পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হাসান সোহেল : কোরবানির পশুর চামড়ার হকদার হলো প্রতিবেশী ফকির-মিসকিন, গরিব আত্মীয়-স্বজন ও মাদরাসাপড়–য়া বাবা-মাহারা এতিম। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় ঈদুল আযহায় যারা পশু কোরবানি দেন তাদের কেউ পশুর চামড়া স্থানীয় মাদরাসায় দান করেন; কেউ বিক্রি করে অর্থ ফকির-মিসকিন ও মাদরাসার গরিব ছাত্রদের জন্য দান করেন। কোরবানির চামড়ার দানের অর্থে পরিচালিত হয় হাজার হাজার মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং। সমাজের দানশীল ও বিত্তবান ব্যক্তিদের অর্থে গড়ে ওঠা মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো শত শত বছর ধরে এভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এই রেওয়াজ রাজধানী ঢাকাসহ শহর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্রই। লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোর খরচের বড় অংশ আসে সাধারণ মানুষের কোরবানির পশুর দানকরা চামড়ার অর্থ থেকে। কিন্তু সেই গরিবের হক কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছেন সম্পদশালী ব্যবসায়ী, ফড়িয়া এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় উপনেতা, পাতি নেতারা। মিসকিন ও মাদরাসাপড়–য়া ইয়াতিমদের হকের ওপর থাবা বসানো হয় কোরবানির ঈদের আগেই। কোরবানির আগেই চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম কমিয়ে দেন। আবার স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী ছেলেছোকড়া, ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং মস্তান-পাতিমস্তানরা মহল্লা ও গ্রামের মানুষকে তাদের কাছে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করে। অতঃপর তারা যখন পাইকার ও চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে যান তখন তারা আবার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নির্ধারিত মূল্যের কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন। একের পর এক সিন্ডিকেটে পড়ে গরিবের হক কোরবানির চামড়ার অর্থ চলে যাচ্ছে বিত্তবানদের পকেটে। আর কোরবানির চামড়ার টাকার প্রকৃত হকদার পাড়া-মহল্লার গরিব মানুষ ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়া এতিম তালেবে ইলমরা বঞ্চিত হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে কোরবানির চামড়ার ওপর শকুনের থাবায় চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়ছে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা মাদরাসাপড়–য়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। সমাজের বিত্তবানদের দানে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিয়ে তাই অনেকেই বিপাকে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এবার পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চতুর্মুখী সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে দেশের চামড়ার বাজার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চামড়া কেনা ক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থের ভাগীদার হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিন।
প্রতিবছর চামড়ার মোট চাহিদার সিংহভাগের যোগান আসে কোরবানি ঈদে। একই সঙ্গে দেশের হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিনদের সারা বছরের অর্থের যোগানও আসে কোরবানির ঈদের চামড়া থেকে প্রাপ্ত সহায়তার মাধ্যমে। বিপুল সংখ্যক মাদরাসা ছাত্র ঈদের চামড়ার টাকায় সারাবছর বিনা খরচে লেখাপড়া করে। কিন্তু চতুর্মুখী সিন্ডিকেটের কারণে এসব মাদরাসা ছাত্র, এতিম ও মিসকিনরা তাদের ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে ছোটদের হক বঞ্চিত করে মুনাফালোভীরা যেন আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়েছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে এলাকার প্রভাবশালী ছেলেছোকড়া, ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং মাস্তান-পাতিমাস্তানরা মহল্লা ও গ্রামের মানুষকে তাদের কাছে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে দেশের হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
