Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দূষণে বিষাক্ত নদী

মেঘনায় ছড়াচ্ছে দূষণ : কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই : কমছে ইলিশ নদীদূষণ রোধে এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি : ড. আইনুন নিশাত

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২১, ১২:০১ এএম

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা ও এর চারপাশের অন্য সব নদী। আর নদীর প্রাণ হচ্ছে পানি। সেই পানি দূষিত হয়ে নদী হচ্ছে বিষাক্ত, প্রাণহীন। নদীর বিষাক্ত পানিতে নেই কোনো মাছ কিংবা জলজ প্রাণী। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আজ দূষণে বিষাক্ত। নদীতে নেই কোনো প্রাণ। এই দূষণ ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃত হচ্ছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যা এভাবে নদী দূষণ এখন মেঘনার মোহনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আর এতে মেঘনায় কমছে ইলিশের পরিমাণ। এখনই দূষণ রোধ করতে না পারলে ভবিষত্যে দেশের মৎস্যসম্পদ হুমকির মধ্যে পড়বে।

ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণ চলছেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, পরিবেশবাদিদের প্রতিবাদ, চিৎকার কোনো কিছুতেই নদী দূষণ থামছে না। দিন দিন দূষণের মাত্রা আরো বেড়েই চলেছে। বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হতে হতে কাল রঙ ধারণ করেছে। নদীর পানিতে ভাসছে কলকারখানার বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা। নদী থেকে বিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। স্থানীয়রা রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্ষাকাল ঘনিয়ে আসায় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি অনেকটা বেড়েছে। তবে ক্রমশ দূষণ বাড়তে থাকায় প্রায় ভরা বুড়িগঙ্গার পানিতেও উৎকট দুর্গন্ধ। বিভিন্ন স্থানে নদীর তীর ঘেষে পানিতে ভাসছে ময়লা আবর্জনা। কল-কারখানার বর্জ্যও মিশছে পানিতে।
বুড়িগঙ্গার দূষণ সম্পর্কে সোয়ারিঘাট এলাকার ফল ব্যবসায়ী আবু তালেব বলেন, একসময় রাজধানীর গাবতলী থেকে সদরঘাট এই নৌ-রুটে ১২টি ওয়াটার বাস চলত। বর্তমানে সেখানে আছে মাত্র ২টি। ওয়াটার বাস বন্ধ করে দেয়ার প্রধান কারণ যাত্রী কম। আর যাত্রী কম হওয়ার কারণ, নদীর পানির দুর্গন্ধ। এই ভয়াবহ গন্ধে কেউ ওয়াটার বাসে উঠতে চায় না। এই নদীর ঘাটের কাছাকাছি আমরা যারা ব্যবসা করি তারাও দুর্গন্ধে অনেক সময় টিকতে পারি না। এখন করোনার কারণে মুখে মাস্ক পরে থাকি বলে গন্ধ কিছুটা কম লাগে।

শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, আশপাশের তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীরও একই হাল। এসব নদ-নদীতে জলজ প্রাণীর জীবন ধারণ করার জন্য পানির মান যা থাকা উচিত, তার চেয়ে মান অনেক কম। মাঝে গত বছর করোনার কারণে লকডাউনের সময় কিছু এলাকার পানির মানের উন্নতি হয়েছিল। এখন সেই আগের অবস্থা। নদীদূষণ পরিমাপে অন্যতম মাপকাঠি হলো পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মান নিরূপণ। প্রতি লিটার পানিতে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম ডিও থাকলে ওই পানি মানসম্পন্ন বলে বিবেচনা করা হয়। গত পাঁচ বছরে পরিবেশ অধিদফতরের নদীর মান পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুকনা মৌসুমে ঢাকার পাঁচ নদীর পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান অনেক জায়গায় শূন্যে নেমে এসেছে। এ বছরের মার্চে বুড়িগঙ্গা নদীর মিরপুর সেতুর কাছে পানিতে ডিওর মাত্রা ছিল শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ। এখানে গত বছরের এপ্রিলে ছিল ২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। আর তুরাগ নদে গাবতলী সেতুতে গত বছর ডিও ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ। এবার মার্চে তা দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, ঢাকার নদীগুলোর দূষণের প্রধান উৎস পয়োবর্জ্য। ওয়াসা মাত্র ২০ শতাংশ এলাকা আর মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের বর্জ্য শোধন করতে পারে, বাকিটা পড়ে নদীতে। শিল্পবর্জ্যওে নদী দূষিত হচ্ছে। নদীর দূষণকারী হিসেবে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের দায় রয়েছে, সেগুলো এখনো একে অপরের প্রতি দোষ চাপানোয় ব্যস্ত।
ঢাকার নদীগুলো দূষণে মোট চারটি বড় উৎস দায়ী। সেগুলো হলো শিল্পবর্জ্য, পয়োবর্জ্য, দুই সিটির কঠিন বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য। সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায় আছে এসব দূষণে এবং দূষণের তদারকিতে। কিন্তু এসব দফতরের মধ্যে কে কতটা দূষণ করছে, তা নিয়ে একে অন্যকে দোষ চাপাচ্ছে। পরিবেশ অধিদফর বলছে পয়োবর্জ্যরে কারণে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। ঢাকা ওয়াসা পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলছে শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষণ বাড়ছে। এটা নিয়ন্ত্রণের দায় পরিবেশ অধিদফতরের। একে অপরকে দোষারোপ করা এভাবেই চলছে। কিন্তু দূষণ রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

