ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আহমেদ নূর
একটা সময় ছিল মানুষ যখন আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যায়াম করতো না বটে, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে মানুষের অনেক বেশি ব্যায়াম হয়ে যেতো। এখন অনেক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার পর ডাক্তারের পরামর্শে নয়, বলতে গেলে ডাক্তারের নির্দেশে যে পরিমাণ ব্যায়াম করে থাকে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ব্যায়াম হতো। কিভাবে? হ্যাঁ, পরিশ্রমের কাজ করে করে। মানুষ আগে বেশি পরিশ্রমী ছিল। তাছাড়া অনেক রকম পরিশ্রম করতে মানুষ বাধ্যও হতো। যেমন : কৃষিসংক্রান্ত নানারকম কাজ করা, হেঁটে হেঁটে দূরের পথ পাড়ি দেয়া, সাংসারিক বিভিন্ন রকম পরিশ্রমের কাজ করা, মহিলাদের ঢেঁকিতে বিভিন্ন কাজ করা, গৃহস্থলীর অনেক শ্রমসাধ্য কাজ করা ইত্যাদি। এক কথায় আগেকার দিনে মানুষের শারীরিক শ্রমের কাজ ছিল বেশি। মানুষ খেতোও বেশি, পরিশ্রমও করতো বেশি। কিন্তু এখন মানুষের পরিশ্রমের কাজ অনেক কমে গেছে। পরিশ্রমের কাজ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষ অলসও হয়ে গেছে। দূরের পথ পাড়ি দেয়ার জন্য মানুষ এখন হাঁটতে হয় না, হরেক রকম যানবাহন মানুষকে বসিয়ে বসিয়ে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে। দূরের পথ নয়, সামান্য পথও মানুষ এখন হেঁটে যেতে চায় না। কয়েকমাস আগে একদিন আমি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমার পাশে একটা সিট খালি ছিল। পথে একজন ট্যাক্সিতে উঠলো। এক কিলোমিটার নয়, আধা কিলোমিটার যেতে না যেতেই তার গন্তব্য এসে গেলো! কেনো, এ সামান্য পথ কি তিনি হেঁটে ঁেহটে আসতে পারতেন না? এটা আমাদের আলসেমী বা আরামপ্রিয় হবার চরম বহিঃপ্রকাশ।
মহিলাদের এখন আর ঢেঁকিতে কাজ করতে হয় না, মেশিনেই সবকিছু হয়। আর ঢেঁকি তো ইতোমধ্যে যাদুঘরের আবশ্যকীয় উপাদানই হয়ে গেছে। জামাকাপড় এখন ধোয়া হয় ওয়াশিং মেশিনে। শুধু কাজ হচ্ছে বাজার থেকে কিনে আনবে আর গ্যাসের অটো চুলায় রান্না করে করে খাবে। বাজার থেকে আগে পুরুষরা বাজারের ব্যাগটাও হাতে বহন করে নিয়ে আসতো। কিছু পরিশ্রম হতো, ঘাম ঝরতো। আর এখন বাজারের ব্যাগ হাতে করে নিয়ে আসা দূরের কথা, অফিসের সামান্য পথও রিকশা বা গাড়িতে করে না গেলে প্রেষ্টিজ যেনো পুরোই পাংচার হয়ে যায়! যেসব বিল্ডিংয়ে লিফট আছে, সেসব বিল্ডিংয়েও মাত্র এক ফ্লোর উপরে বা নিচে যেতেও আমরা সিঁড়ি ব্যবহার না করে লিফট ব্যবহার করি!
পুরুষ-মহিলা সবাই পরিশ্রমের কাজ কমিয়ে দিয়ে আরামের জীবন বেছে নেয়ার এবং বসে বসে খাওয়ার পরিণতি আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি আর অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধছে বিপজ্জনক সব রোগ। যেমন : ডায়াবেটিস, প্রেসার, হার্ট ব্লক বা হার্ট অ্যাটাক। রোগগুলোতে যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন, তারা জানেন জীবনটা তাদের কাছে কতো জটিল মনে হচ্ছে। চলাফেরায় সাবধান থাকতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, খাওয়া-দাওয়ায় নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, পছন্দনীয় খাবার মনভরে খাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আর ওষুধ খেয়ে যেতে হচ্ছে। এ এক বড় দুর্বিষহ জীবন।
আরামপ্রিয় হয়ে আমাদের সুস্থ-সবল জীবন এখন ব্যারামে ব্যারামে বিধ্বস্ত। ঘামঝরানো শ্রম ছেড়ে দিয়ে আমরা এখন ভয়াবহ সব রোগে জর্জরিত। আমাদের অনেকের এখনো হুঁশ হয়নি। আমরা অনেকে এখনো মনে করি ডায়াবেটিস হচ্ছে বংশানুক্রমিক রোগ। বংশের কারো থাকলে নিজের এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের এ ধারণা কিভাবে সৃষ্টি হলো, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে শতকরা কয়জনের এ রোগ ছিলো, আর এখন শতকরা কয়জনের এ রোগ, তা একটু পরখ করলেই দেখা যাবে, উত্তরপুরুষদের এ রোগ বেশি; পূর্বপুরুষদের এ রোগ ছিলোই না বলতে গেলে। তাহলে উত্তরপুরুষদের কোত্থেকে এ রোগ ব্যাপকাকারে আক্রমণ করলো? শুধুমাত্র পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়ার প্রবণতাই এ রোগ সৃষ্টি হবার জন্য প্রধানত দায়ী; বংশের কারো থাক বা না থাক।