কোরবানির চামড়া নিয়ে চতুর্মুখী সংকট দেখা দিয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ী যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন, তাদের অভিযোগ, গতবারের মতো এবারও চামড়া কিনে মাথায় হাত পড়েছে। যে দরে কিনেছেন, সেই দরে বিক্রি করতে পারছেন না। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আড়তদাররা যে চামড়া কিনে থাকেন, তাদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা এবার চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে কমিয়ে নির্ধারণ করেছেন। লোকসানের ভয়ে তারাও বেশি দামে চামড়া কিনতে পারছেন না। আবার রাজধানীর পোস্তা ও হাজারীবাগের চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণের সংকট ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতি পিস চামড়ায় তাদের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় বেড়েছে। তাই ব্যবসায়ীরাও চামড়া কিনে ভবিষ্যতে কতটা লাভের মুখ দেখবেন এ নিয়ে শঙ্কায় আছেন। উপরন্তু তাদের হাতে গতবারের কেনা প্রায় আরও ৩০ শতাংশ চামড়া মজুদ রয়ে গেছে। এছাড়া সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জটিলতায় এবারের সংগ্রহ করা চামড়া নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় বেশি দামে বিক্রির আশায় পাচার হয়ে যেতে পারে চামড়া। তবে পাচার রোধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সূত্র মতে, বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কমে যাওয়া এবং দেশে লবণের সংকটের প্রেক্ষাপটে এবার কোরবানির ঈদের চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছিল চামড়া খাতসংশ্লিষ্ট তিনটি সংগঠন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ স্কিন অ্যান্ড হাইড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন এ দর নির্ধারণ করে দেয়। এতে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
অথচ দুই বছর আগে ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা ও খাসির চামড়ার দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এরপর থেকে ক্রমাগত হ্রাস পেতে শুরু করে চামড়ার দাম। ২০১৪ সালে গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ হয় ৭০ থেকে ৭৫। ২০১৫ সালে আরও হ্রাস পেয়ে গরুর চামড়ার প্রতি বর্গফুট মূল্য ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় এসে দাঁড়ায়। এবার তা আরও তলানীতে ঠেকেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরে কাঁচা চামড়ার সংগ্রহ মূল্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
কিন্তু এ বছর সারাদেশে লবণ ছাড়াই কাঁচা চামড়া ঈদের দিন ও পরদিন ৯০ টাকা পর্যন্ত দামে কেনাবেচা হয়। একটি গরুর চামড়া ২৫ থেকে ৩৫ বর্গফুট হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। সেই হিসাবে ৩০ বর্গফুটের একটি চামড়ার দাম ঢাকার বাইরে হওয়ার কথা ১২০০ টাকা। অথচ লবণ ছাড়াই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১ হাজার থেকে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত দামে চামড়া কেনা-বেচা হয়েছে। এরপর একটি চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ হবে আরো ২শ’ টাকা। এই অতিরিক্ত দামে চামড়া কিনে এখন লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন আড়তদাররা। যদিও যারা কোরবানি দিয়েছেন তারা চামড়ার দাম পাননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। চামড়ার দাম নেই দোহাই দিয়ে গ্রামের মৌসুমী চামড়া ক্রেতারা ৫০ হাজার টাকার দামের গুরুর চামড়া ১০০ টাকায়ও কিনেছেন।