ঢাকার পাশের শীতলক্ষ্যা দূষণে এখন ‘বিষাক্ত’। শীতলক্ষ্যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ৪১৭টি কল-কারখানা। যার মধ্যে ১০৫টি কারখানার কোনো বর্জ্য শোধনাগারই (ইটিপি) নেই। ফলে এসব কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় শীতলক্ষ্যায়। বাকি ৩১২টি কারখানার নামেমাত্র শোধনাগার থাকলেও তা ব্যবহার না করে গোপনে অথবা কৌশলে তারা শীতলক্ষ্যায়ই ফেলে দূষিত বর্জ্য। পরিবেশবিদরা বলছেন, শীতলক্ষ্যার এই ভয়াবহ দূষণ মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আর পানিতে দূষণ ছড়ানোর ফলে এবার মেঘনায় ইলিশ মাছের পরিমাণ অনেক কম। মেঘনার দূষণ এখনই রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে এখানে ইলিশ তো দূরের কথা অন্য জলজ প্রাণীও পাওয়া যাবে না। বুড়িগঙ্গা বা শীতলক্ষ্যা নদীর মতোই হবে মেঘনার অবস্থা।

পরিবেশ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোতে সাড়ে ৪ হাজার টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি গিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরে আশুলিয়া, সাভার, নতুন চামড়াশিল্প নগরী, টঙ্গী এলাকায় শিল্পকারখানা বাড়ছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীরে, পদ্মায় মাওয়া ঘাটের পাশে, মেঘনার তীরে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। এসব কারখানার বেশিরভাগই বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র ব্যবহার করছে না বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও নদী গবেষক ড. আইনুন নিশাত গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার নদীদূষণ কমাতে নানা পরিকল্পনা বা প্রকল্প তৈরির কথা শোনা যায়। তবে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রকল্প গ্রহণ না করলে এতে কোনো লাভ হবে না। প্রকল্পের নামে বছর বছর যেভাবে টাকা খরচ হচ্ছে অথচ কোনো কাজ হচ্ছে না। সমন্বিতভাবে কাজ না করলে এমনই চলতে থাকবে। তবে নদীদূষণ খুব দ্রুত রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাদের মৎস্যসম্পদ অনেক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সেই সাথে হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্র্য। দূষণের ফলে মেঘনায় ইলিশের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতেও দূষণের জন্য মা মাছ ডিম ছাড়তে আসছে না। সব মিলিয়ে নদীদূষণ আমাদেরকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটি এখনই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে এবং যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

তবে মেঘনার দূষণ রোধে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গা, বালু, ধলেশ্বরীসহ ছয়টি নদীর মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। মেঘনার দূষণ যাতে রোধ করা যায়, সে জন্যই মহাপরিকল্পনা করতে আইডব্লিউএম ও সিইজিআইএসের সঙ্গে গত ২৩ জানুয়ারি চুক্তি হয়েছে। মহাপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে সে অনুয়ায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় কাজ করবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীজলাশয় রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখছি, আমাদের নদীগুলো দূষণের পর্যায় থেকে বিষাক্ত হয়ে এখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নদী মরে যাওয়া মানে মানুষের খাওয়ার পানি, মাছ ও জলজ প্রাণীর বাসস্থান হারিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে অন্তত নদী রক্ষায় সরকার তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তিনি বলেন, নদী রক্ষায় সরকার করের অর্থ ব্যয় করেছে এবং ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করেছে। কিন্তু দুই বছরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার করতে পারেনি। তাই নতুন করে আরেকটি নদী দূষিত হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দূষণে বিষাক্ত নদী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