পরিশ্রম না করলে যে হার্টের রোগ হবার সম্ভাবনাও বেশি, তা নিয়েও একটু কথা বলা যাক। আমরা জানি, সাইকেল চালানোতেও বেশ পরিশ্রম হয়। কিন্তু সাইকেল চালানোর উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক অজ্ঞতা কাজ করে। আমরা অনেকেই মনে করি সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই মনে করি সাইকেল বেশি চালালে হার্টের সমস্যা হয় বা হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের মুখেই এমন কথা শুনেছি। কখনো বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করিনি। কয়েকমাস আগে একদিন আমি কর্মস্থল থেকে ফিরছিলাম। পথে আমার বন্ধু স্থানীয় এক লোকের সাথে দেখা হলো। কথায় কথায় তিনি আমাকে বললেন, ‘ভাই, সাইকেল না চালানোই ভালো। কারণ সাইকেল চালালে হার্টের সমস্যা হয়।’ তার কথা শুনে আমি সামান্য ভাবলাম। ভেবে তাকে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘ভাই, সাইকেল চালানোর কারণে হার্টের সমস্যা হয়েছে, আপনি দেখেছেন, এমন মাত্র একটা লোক আমাকে দেখিয়ে দিন, বেশি নয়।’ আমার কথার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তাহলে তিনি কথাটি বললেন কেনো? তিনি বলেছেন, কারণ সবাই এমন কথাই বলে। কিন্তু এটার কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের দেশে আমরা শুধু সাইকেল চালানোর অপকারিতার কথা বলে বেড়াই। চীন বা জাপানে মানুষ শুধু সাইকেল চালানোর উপকারিতার কথাই জানে। এজন্য তারা বেশি বেশি সাইকেল চালায়। ‘জাপান কাহিনী’ নামক একটা বইতে দেখলাম, জাপানে নাকি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সপ্তম শ্রেণি থেকে সকল শিক্ষার্থীকে সাইকেল চালিয়ে প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়, তাদের বাবা যতো বড় ধনী হোক না কেনো। সাইকেল বেশি বেশি চালায় বলেই এসব দেশের লোক মুটিয়ে যায় না, এদের শারীরিক ফিটনেসও দীর্ঘদিন ঠিক থাকে, এদের গড় আয়ুও সঙ্গত কারণেই বেশি। আর আমরা সাইকেল চালানোকে নিরুৎসাহিত করি বলে বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি, বিভিন্ন রোগে অল্প বয়সে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছি। আমাদের দেশে এখন তো রিকশাগুলোতে মটর লাগিয়ে চালানো হয়। কিন্তু এর আগে বছরের পর বছর মানুষ পায়ে চেপেই রিকশা চালাতো। অন্তত বিশ বছর এভাবে রিকশা চালিয়েছে, এমন লোকের হার্টের সমস্যা হবার ঘটনা নেই বললেই চলে। কোনো? কারণ রিকশা চালাতে যথেষ্ট ঘামঝরানো শ্রম হয়। এই ঘামঝরানো শ্রম আমরা যতো বেশি করবো, আমাদের হার্ট ভালো থাকার সম্ভাবনা ততো বৃদ্ধি পাবে।
প্রেসারের অন্যতম কারণও আমার মনে হয় পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়া। অধিকাংশ প্রেসারের রোগীর মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা। আর যেসব লোক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, তাদের ডায়াবেটিস, হার্ট উইকনেস যেমন খুব একটা হয় না, প্রেসারও তেমন একটা হয় না। এজন্য যারা রোগগুলো থেকে এখনও মুক্ত আছেন, তাদের উচিত বেশি বেশি কায়িক শ্রমের কাজ করা। শ্রম মানুষের শরীরকে সুঠাম রাখে, রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখে। মনে রাখতে হবে, কায়িক শ্রম বলতে বুঝায় শরীর থেকে ঘাম বের হয় এমন কাজ করা। আপনি আপনার অফিসে বসে আছেন, বিদ্যুৎ নেই বলে আপনার শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই কোনো পরিশ্রমের কাজ নয়! আপনি কিভাবে নিয়মিত পরিশ্রম করবেন, আপনিই ঠিক করে নিন। অফিস যদি দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে হয়, সম্ভব হলে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে যাতায়াত করুন, না হয় সাইকেল চালিয়ে। বাজারের ব্যাগটি অতিরিক্ত ওজন না হলে হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাসায় নিয়ে আসুন। মনে রাখবেন, প্রেষ্টিজ রক্ষা করা আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়। শেষে একটি সুখবর দিয়ে লেখা শেষ করছি। বসে বসে বেশি খেলে আপনি রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষে খেতেই পারবেন না। আর পরিশ্রম করে বেশি বেশি খেলেও আপনার শরীরে বিপজ্জনক কোনো রোগ বাসা বাঁধবে না। আপনি খেয়ে যেতে পারবেন দীর্ঘদিন, নিশ্চিন্তে। সুতরাং বেশি বেশি খাওয়ার জন্য বেশি বেশি পরিশ্রম করুন!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।