বরিশালের উজিরপুর থানার মৌসুমি চামড়া ক্রেতা সাদ্দাম হোসেন জানান, তিনি ১০০ টাকা দিয়েও চামড়া কিনেছেন। সাদ্দাম হোসেন জানান, উজিরপুর থানার শোলক গ্রাম ঘুরে ১১টি চামড়া ক্রয় করেন। গড়ে প্রতিটি ৪শ’ টাকা পড়েছে। অথচ সাদ্দাম হোসেন ১১টি চামড়া ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছেন আরেক চামড়া ব্যবসায়ীর কাছে। সে এই চামড়া আবার বিক্রি করেছেন আড়তদারের কাছে। এখানে মৌসুমি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মধ্যস্বত্বভোগীরা বড় অঙ্কের অর্থ মুনাফা করলেও চামড়ার টাকার হক থেকে হতদরিদ্র মানুষ, এতিম ও মিসকিনরা হয়েছেন বঞ্চিত।
তথ্য অনুযায়ী, গত বছর কোরবানিতে সংগৃহীত হয়েছিল প্রায় ৭৫ লাখ চামড়া। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে ৪০ লাখ ৬১ হাজার গরু কোরবানি হয়েছিল। এবার গরু কোরবানি আরও প্রায় ১০ শতাংশ বাড়বে বলে থেকেই বলেছে বিবিএস। এ হিসাবে প্রায় ৫০ লাখ গরু কোরবানি হবে। ছাগল, মহিষ, ভেড়াসহ অন্যান্য মিলেয়ে ৮৫ লাখ চামড়া হওয়ার কথা।
অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত চামড়া শিল্প। এ শিল্পের অধীনে আছে ২২০টি ট্যানারি। অসংখ্যা জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ও দর্শনীয় সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানা। সরাসরিভাবে এ েিশল্প নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কর্মচারী। স্থূল দেশজ আয়ে (জিডিপিতে) চামড়া শিল্পের অবদান শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ। মোট রফতানি আয়ে এ খাতের অবদান ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। রফতানি আয় অর্জনের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের পরই এ খাতের অবস্থান। বছরের পর বছর এ খাতের রফতানি আয় বাড়ছে। কিন্তু চামড়া উৎপাদনকারী কৃষক, প্রান্তজন, এতিম ও মিসকিন বাড়তি রফতানি আয়ের ন্যায়সঙ্গত হিস্যা পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০২-০৩ সালে এদেশের চামড়া রফতানির আয় ছিল ২২৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১১-১২ সালে তা বেড়ে ৫২৪ দশমিক ৮, ২০১২-১৩ সালে ৬৯২ দশমিক ৬, ২০১৩-১৪ সালে ১ হাজার ৭ দশমিক শূন্য, ২০১৪-১৫ সালে ১ হাজার ১৩০ দশমিক ৫ এবং ২০১৫-১৬ সালে তা ১ হাজার ১৬০ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়। তবে এ সময় চামড়ার রফতানি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে, বেড়েছে জুতা ও চামড়াজাত অন্য দ্রব্যসামগ্রীর রফতানি। অর্থাৎ আমাদের চামড়া শিল্পে বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্যতা এসেছে। বিদেশে সম্প্রসারিত হয়েছে চামড়া শিল্পের বাজার।
এবারের কাঁচা চামড়ার বাজার নিয়ে এই অস্থিতিশীল অবস্থার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, চারটি কারণে এবার কাঁচা চামড়ার বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, লবণের সংকট রয়েছে, দামও বেশি পড়ছে। ফলে গতবারের তুলনায় চামড়া সংরক্ষণে ব্যয় বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আবার আন্তর্জাতিক চামড়ার বাজারে মন্দা রয়েছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলমান থাকার কারণেও অনেক ট্যানারি মালিক গতবারের কেনা চামড়ার মূল্য পরিশোধ করেননি। ফলে এবার চামড়া কেনায় তহবিল সংকট রয়েছে। এ ছাড়া আগের বছরের ঈদে কেনা চামড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ তাদের কাছে মজুদ রয়ে গেছে। চতুর্মুখী এ সংকট থাকা সত্ত্বেও চামড়ার যে দাম ঘোষণা করা হয়েছিল, এর চেয়ে বেশি দামেই ঢাকায় ভালো মানের চামড়া কেনা হচ্ছে বলে জানান তিনি। দেলোয়ার হোসেন বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার মান বোঝেন না। সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণও করতে পারেন না তারা। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে চামড়ার দরের তারতম্য হয়। তবে ভালো মানের চামড়া প্রতি বর্গফুট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, এমনকি এর চেয়ে বেশি দরেও ঢাকায় কেনা হচ্ছে।