতীয় ছবি দেখতে পারেন। কারণ ওদের দেশে কোনো ছবি রিলিজড হলে দুই-তিন সপ্তাহের ভেতরেই সেটি ইউটিউবে পাওয়া যায়। আরেকটি সহজ পথ আছে। সেটি হলো যারা ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে ইন্টারনেট নেন তারা তাদের প্রভাইডারের এফটিপি সার্ভার থেকে খুব কম সময়ের মধ্যেই একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ডাউনলোড করতে পারেন। আজকাল অনেকের ঘরেই ৪০ ইঞ্চি, ৫০ ইঞ্চি এমনকি ৫৫ ইঞ্চি টেলিভিশন আছে। সুতরাং আর ছোট পর্দা নয়, বড় এবং ওয়াইড স্ক্রিনে তারা এসব ছবি দেখতে পারেন।
হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি প্রসঙ্গ
শঙ্খচিলের শুরুতে কয়েকটি দৃশ্যের পর দেখানো হয়, বাংলা ভাগের ফলে একজন হিন্দু পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে গেছেন। একজন মুসলমান সেই বাড়িটি দখল করেছে। সেই বাড়িতে হিন্দু মালিক একটি তুলসী গাছ লাগিয়েছিলেন। সেটিতে প্র¯্রাব করে মুসলমান দখলদার তাদেরকে অপমান করেছে। এমনটি হতেও পারে। কিন্তু তার বিপরীত চিত্র কি নেই? সেই দিকটি দেখানো হলো না কেন? আরো বলা হলো, যে দেশ ভাগের ফলে নাকি সমগ্র বাংলা দুই ভাগে ভাগ হলো। এক ভাগ মুসলমান, আরেক ভাগ হিন্দু। কেউ আর বাঙালি রইল না। এটি সত্যের চূড়ান্ত অপলাপ। ২০১৬ সালে যে ছবিটি মুক্তি পেল সেখানে, অর্থাৎ ৬৯ বছর পর কি সেই কথা বলা যায়? বরং বাংলাদেশে তো সকলে কঠিন বাঙালি হয়েছেন। তবে যার যার ধর্ম তার কাছেই সেটি রয়েছে। ৬৯ বছর আগেও যা ছিল, আজও তাই আছে। অন্তত বাংলাদেশে সাড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হিন্দু স্বাধীনভাবে দুর্গা পূজা করছেন, জন্মাষ্টমীর মিছিল করছেন। পশ্চিম বঙ্গের ২৭ শতাংশ মুসলমান কতখানি ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করছেন সেটি আমরা জানি না। সেটি বলবেন তারা। তবে এবারের কোরবানি ঈদে দেখা গেল, একদল হিন্দু বেরিয়েছেন গরু গণনা করতে। অর্থাৎ কতগুলো গরু কোরবানি হবে। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কঠোর পদক্ষেপের ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐ কট্টর অংশটি পিছু হটে যায়।
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
ছবিটির অন্যতম প্রযোজক নায়ক বিশ্বজিতের পুত্র প্রসেনজিৎ। তিনিই ছবিটির মুখ্য ও কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাকে ঘিরেই সমগ্র ছবিটি আবর্তিত হয়েছে। তিনিই ডায়ালগ থ্রো করলেন,
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর ওপর রাগ করো,
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো।
এই কবিতাটি শুধু চরম বিতর্কিতই নয়, রীতিমতো পক্ষপাতমূলক। এর রচয়িতা কট্টর হিন্দু লেখক অন্নদা শংকর রায়। পাঁড় সাম্প্রদায়িক হিসেবে তিনি চিহ্নিত। এই সংলাপটি আমাদেরকে পেছনে ফিরে তাকাতে বাধ্য করছে। ভারত ভেঙে ভাগ হওয়া, মানে বাংলা এবং পাঞ্জাবকে ভাগ করা। আসামের একটি অংশ সিলেট। সেটি ভাগ হয়ে পূর্ব বঙ্গে এসেছে। তবে কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি আজও ভারতেই রয়ে গেছে। ভারতের আর কোনো অংশ বিভক্ত হয়নি। পশ্চিমে বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধু অক্ষতই রয়ে গেছে। অথচ বাংলা তো ভাগ হওয়ার কথা ছিল না। শুধু বাংলা কেন, সমগ্র ভারতেরই বিভক্ত হওয়ার কথা নয়। কথার পৃষ্ঠেই কথা এসে যায়। তাই পেছনের কিছু কথা বলতেই হচ্ছে।
কেন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান
গ্রহণ করা হলো না?
