Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিপর্যয়ে নগরীর পরিবেশ

করোনা বর্জ্য ও প্লাস্টিকে সয়লাব ঢাকা নগরবাসীর দুর্ভোগও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে উদাসীন পরিবেশ অধিদফতর রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি : স্থপতি ইকবাল হাবিব

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

বৈশ্যিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। জীবন বাঁচাতে আপাতত এর কোনো বিকল্প নেই। অথচ জীবন সুরক্ষাকারী এই সামগ্রীর সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রাণঘাতী বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। করোনাকালের এসব প্লাস্টিক বর্জ্য রাজধানীর রাস্তায় যত্রতত্র ফেলায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। একই সাথে বৃষ্টির পানিতে ভেসে ড্রেনে যাচ্ছে এবং তাতে নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল হচ্ছে। মেডিক্যাল বর্জ্যরে পাশাপাশি নিষিদ্ধ পলিথিনের অবাধ ব্যবহারেও রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। এর ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে ঢাকার অলি-গলিসহ সমস্ত রাজপথ। নোংরা-ময়লা পানিতে ভয়াবহ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে নগরবাসী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হেড কভার, সু কভার, গগলস, ফেইস শিল্ড বা গাউনসহ যেসব সুরক্ষাসামগ্রী সাধারণ মানুষ ব্যাবহার করে তা রাস্তা-ঘাটে উন্মুক্ত জায়গায় ফেলে দিচ্ছেন। এসব বর্জ্য থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় সুরক্ষা সমাগ্রীতে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে প্লাস্টিকের এসব সুরক্ষাসামগ্রী এবং গৃহস্থালি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত পলিথিন রাজধানীর রাস্তায় যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় বিকল হচ্ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে সামন্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাচ্ছে। ময়লা আবর্জনায় রাজধানীর পরিবেশও দূষিত হচ্ছে।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ নগরীর পরিবেশ বিপর্যয় ও নগরবাসীর দুর্ভোগ দূর করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ চরম উদাসীন। বিশেষ করে রাজধানীর এই যে পরিবেশ বিপর্যয় এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর নীরব। পরিবেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিন রাজধানীতে অবাধে উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। এসব পলিথিন রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল করে দিচ্ছে। মেডিক্যাল বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলায় নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, রাজধানীর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। অথচ পরিবেশ অধিদফতর এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনের অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও নগরায়ণ-সুশাসন কমিটির সদস্যসচিব স্থপতি ইকবাল হাবিব ইনকিলাবকে বলেন, নগরবাসীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে এর পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পরিবেশ অধিদফতরের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও পরিবেশ অধিদফতর রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করতে পারছে না। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর তাদের দায়িত্ব পালনে বলা যায় ব্যর্থ। মেডিক্যাল বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য এসব সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। একই সাথে সাধারণ মানুষকে আরো ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে। যেন তারা মাস্ক বা অন্যান্য কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলে আলাদা করে রাখেন। তা না হলে নগরীর পরিবেশদূষণ যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি।

গতবছর ৮ মার্চ করোনাভাইরাস শনাক্তের পর থেকে দেশে ব্যাপক হারে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, গগলস, পিপিই, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা বেড়ে যায়। দিনদিন এসব জিনিসের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। আইইডিসিআরের হিসাব বলছে, দেশের মোট আক্রান্ত করোনা রোগীর ৫৭ শতাংশই ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা। করোনায় সংক্রমিত রোগীদের একটা বড় অংশ বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছে। বাসায় সার্জিকাল মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভসসহ নানা ধরনের মেডিক্যাল সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। ফলে রাজধানীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

করোনা সংশ্লিষ্ট সুরক্ষাসামগ্রী মূলত একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য। এসব পণ্য ভূমিতে বা পানিতে সাড়ে চারশ’ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাই মাস্ক বা প্লাস্টিকে তৈরি অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ভূমি, জলাভূমি, নদী ও সমুদ্র দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। এমনিতেই বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। আবার, সাধারণ বর্জ্যরে মতো যখন এগুলো উন্মুক্তভাবে পোড়ানো হয় তখন মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রতিদিন ৬,১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার প্রত্যেক নাগরিক ৩৭৭ গ্রাম বর্জ্য উৎপাদন করে, যার ৯৭ শতাংশই জৈব পদার্থ। বাকি তিন শতাংশ বর্জ্য অজৈব। মেডিক্যাল এবং মেডিক্যাল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ১,০৫০ টন ও রাস্তাঘাট থেকে চারশ মেট্রিক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় রাজধানীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। সেই সাথে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।

ঢাকা মহানগরে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বেশিরভাগই মেডিক্যাল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করছে না। হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সামনে যত্রতত্র স্তূপ করে ফেলে রাখছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভসসহ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন। এ সময়ে ঢাকায় ১ হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ডগ্লাভস এবং সার্জিক্যাল মাস্কের ৪৪৭ টন বর্জ্য তৈরি হয়েছে। এসব বর্জ্যরে বড় একটি অংশ যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। এতে করে ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।