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ স্কিন অ্যান্ড হাইড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হাজি টিপু সুলতান বলেন, আমরা বারবার বলেছি, এবার চামড়ার দাম কম। সংবাদ সম্মেলন করে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তারপরেও যারা বেশি দামে চামড়া কিনেছেন তারা এর দায়ভার বহন করবেন। অনভিজ্ঞ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কারণেই প্রতি বছর এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, চোখের আন্দাজে চামড়া কিনতে হয়। এখন দেখা যায়, সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ একজন মানুষ যে চামড়া ৩০ বর্গফুট ধরে কিনে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন, তা আমাদের হিসাবে হয়ে যায় ২৫ বর্গফুট। এদের কারণেই চামড়ার বাজার অস্থির হয়ে ওঠে।
এ অবস্থায় চামড়া পাচারের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অতিরিক্ত দামে চামড়া কেনার পরে ব্যবসায়ীরা তা মুনাফাসহ ট্যানারিতে বিক্রি করতে না পারলে তা পাচার হয়ে যেতে পারে। তবে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল মো. জিল্লুল হক বলেন, আমাদের জাতীয় সম্পদ চামড়া পাচার ঠেকাতে আগে থেকেই বিজিবি সতর্ক রয়েছে। সীমান্তের আশপাশে ট্রাক, ভ্যান বা এ জাতীয় যানবাহ চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। একটি চামড়াও আমরা পাচার হতে দেব না। এখন পর্যন্ত (গতকাল বিকেল) চামড়া পাচারের কোনো খবর আমাদের কাছে আসেনি।
কিছু প্রভাবশালীর অপতৎপরতা : রাজধানীর অনেক এলাকায় সাধারণ লোকদের কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করছেন স্থানীয় যুবকরা। তাদের দেয়া নির্ধারিত দামে চামড়া না দিলে হুমকি-ধমকি দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাউকে পরে টাকা দেয়ার কথা বলেও অনেকের চামড়া ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
রাজধানীর আশকোনার লিয়াকত আলী ৮০ হাজার টাকা দিয়ে কোরবানির জন্য গরু কিনেছিলেন। কিন্তু ওই এলাকার স্বেচ্ছাসেবক দলের পরিচয় দিয়ে কয়েকজন যুবক মাত্র ৫শ’ টাকা দিয়ে গরুটির চামড়া নিয়ে গেছে। তার মতো সবার কোরবানির চামড়াই কম দামে নিচ্ছেন মহল্লার ছেলেরা। যারা রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন অঙ্গসংঠনের সঙ্গে যুক্ত।
জানা গেছে, ঈদ মৌসুমে চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যারা ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে একটি নির্দিষ্ট দামে চামড়া সরবরাহ করে থাকে। সরকার নির্ধারিত দামে তো নয়ই অনেক সময় লুট করে চামড়া নিয়ে নিয়েছে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
এই সিন্ডিকেটের সদস্য উত্তর বাড্ডার আলীর মোড়ের বরকত আলী জানান, চামড়াপ্রতি আমরা তিন-চারশ’ টাকা লাভ করি। এইটা এমুন কী? এসব ট্যাকা তো হুজুরেরাই খায়।
বনশ্রীর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একদল যুবক কয়েকটি বাড়ি থেকে জোর করে চামড়া নিচ্ছেন। মালিক জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, রামপুরার রাস্তায় গেলে তাদের দাম দেয়া হবে। ওই যুবকরা মালিকদের নাম আর চামড়ার রং লিখে রাখছেন।
ওই এলাকার রফিক নামে এক ভাড়াটিয়া চামড়া দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেন দুজন যুবক। কাঁঠালবাগানের সিন্ডিকেটের অপর এক সদস্য কবির জানান, তারা কোনো দল করেন না, এলাকার পোলাপান হিসেবে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছেন।
মাথায় হাত মৌসুমি ব্যবসায়ীদের : দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চড়া দামে কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয় করে এবার বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ বছর ঢাকায় কোরবানির গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতায় নেমে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বর্গফুটের হিসাব না করে অধিক দামে চামড়া সংগ্রহ করেন।