ভারতবর্ষকে এক এবং অখ- রাখার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি তার ক্যাবিনেটের ৩ সদস্যকে ভারতবর্ষে পাঠান। তারা হলেন পেথিক লরেন্স (সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া), স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং এ ভি আলেকজান্ডার। তারা তিনজনই ব্রিটেনের ক্যাবিনেট মিনিস্টার ছিলেন বলে তাদের এই টিমের নাম হয় ‘ক্যাবিনেট মিশন’। ভারতকে এক ও অখ- রাখার শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে তারা অখ- ভারতের প্রবক্তা কংগ্রেস এবং পাকিস্তানের প্রবক্তা মুসলিম লীগের কাছে একটি ফর্মুলা পেশ করেন। এই ফর্মুলায় ভারতবর্ষকে তিনটি গ্রুপ বা অঞ্চলে ভাগ করা হয়। তিনটি গ্রুপ হলোÑএ, বি এবং সি।
গ্রুপ এÑমাদ্রাজ, বোম্বে, মধ্য প্রদেশ, যুক্ত প্রদেশ, বিহার এবং উড়িষ্যা।
গ্রুপ বিÑপাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান।
গ্রুপ সিÑবাংলা এবং আসাম।
গ্রুপ এ ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। গ্রুপ বি এবং সি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। অঞ্চল তথা প্রদেশের থাকবে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন। কেন্দ্রের হাতে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং যোগাযোগ। সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য প্রাদেশিক পরিষদসমূহ থেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (Proportional representation) ভিত্তিতে ৩৮৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে গণপরিষদ বা (Constituent Assembly)। যাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে তারা হলেন হিন্দু, মুসলমান এবং শিখ। গ্রুপ বি এবং গ্রুপ সি ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।
এই হলো ক্যাবিনেট মিশন ফর্মুলার সংক্ষিপ্ত সার। মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার পাকিস্তান প্রস্তাব থেকে সরে আসেন এবং ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতা প-িত জওহর লাল নেহ্রু এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নেহরুর ভয় ছিল, যেহেতু গ্রুপ বি এবং সি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, তাই অবিভক্ত বাংলা, আসাম এবং অবিভক্ত পাঞ্জাবে ডোমিনেট করবে মুসলমানরা। প-িত নেহরু এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মুসলিম লীগ আবার পাকিস্তানের দাবিতে ফিরে যায় এবং ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণা করে। পরবর্তী ঘটনাবলি সকলেরই জানা। হাজার হাজার হিন্দু, মুসলমান এবং শিখের রক্তের বিনিময়ে অবিভক্ত পাঞ্জাব এবং অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হয়ে পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব পাঞ্জাব এবং পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গ নাম ধারণ করে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়।
যে কারণে বাংলা ভাগ হলো
কঠোর সত্য হলো এই যে মুসলমানরা, বিশেষ করে মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম বাংলাকে অখ- রাখার এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অক্লান্ত চেষ্টা করে গেছেন। তাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাই শরৎ চন্দ্র বসু এবং বঙ্গীয় কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টি নেতা কিরণ শঙ্কর রায়। তাদেরকে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছেন মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ, যথাÑমওলানা আকরাম খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন প্রমুখ, কিন্তু তারা সফল হননি। মি. গান্ধী, প-িত নেহ্রু এবং সর্দার প্যাটেলের দৃঢ় বিরোধিতার মুখে শরৎ বসু এবং কিরণ শঙ্করের উদ্যোগ বানচাল হয়। কংগ্রেস এবং ব্রিটিশদের সম্মিলিত চক্রান্ত এবং প্রতিরোধের মুখে তারা পরাস্ত হন।
বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে সঠিক চিত্র পেতে গেলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
অখ- বাংলার পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
আমি জানি, লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও নিরেট সত্য প্রকাশের স্বার্থে আরো দুটো কথা বলতেই হবে। বাংলা ভাগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি বলেছেন সেটি নিচে উদ্ধৃত করা হলো।
বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এ সম্পর্কে কি বলেছেন? তিনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ৭৩-৭৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হলো ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এজন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলোও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা নাও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করল। বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘এই সময় শহীদ (সোহরাওয়ার্দী) সাহেব ও (আবুল) হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণশংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাদের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যায় কিনা? শহীদ সাহেব দিল্লিতে জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার অনুমতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন। বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি একটি ফর্মুলা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। আমার যতদূর মনে আছে, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। যদি দেখা যায়, গণপরিষদের বেশি সংখ্যক প্রতিনিধি পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষপাতী, তবে বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানে যোগদান করবে। আর যদি দেখা যায় বেশি সংখ্যক লোক ভারতবর্ষে থাকতে চায়, তবে বাংলাদেশ ভারতবর্ষে যোগ দেবে। যদি স্বাধীন থাকতে চায়, তাও থাকতে পারবে। এই ফর্মুলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান। শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নেই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোনো ফর্মুলা মানতে পারবেন না।’
