Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এ জার্নি বাই ‘দ্রুতযান এক্সপ্রেস’

প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার। দিনাজপুর থেকে ঢাকা অভিমুখে ছুটছে আন্তঃনগর দ্রুতযান এক্সপ্রেস। দিনাজপুর স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ১ ঘণ্টা ১৭ মিনিট বিলম্বে ছাড়ে ট্রেনটি। ঢাকা পৌঁছতে পৌঁছতে সেই বিলম্বের দৈর্ঘ্য আরও বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে সবগুলো ট্রেনেই যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। ১৮ তারিখের দ্রুতযানেও তার কমতি ছিল না। দিনাজপুর থেকে যাত্রীবোঝাই করে ছাড়ে ট্রেনটি। এরপর যতগুলো স্টেশনে দাঁড়িয়েছে সবগুলো স্টেশনেই গাদাগাদি করে যাত্রী উঠেছে। তাতে বিপাকে পড়েন সেইসব যাত্রী যারা কষ্ট করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছেন। মানুষের ভিড়ে তাদের নিঃশ্বাস নেয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। এসি কেবিনেও বিনা টিকিটের যাত্রী ওঠায় যাত্রীরা ছিলেন অতিষ্ঠ। কয়েকজন যাত্রী এ নিয়ে অভিযোগও করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, দিনাজপুর থেকে ছাড়ার সময়ই ট্রেনটি প্রায় যাত্রীবোঝাই হয়ে যায়। পার্বতীপুর থেকে ওঠে কয়েকশ’ যাত্রী। এরপর যতগুলো স্টেশনে দাঁড়িয়েছে সবগুলো স্টেশনেই ছিল উপচেপড়া ভিড়। কে কার আগে উঠবে তা নিয়ে রীতিমতো লড়াই চলছিল যাত্রীদের মধ্যে। ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি আর চাপে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের নিয়ে সীমাহীন কষ্টে পড়েন শত শত যাত্রী। সান্তাহার স্টেশনে ভিড়ের চাপে একসাথে দুই বোন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রেলওয়ের আইনে ছাদে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ। অথচ যাত্রীদের ছাদে ওঠার জন্য মইয়ের ব্যবস্থা করেছিল ট্রেনের পরিচালক ও অ্যাটেনডেন্টরা। আলাপকালে জয়পুরহাট থেকে ছাদে ওঠা মমিনুল নামে একজন যাত্রী বললেন, মাত্র ৮০ টাকায় ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে ভালই লাগছে। ৮০ টাকার হিসাব দিতে গিয়ে তিনি জানান, ছাদে ওঠার মই ব্যবহারের জন্য দিতে হয়েছে ২০ টাকা। আর ছাদে বসে ঢাকায় যাওয়ার রেট ৬০ টাকা। এই টাকা তুলেছে পরিচালকের (গার্ড) লোকজন। প্রতিটি বগিতে একজন করে লোক নিয়োগ করা ছিল যারা ছাদের যাত্রীদের কাছে থেকে টাকা তুলেছে। আরেক যাত্রী জানান, ছাদে যাত্রী উঠতে দেরি হলে ট্রেনের গার্ড ইচ্ছা করে ট্রেন ছাড়ার সংকেত দিতে দেরি করেছেন। জয়পুরহাট স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার সিগন্যাল দেয়ার পরও অন্তত ১৫ মিনিট দেরিতে বেজেছে গার্ডের হুইসেল। এসব নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে সরব সমালোচনা চলছিল। দিনাজপুর থেকে ওঠা একজন সরকারি কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, সরকার ট্রেনের অবস্থা ফেরানোর জন্য কত চেষ্টা করছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রেলওয়েকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ বছরই হাজার হাজার কোটি টাকার অনুমোদন দিয়েছে একনেক। অথচ কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর কাছে জিম্মি হয়ে গেছে গোটা রেলওয়ে। এরা সেবার পরিবর্তে নিজেদের পকেট ভরতে ব্যস্ত। প্রসঙ্গ টেনে আরেক যাত্রী বলেন, এখন ট্রেনের গার্ড ও অ্যাটেনডেন্টদের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। এক ট্রিপে এরা হাজার হাজার টাকা রোজগার করে। বিনা টিকিটে যাত্রী উঠলেই এরা খুশি। বিনা টিকিটের যাত্রী তুলে তাদের কাছে থেকে ভাড়া আদায় করে পকেটে ভরে। প্রতিটি ট্রেনের একই অবস্থা। অথচ দেখার কেউ নেই। সান্তাহারে মই লাগিয়ে ছাদে যাত্রী তোলার দৃশ্য বর্ণনা করে আরেক যাত্রী বলেন, আমি দেখলাম নগদ ২০ টাকা করে নিয়ে ছাদে যাত্রী তোলা হচ্ছে। প্রশাসন কঠোর হলে এটা কখনই সম্ভব হতো না। ওই যাত্রী বলেন, ধরলাম ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের ভিড়। ছাদে যদি যাত্রী নিতেই হয় তবে অবশ্যই তাদের ভাড়া দেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত। সব টাকা কর্মচারীদের পকেটে যাবে তা তো হতে পারে না। দেরিতে ছাড়লেও দ্রুতযানের গতি দেখে যাত্রীরা খুশি। সান্তাহার থেকে ছাড়ার পর ট্র্রেনের গতি ক্রমেই বাড়ছিল। তাতে যাত্রীদের মনে একটা শান্তনা ছিল যে ট্রেনটি বিলম্ব কাটিয়ে ঢাকা পৌঁছাবে। নাটোর স্টেশন ছাড়ার পর মোটামুটি ভালোই চললো ট্রেনটি। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর আবার যাত্রীদের ঢল নামলো। এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল তাপানুকূল কেবিনের এসি মেশিন। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন যাত্রীরা। এসি কেবিনের দায়িত্বে থধাকা পরিচালক দুলাল মিয়ার কাছে এসি না চলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেবিন কোচের ছাদে যাত্রীরা এসির ফ্যানের উপর বসায় সেটি বাতাস টানতে পারছে না। এ কারণে এসি কাজ করছে না। একথা শুনে একজন যাত্রী ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, তাহলে আমরা এতো টাকা দিয়ে টিকিট কাটলাম কি জন্য। আপনারা এসি কেবিনটাকেও সুরক্ষা দিতে পারেন না কেন? এসব কথা যখন চলছিল তখন এসি কেবিনের গলিতে বিনা টিকিটের যাত্রীদের ভিড়। কেবিনের যাত্রীরা বাথরুমে যেতে পারছেন না ভিড় ঠেলে। এ নিয়ে কয়েকজন অভিযোগ করার পর বিনা টিকিটের যাত্রীদের সেখান থেকে বের করা হয়। তবে বাথরুমের সামনে যাত্রীদের জটলা থেকেই যায়।
গত ২ সেপ্টেম্বর মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে উন্নীত হয়েছে বহুল আলোচিত দ্রুতযান এক্সপ্রেস। লাগানো হয়েছে উন্নতমানের সাদা কোচ। এর আগে ট্রেনটি মিটারগেজে ছিল। তখনকার কোচগুলো এত উন্নত ছিল না। শুরু থেকেই দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি নানা কারণে সমালোচিত। রেলওয়ের ইতিহাসে এই ট্রেনটি সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর সোমবার দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে সিরাজগঞ্জের মুলিবাড়ী নামক স্থানে এই ট্রেনে কাটা পড়ে ৫ জন নিহতের ঘটনা ঘটে। এসময় উত্তেজিত জনতা ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেয়। অগ্নিকা-ে ইঞ্জিনসহ ১১টি বগি পুড়ে যায়। সেদিন থেকে ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যায়। ভস্মীভূত বগিগুলো মেরামত করে ১১২ দিন পর ট্রেনটি পুনরায় চালু করা হয়। এছাড়া ট্রেনটি কয়েকবার দুর্ঘটনায় পতিত হয়। গত বছরও ট্রেনের চালক (মিটারগেজ) সিগন্যাল উপেক্ষা চলার সময় ইঞ্জিনসহ কয়েকটা বগি লাইনচ্যুত হয়। রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হওয়ার পর আগের বদনাম ঘুচিয়ে ট্রেনটির জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়বে। কিন্তু এ কি তার নমুনা? আলাপকালে কয়েকজন জানালেন, আগের মিটারগেজের চালকদেরকে ব্রডগেজে পোস্টিং করার প্রক্রিয়া চলছে নিয়ম না মেনেই। মিটারগেজের চালকরা (এলএম, এএলএম) লালমনিরহাট বিভাগের অধীনে কর্মরত। তাদেরকে ব্রডগেজে নিতে হলে পাকশি বিভাগে বদলি করতে হবে। তা না হলে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে।
ট্রেনটি জয়দেবপুর থেকে ছাড়ার পর জানা গেল ঢাকা পৌঁছতে মাত্র ৫০ মিনিট লাগবে। কিন্তু লাগলো তার দ্বিগুণ সময়। এর কারণ টঙ্গী, ঢাকা বিমান বন্দর ও ঢাকা প্রবেশের আগে আউটারে ট্রেনটি বিনা কারণে দাঁড় করানো হলো বিনা টিকিটে যাত্রীদের নামার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। স্টেশনের প্রবেশের আগে ট্রেনটি যখন বার বার দাঁড়াচ্ছিল তখন হুড়োহুড়ি করে নামছিল বিনা টিকিটের যাত্রীরা। একজন যাত্রী সেই দৃশ্য দেখে আফসোস করে বললেন, হায়রে বাংলাদেশ রেলওয়ে। টিকিটওয়ালাদের এক পয়সা মূল্য নেই। যত বাড়তি সুবিধা বিনা টিকিটওয়ালের জন্যই। এরপর আর টিকিট কেটে বোকামি করব না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এ জার্নি বাই ‘দ্রুতযান এক্সপ্রেস’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