বরিশালের উজিরপুর থানার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সাহাদাৎ মৃধা জানান, বর্গফুটের হিসাব না বুঝে এবার তারা ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা দিয়ে প্রতি পিস চামড়া সংগ্রহ করেন। এই আকারের চামড়া তারা গতবার ১৫শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। কিন্তু এ বছর আড়তদাররা প্রতি পিস চামড়া ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে চাইছেন না। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। একই অভিযোগ চট্টগ্রাম এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের।
বরিশাল নগরির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চা-দোকানি কবির হোসেন। বাড়তি কিছু আয়ের আশায় আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে মঙ্গলবার ঈদুল আজহার দিন আট পিস গরুর চামড়া কিনেন। সব মিলিয়ে তার প্রতি পিস চামড়ার গড় ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ২২৫ টাকা করে। কিন্তু ওই দিন বিকালে নগরির পদ্মাবতী আড়তে চামড়ার আড়তদাররা ওই চামড়ার মূল্য বলেছেন গড়ে ৯০০ টাকা করে। এতে মাথায় হাত উঠেছে কবিরের। কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে এবার বেকায়দায় পড়েছেন রাজশাহীর ব্যবসায়ীরাও। লবণের দাম বেড়ে যাওয়া এবং দেরিতে আড়তে নিয়ে আসায় চামড়া নষ্টের শঙ্কাও করছেন তারা। দুই দিন ধরে রাজশাহীর আড়তগুলোতে শুরু হয়েছে চামড়া সংরক্ষণের কাজ। তবে দাম নিয়ে শঙ্কায় আছেন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় বেলপুকুর আড়তের ব্যবসায়ীরা। পুঠিয়ার বেলপুকুরের চামড়া ব্যবসায়ী বদিউজ্জামান জানান, সংরক্ষণ করতে এবার ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। গত বছরের তুলনায় লবণের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। দেরিতে আড়তে নিয়ে আসায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে দেশের অন্য জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে। ঈদের দিন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে প্রতিটি ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। গরুর চামড়ার দাম পড়েছে ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন এমন এক আড়তদার সিলেটের কামাল আহমদ জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া মূল্য বিবেচনা না করে তাদের মনগড়া দাম দিয়ে চামড়া কিনেছেন। তাই তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনার পর এগুলো থেকে মাংসের টুকরো অপসারণ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে ঢাকায় পরিবহন করতেও তাদের অনেক খরচ হয়েছে বলে জানান ওই আড়তদার।
পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকায় চামড়া বিক্রি করতে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর চামড়া ক্রয় করতে গিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। তাদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন মূল্যে চামড়া বিক্রি হয়েছে। তারা যে দামে চামড়া কিনেছেন, আড়তদারদের কাছে এর চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে।
পোস্তা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রিকশা বা ভ্যানে করে চামড়া নিয়ে এলেই দৌড়ে যাচ্ছেন আড়তদারেরা। তবে তাদের দাম শুনে মুষড়ে পড়ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, কেনা দামের চেয়ে এবার আড়তে ৩০০-৪০০ টাকা দাম কম বলা হচ্ছে। এতে করে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কায় পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে আড়তদারদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামেই তারা চামড়া কিনছেন। এখন লবণের দাম বেশি, শ্রমের মূল্য বেশি। তাই তারা যে দামে চামড়া কিনছেন, তা ঠিকই আছে।
লবণ সঙ্কট, দামও বেশি : ঢাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়া সংরক্ষণের জন্য গতবার যে লবণের (৭৪ কেজি) বস্তা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় কিনেছেন, এবার তা কিনতে তিন থেকে চারগুণ বেশি দাম পড়ছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে প্রতি বস্তা লবণ ছিল ১৫শ’ টাকা, যা ঈদের দিন দুই হাজার টাকা এবং ঈদের পরদিন ১৭শ’ থেকে ১৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।