শেখ মুজিবুর রহমান আরো জানান, ‘শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাকে বলেছিলেন, ‘শরৎ বাবু, পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।’ মহাত্মা গান্ধী ও প-িত নেহ্্রু কোআে কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বাবুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে একথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন সে কথা স্বীকার করেছিলেন।’
শেখ মুজিবুর রহমান আরো লিখেছেন, ‘জিন্নাহর জীবদ্দশায় তিনি কোনোদিন শহীদ সাহেবকে দোষারোপ করেননি। কারণ তার বিনা সম্মতিতে কোনো কিছুই তখন করা হয়নি।’ খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন, ‘যুক্ত বাংলা হলে হিন্দু-মুসলমানের মঙ্গলই হবে।’ মাওলানা আকরম খাঁ সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, “আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে।’ এই ভাষা না হলেও কথাগুলোর অর্থ এই ছিল। ‘আজাদ’ কাগজ আজও আছে। ১৯৪৭ সালের কাগজ বের করলেই দেখা যাবে।”
রাজকাহিনী : মুর্শিদাবাদ
মালদা, নদিয়া
শঙ্খচিলে তবুও একটি মানবিক কাহিনী রয়েছে। কিন্তু রাজকাহিনী নামক সিনেমাটি ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, মাউন্ট ব্যাটেনের ৩রা জুন পরিকল্পনা এবং র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ নিয়ে অনেক কথা বলেছে। তারা দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া প্রভৃতি জেলার ভারতভুক্তি নিয়েও কথা বলেছে। কিন্তু এই চারটি জেলা কেন বিভক্ত হলো? ভারত বিভক্তির মূল সুরই হলো হিন্দুপ্রধান অঞ্চল ভারতে যাবে, আর মুসলমানপ্রধান অঞ্চল পাকিস্তানে যাবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পূর্বে ১৯৪১ সালের আদম শুমারি মোতাবেক অবিভক্ত দিনাজপুরে মোট জনসংখ্যার ৫৯.২ শতাংশ মুসলমান, মালদহে ৫৬.৬ শতাংশ, মুর্শিদাবাদে ৫৬.৬ শতাংশ এবং নদিয়ায় ৬১.২ শতাংশ মুসলমান। এসব জেলা সম্পূর্ণভাবে (অর্থাৎ অখ-) পাকিস্তানে আসা উচিত ছিল। অথচ কংগ্রেসের চাপে এই চারটি জেলাকেই ভাগ করা হলো এবং এজন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী কংগ্রেস পার্টি।
আমাদের পরিচয় বাঙালি
মুসলমান নয়
এসব কোনো কথাই না বলে শঙ্খচিল ছবির নায়ক প্রসেনজিতের মুখ দিয়ে বলানো হলো, আমাদের পরিচয় মুসলমান নয়, বাঙালি। স্বাধীন পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল এবং এই প্রতিবাদের ফলে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস। কিন্তু জিন্নাহ একথা বলেননি যে মুসলমান হওয়ার জন্য আমাদেরকে উর্দু শিখতে হবে। সে কথাটিই প্রসেনজিৎ এই সিনেমায় বলেছেন।
ঐ দিকে রাজকাহিনীর শুরুতেই দেওয়া হয়েছে একটি স্লোগান। আর সেটি হলো, ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ।’ এই ছবিটির একাধিক দৃশ্যে দেখানো হয়েছে মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি এবং হাঁটু পর্যন্ত প্রলম্বিত আচকান বা পাঞ্জাবি পরে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে মুসলমানরা ছুটে আসছে হিন্দুদের মারতে। ঐ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শুধু মুসলমানরাই কি হিন্দুদেরকে মেরেছে? হিন্দুরা কোনো মুসলমান মারেনি?
পাঞ্জাবের মাইগ্রেশন
রাজকাহিনীর দ্বিতীয় ভাগে দেখানো হয়েছে, পাঞ্জাব থেকে ৮০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। কারণ পাঞ্জাবের বিভক্তি। পাঞ্জাবের বিভক্তি হলো কেন? ১৯৪১ সালের আদম শুমারি মোতাবেক অবিভক্ত পাঞ্জাবে মুসলমানরা ছিলেন ৫৭.০৭ শতাংশ। হিন্দু এবং শিখের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। তারপরেও কংগ্রেস এটির বিভক্তি চাইল। পাঞ্জাব, বাংলা প্রভৃতি যেখানেই মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন মুসলমান সেখানেই বিভক্তি ছুরি চালিয়েছে ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস।
এসব কথা শঙ্খচিল এবং রাজকাহিনীতে বলা হয়নি। আজ ২০১৫ বা ’১৬ সালেও ছবি বানাতে গিয়ে ওরা হিন্দু-মুসলমান ইস্যু টেনে আনে। কিন্তু আমাদের দেশে ১৯৬৪ সালের পর থেকে ঐ ইস্যুটি প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের মুসলিম জন অনুপাত ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশে হিন্দু জন অনুপাত সাড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ। সুতরাং এই হিন্দু-মুসলমান ইস্যুটি বাংলাদেশের কোনো মাথাব্যথা নয়।
অভিনয় প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের মামুনুর রশিদ একজন সুপরিচিত ও জনপ্রিয় নেতা। তিনি কেন শঙ্খচিলে একটি ইনসিগনিফিক্যান্ট চরিত্রে অভিনয় করতে গেলেন? শুনেছি জয়া আহসান নাকি এমএ পাস। তিনি কেন রাজকাহিনীতে পতিতার একটি ছোট্ট এবং ফালতু চরিত্রে অভিনয় করতে গেলেন? ইন্ডিয়ান সিনেমা শুনলেই কি তারা দিশাহীন হয়ে পড়েন?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।