ঢাকা মহানগরে ১৬ বছর ধরে প্রিজম বাংলাদেশ নামের বেসরকারি সংগঠন হাসপাতালের মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে আসছে। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ক মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা দেখছি, দু-একটি হাসপাতাল ছাড়া কেউই নিয়ম মেনে মেডিক্যাল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভ মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখে না। মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন অনুযায়ী প্রতিটা হাসপাতালে কমপক্ষে একজন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই পদে লোক নিয়োগ দেয় না। সাধারণত হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ড মাস্টারকে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এতে সঠিকভাবে হচ্ছে না বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, বিশ্বের অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করছেন পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সারাবিশ্বে করোনা মহামারি সংক্রমিত হচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে, সেই পরিবেশ রক্ষায় যদি এখনই উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে সামনে আরো ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষায় করছে।



 

Show all comments
  • Ana Nna ৮ জুন, ২০২১, ১২:৫৬ এএম says : 0
    ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় গিয়ে ভিড় করে ঢাকার অবস্থা মারাত্মক করে তুলেছে।ঢাকাকে বাঁচাতে ঢাকার বাইরে যে জায়গায় জনসংখ্যা সমস্যা কম সেখানে প্রতিষ্ঠান গুলো স্থানান্তরিত করা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Rabindra Chandra Sinha ৮ জুন, ২০২১, ১২:৫৮ এএম says : 0
    So sad for next next next generations!
    Total Reply(0) Reply
  • Ahsanul Moyeen ৮ জুন, ২০২১, ১২:৫৮ এএম says : 0
    নগর দুষনে ও ডেঙ্গু বিস্তারে সিটি কর্পোরেশন অনন্য ভুমিকা রাখছে। মেয়রদের মন্ত্রীর চেয়ে বেশী কিছু মর্যাদা দেওয়া দরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • Nazmul Huda ৮ জুন, ২০২১, ১২:৫৯ এএম says : 0
    পরিবেশ দুষনের সাথে মানবিক দুষনও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Shamim Sarowar ৮ জুন, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
    বাংলাদেশের পরিবেশ বিশেষ করে গ্রামের, সিপি পোল্ট্রি কোম্পানি নষ্ট করতেছে।কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের টাকা খেয়ে দুর্গন্ধকে কোন সমস্যা মনে করে না।সিপি পোল্ট্রি একটি বিদেশি কোম্পানি বলে আইন কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এদেশের গ্রামের রাস্তায় লিটার ( মুরগির বিষ্ঠা) ফেলে গেলেও কেউ তাদের কিছু বলতে সাহস পায় না।আমরা রাস্তায় দুর্গন্ধে চলাফেরা করতে পারি না। কি এসব নিয়ে কোন রিপোর্ট করতে পারে?
    Total Reply(0) Reply
  • MD Ovi ৮ জুন, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
    গাজীপুরের ময়লার অবস্থা অনেক খারাপ
    Total Reply(0) Reply
  • Iqbal Hasan ৮ জুন, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
    প্রকল্পের নামে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ। যেমন : পুকুর কাটা শিখতে, পুকুর ভরাট করা শিখতে মশা মারা শিখতে, ইত্যাদি।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shah Alam ৮ জুন, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
    আমাদের গাজিপুরের সমস্ত বর্য কড্ডা এনে ফেলে ।আমরা যারা এই রাস্তায় চলাচল করি তারাই জানি কতটা দুরভুগ।
    Total Reply(0) Reply
  • Asadud Jaman Khan ৮ জুন, ২০২১, ১:০০ এএম says : 0
    ময়লা দিয়ে বিদুৎ উৎপাদন করার কথা ভাবা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Moniruzzaman ৮ জুন, ২০২১, ১:০১ এএম says : 0
    বাহিরের দুনিয়ায় সিটি করপোরেশন পরিবেশ সুন্দর করে।আমাদের সিটি করপোরেশন পরিবেশ ধংশো করে।এটা সাভাবিক বেপার।
    Total Reply(0) Reply
  • R S Rabby ৮ জুন, ২০২১, ১:০১ এএম says : 0
    বজ্র আছে পরিশোধন নাই এটাই বাংলাদেশ
    Total Reply(0) Reply
  • ash ৮ জুন, ২০২১, ৬:৩৫ এএম says : 0
    ATO DESH GURLLAM !!! KINTU BANGLADESH MOST DIRTYEST COUNTRY IN THE WORLD, THATS FOR SURE
    Total Reply(0) Reply
  • Billal Hosen ৮ জুন, ২০২১, ৯:০১ এএম says : 0
    Honorable responsible person of Govt. please action about disastrous issue other wise serious problem face to people of Bangladesh. Highly requested to All journalist inform to honorable prime minister .
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিপর্যয়ে নগরীর পরিবেশ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