Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শোলাকিয়ায় ‘ইতিহাসে উল্টো স্রোত’

প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : ঐতিহাসিক শোলাকিয়া এখন ইতিহাসের উল্টো স্রোতে প্রবাহমান। ২৬১ বছরের ইতিহাসে এবার স্মরণকালের সবচেয়ে কম মুসুল্লি ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করেছেন ওই মাঠে। এলাকার ভূমিপুত্ররা (কৃষক-শ্রমিক- ক্ষেতমজুর) বংশ পরম্পরায় দূর দূরান্ত থেকে এসে লাখো মুসুল্লির সঙ্গে শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত। ‘কুটিল রাজনীতি’ থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ রাজনীতির ‘দুগন্ধ’ পেয়েই বাপ-দাদাদের ঈদের মাঠ শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন। মিডিয়ার খবর এবং এলাকাবাসীর তথ্যে দেখা যায় এবার ঈদের নামাজে যত মুসুল্লি নামাজ আদায় করেন শোলাকিয়ায়; তার চেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। অথচ বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ধর্মপ্রাণ মানুষ ময়দানে ও মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন।
ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার মাঠের পাশে জঙ্গি হামলার মতো অনাখাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ত্বড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণে জঙ্গিরা পরাজিত হলেও দুইজন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান। ঢাকার গুলশানের ঘটনার পর শোলাকিয়ায় এ ঘটনা; অতঃপর ঢাকার কল্যাণপুরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘জঙ্গি দমনে’ ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠে। ঈদুল ফিতরের মতো যাতে ঈদুল আজহায় শোলাকিয়ায় কোনো জঙ্গি হামলার মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে সে জন্যই আগ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। ঈদের দিন পুলিশ, র‌্যাব, আনসার বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবিও মোতায়েন করা হয়। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যেই শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। অনাকাক্সিক্ষত বৃষ্টির কারণে ঈদের দিন মুসল্লিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তারপরও রাজধানী ঢাকার জাতীয় ঈদগাঁহ ময়দানসহ সারাদেশের মুসল্লিরা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে বৃষ্টিতে ভিজে কেউ ময়দানে কেউ মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন। অধিকাংশ ঈদের জামাতে মুসল্লিদের উপস্থিতি ছিল উপচে পড়া। অথচ শোলাকিয়ায় মাঠে মুসল্লিদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
এদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে একের পর এক সাফল্য দেখাতে পারছে।
দেশের সাধারণ মানুষের সহায়তায় জঙ্গি দমনে সাফল্য এসেছে এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা স্বীকারও করেন। জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেন না অথচ দেশের সাধারণ মানুষ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি ধর্মপ্রাণ। শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় দেখা যায় মসজিদের বাইরে রাস্তায়ও বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ নামাজ আদায় করছেন। ধর্মপ্রাণ সেই মানুষ ঈদের ওয়াজিব নামাজ আদায়কে ‘উৎসব’ মনে করেন। পরিবারের ছোট-বড় সদস্যরা এক সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য মাঠে যান। ঢাকাসহ সারাদেশে ঘটেছে ঈদের দিন। ব্যাতিক্রম শুধু দেখা গেছে শোলাকিয়ায়। অথচ প্রতি ঈদে ঐতিহাসিক ওই মাঠে ৪ থেকে ৫ লাখ মুসুল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন। কারণ কি? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া মাঠের আশপাশের ভূমিপুত্ররা ঈদের নামাজে ‘রাজনীতি মুক্ত’ দেখতে অভ্যস্ত। অথচ হঠাৎ করে সেখানে বিতর্কিত ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়। ক্ষণে ক্ষণে রং বদল করা এবং জঙ্গিবাদের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগকারী ওই ব্যক্তির হঠাৎ ‘রাজ আলেম’ হয়ে ঈদের মাঠে রাজনীতি আমদানী তারা পছন্দ করছেন না। যার কারণে মুসল্লিরা ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অথচ তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন অধিক মানুষ এক সঙ্গে নামাজ আদায় করলে সওয়াব বেশি।
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের নাম দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও প্রচারিত। এতো বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এক সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন এমন ময়দানের পৃথিবীতে কমই আছে। বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এই শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। ১৮২৮ সাল থেকে নিয়মিত ঈদের বড় জামাত অনুষ্ঠিত হলেও শোলাকিয়া মাঠে প্রথম ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় ১৭৫০ সালে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর বংশধর দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ-এর ওয়াকফনামায় ১৭৫০ সাল থেকে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে লেখা রয়েছে। এ তথ্যানুযায়ী শোলাকিয়া মাঠের বর্তমান বয়স ২৬১ বছর। জঙ্গলবাড়ির জমিদার ১৮২৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করতেন।
ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে সুদূর ইয়েমেন থেকে আগত শোলাকিয়া ‘সাহেব বাড়ির’ পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। ওই ৭ একর জমির ওপর ওই ঈদের মাঠের জামাতে ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমেদ। সে দিনের ঈদের জামাতে প্রায় সোয়া লাখ (১ লাখ ২৫ হাজার)) মুসুল্লির জমায়েত হয়। কারো মতে, সোয়া লাখ থেকে এক সময় পরিবর্তিত হয়ে মাঠের নাম মানুষের মুখে মুখে ‘শোলাকিয়া’ চালু হয়ে যায়। আবার কারো কারো মতে, মোগল আমলে ওই পরগণার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। সেখান থেকেই শোলাকিয়া নামকরণ। নরসুন্দা নদীর তীরের শোলাকিয়া ঈদ মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫শ’ জন করে মুসল্লির দাঁড়ানোর ব্যবস্থা আছে। ফলে মাঠের ভেতরেই এক লাখ বত্রিশ হাজার ৫শ’ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে ঈদের সময় দেখা যায়, আশপাশের সড়ক, খোলা জায়গা, এমনকি আশপাশের বাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। নামাজ শুরুর আগে শর্টগানের ফাঁকা গুলির শব্দে সবাইকে নামাজের প্রস্তুতি নেয়ার সঙ্কেত দেয়া হয়। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন মুসুল্লিরা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ ঈদগাহ পরিণত হয় একটি ঐতিহাসিক ময়দানে। সেই ঐতিহাসিক ময়দানে ঈদের নামাজ আদায়ে আশপাশের সাধারণ মানুষের আগ্রহে ভাটা পড়ার নেপথ্যের রহস্য খুঁজে বের করা উচিত বলে মনে করেন দেশের সাধারণ মানুষ। কারণ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিবৃতি দিয়ে বলেছে ওই ইমামের অতি রাজনীতির কারণে রাজনীতি বিমুখ মুসল্লিরা ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠে ঈদের নামাজ আদায়ে আগ্রহ হারাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শোলাকিয়ায় ‘ইতিহাসে উল্টো স্রোত’
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