ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ড. উর্মি বিনতে সালাম
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আশাবাদী মানুষগুলো নিশ্চয়ই প্রতিদিন খুঁজে বেড়াচ্ছে কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের দেশ মাথা উঁচু করার মত অগ্রগতি সাধন করছে। একটি বিষয়কে আমরা গর্ব করে উল্লেখ করতে পারি, সেটি হলো: আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে (ডিপিই) তথ্য মতে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। আমাদের দেশে রয়েছে ৬৩ হাজার ৪১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে ছাত্রছাত্রী রয়েছে মোট ১ কোটি ৯৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৭৯ জন। এ বিশাল পরিসরের ছাত্রছাত্রীকে বা আগামী দিনের জাতির কর্ণধারদের যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত ও সত্যিকারের মানুষরূপে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। আমার এ কথার বড় স্বীকৃতি হলো, আমাদের দেশের পবিত্র সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭। সেখানে বলা হয়েছে, সেকেন্ডারি বা উচ্চ মাধ্যমিক লেবেল পর্যন্ত শিক্ষা হবে সম্পূর্ণরূপে বিনামূল্যে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই বাংলাদেশের সকল শিশুই যেন প্রাথমিক শিক্ষার ধাপ সম্পন্ন করতে পারে বা কোন শিশুই যেন প্রাথমিক শিক্ষা হতে বঞ্চিত না হয় তার জন্য একটি প্রকল্প চলমান রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় বাজেট-২০১৬ তে ৩৫,১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪,৪৫১ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৭ শতাংশের মত। আমাদের সকলেরই জানা রয়েছে যে, বিশ্বায়নের দ্রুততম প্রবাহে শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দিনকে দিন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। বাস্তবিক পক্ষে, এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি না করে বিশ্বায়নে টিকে থাকাই প্রায় অসম্ভব! কারণ মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশটির উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপই হলো শিশুদের জন্য যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। একই সাথে এ খাতকে অবশ্যই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বর্তমানে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা এগুচ্ছে মূলত তিনটি খাতের প্রবাহ দ্বারা; যা হচ্ছে কৃষি, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি। আর যদি আমরা এ খাতে নিয়োজিত কর্মীদের যথাযথ শিক্ষা/প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি তবে নিশ্চয়ই আমাদের অর্থনীতি পাবে নতুন রূপ এবং কমবে দেশের দারিদ্র্য আমাদের চিরাচরিত প্রাথমিক শিক্ষা এখন পর্যন্ত গুণগতমানসম্পন্ন নয়। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষার প্রথাগত পরিকল্পনা দ্বারা আমরা দরিদ্র বিমোচনের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হব না। এখন পর্যন্ত আমরা সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে পারিনি, এমনকি ঝরেপড়া শিশুর সংখ্যাও একেবারে কম নয়Ñ যা আমার উপজেলায় (কর্মস্থলে) ১৩৭৫ জন (প্রায়)। এর প্রধান কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি পেলাম দারিদ্র্য। দরিদ্র জনপদের অনেক পরিবারে এখনও ভাবা হয়, শিশু সদস্যটি বিদ্যালয়ে না গিয়ে কাজে নিয়োজিত থাকলে ঐ পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে। অর্থাৎ ক্ষুধার জ্বালায় শিক্ষা সেখানে গুরুত্বহীন। এ মারাত্মক পরিস্থিতি উত্তরণে আমি সরকারি প্রয়াসের পাশাপাশি সামর্থ্যবান-বিবেকবান কুলিয়ারচর উপজেলাবাসীকে সংযুক্ত করতে পেরে আনন্দিতবোধ করছি। তাদের নিয়ে কাজ করতে আমি নি¤œলিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি :
মিড-ডে মিল চালু করা : বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য মিড-ডে মিল চালু করার ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যালয়ে আসার আগ্রহ বাড়ছে। এ ছাড়াও অসচ্ছল পরিবারগুলো কাজে নিয়োজিত শিশু সদস্যকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছে।
টিফিন বক্স বিতরণ : এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যালয়ে টিফিন আনার অভ্যাস গড়ে উঠছে এবং দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার যে সমস্যা তার অবসান ঘটছে।
শিক্ষা উপকরণ (খাতা-কলম-স্কুল ব্যাগ) বিতরণ : আমরা সকলেই অবগত রয়েছি যে, শিক্ষাকে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে নানান প্রকল্প নিচ্ছে- এর মধ্যে রয়েছে বছরের প্রথম দিনেই ছাত্রছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া, উপবৃত্তি চালু রাখা, বিনা বেতনে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা, শিক্ষার মান উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া ইত্যাদি। তথাপিও আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকতর কর্মসূচির যৌক্তিকতা থেকেই যায়। এ প্রেক্ষিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা ও তার সমাধানের জন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে মিড-ডে মিল চালু, টিফিন বক্স ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে অধিকন্তু অসচ্ছল পরিবারগুলোর শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যয়ও কমছে। তাই এ কর্মসূচিগুলো গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
স্বাস্থ্য রক্ষায় টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, সেন্ডেল, জুতা-মুজা, ছাতা বিতরণ : এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে। শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে দেশে-বিদেশে নানান কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে- যেমন বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস, বিশ্ব টিকা সপ্তাহ, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ইত্যাদি। এ দিবসগুলোর পাশাপাশি শিশুদের টেকসই স্বাস্থ্য সচেতন করতে এবং সুস্থ থেকে তাদের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে উপরোক্ত কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শ্রেণীকক্ষে আইসিটির ব্যবহার হিসেবে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর স্থাপন : এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আইসিটির ব্যবহারসহ প্রযুক্তি বিষয়ক সচেতনতা বাড়ছে। শিক্ষকদের জন্য পাঠদান সহজ হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের জন্যও পাঠ সহজে বোধগম্য হচ্ছে। গ্রামীণ জনপদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিকমানের শ্রেণীকক্ষের স্বাদ গ্রহণ করছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাছের চারা বিতরণ : এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বপরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এর মানে হলো বিশ্বপরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের নেতৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ স্বীকৃতিকে অক্ষুণœ রাখা, বেগবান করা এবং এসডিজি বাস্তবায়নে শিশুদের পরিবেশ রক্ষা ও নিরাপদ পৃথিবী গড়ায় অভ্যস্ত করার কোন বিকল্প নেই। তাই শিশুদের নিরাপদ বিশ্ব গড়ায় অঙ্গীকারাবদ্ধ করতে এ কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সরকারের পাশাপাশি প্রশাসনের আন্তরিকতায় ও স্থানীয় উদ্যোগে সামর্থ্যবান ব্যক্তিগণের সহায়তা দ্বারা উল্লিখিত কর্মসূচির ফলে এ উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে উপস্থিতির হার, কমেছে ঝরেপড়ার হার, বেড়েছে স্বাস্থ্য ও জনসচেতনতা যা আমাদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণসহ সচেতন মানবসম্পদ গড়তে ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়াও উল্লিখিত কর্মসূচিগুলো ক্রমাগত চলতে থাকলে তা শিক্ষার মান বৃদ্ধিসহ সরকারের রূপকল্প ও ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার,
কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।