পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বের মানুষকে ‘ফুসফুস’ এর গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। করোনার আক্রমণে পৃথিবীর বহুদেশ তছনছ হয়ে গেছে, মারা গেছে ৩২ লাখ মানুষ। এই ভাইরাস মূলত মানুষের ‘ফুসফুস’ আক্রান্ত করে। ফুসফুস অক্সিজেন গ্রহণের স্বক্ষমতা হারিয়ে ফেললে মানুষ মারা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে গাছ প্রকৃতিগতভাবে অক্সিজেন ত্যাগ করে বাতাসে; গ্রহণ করে কার্বন ডাই অক্সাইড। মানুষ নিঃশ্বাসে সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। রাজধানী ঢাকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অক্সিজেন গ্রহণের অন্যতম ফুসফুস হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক। সেই উদ্যানের ‘ফুসফুস রক্ষাকারী গাছ’ কেটে রেস্তোরাঁ (ফুড কর্নার) নির্মাণ করা হচ্ছে। ঐতিহাাসিক এই উদ্যানের ১৫০টি গাছ কাটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
গাছ কাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি; উদ্যানে হাঁটাপথ, খাবারের দোকানসহ নানা স্থাপনা তৈরিতে কোনো গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তা কেটে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশবিদ, নগরবিদ, প্রকৃতিপ্রেমী এমনকি ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলের নেতারাসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ উদ্যানের গাছ কাটার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ঐতিহাসিক এই উদ্যানে গাছ কেটে খাবারের দোকান তৈরির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করছেন। প্রতিদিন প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন হচ্ছে। এ ছাড়াও টুইটার, ব্লগে বইছে প্রতিবাদের ঝড়। গতকালও উদ্যানের গাছ কাটার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন দেশের কবি, লেখক, শিল্পী, ছোট কাগজ ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
ঐতিহাসিক উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ করতে এরই মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্টদের উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এর আগে গাছ কাটার প্রতিবাদে ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ফোরামের কে এম সফিউল্লাহ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মামলা দায়ের করেন। ২০১০ সালে সেই মামলার রায়ে উদ্যানের ৭টি স্থাপনা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়।
পরিবেশবিদ ও নগরবিদরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ প্রতিটি বড় শহরে কমপক্ষে ২০ শতাংশ গাছগাছালিতের সবুজ স্থান থাকা প্রয়োজন। অথচ রাজধানী ঢাকায় উত্তরাংশে কাগজে-কলমে রয়েছে ১২ শতাংশ আর পুরনো ঢাকায় ৫ শতাংশ সবুজ। এর মধ্যেই গাছ কেটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্তোরাঁ নির্মাণ চলছে। গাছ কাটা বন্ধের দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গত বৃহস্পতিবার সরকারকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামিম আকতার ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মঞ্জুরুর রহমানকে ই-মেইলে নোটিসটি পাঠানো হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক আদেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওই নোটিসে বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে রেস্তোরাঁ নির্মাণ বন্ধ না হলে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে।
জানতে চাইলে মনজিল মোরসেদ বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা আদালত অবমাননা এবং ফৌজদারি অপরাধ। এ অপরাধে সাজা ৫ বছর জেল জরিমানা হতে পারে। ২০০৯ সালে উদ্যান সংক্রান্ত হাইকোর্টের একটি রায় রয়েছে। তাতে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকে একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই এলাকার রয়েছে ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য। এছাড়াও দেশের সকল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র হওয়ায় এটি ‘বিশেষ এলাকা’ হিসাবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। গত ১১ বছর হাইকোর্টের ওই রায় বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পূর্ত মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা চেষ্টা করেছি। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কি হয়েছে গত ১১ বছরেও জানতে পারিনি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নের স্বার্থে এসব গাছ কাটা হয়েছে বলে দাবি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাদের বক্তব্য, পরিকল্পিত সবুজায়নের অংশ হিসেবে ‘অপ্রয়োজনীয়’ গাছ কাটা হচ্ছে। গাছ কাটা হলেও নতুন করে ফুল গাছ লাগানো হবে। সারা বছরই ফুটবে নানা ফুল। ঘাসে পা না দিয়ে মানুষের হাঁটাপথ বাড়ানো হচ্ছে। লোকজনের বিশ্রামের জন্য বিভিন্ন নকশার বেঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে। এতে কিছু গাছ কাটা যেতেই পারে। তারা বলছেন, জনসমাগম হলে মানুষ যাতে উন্নত মানের খাবার পায়, তাই উদ্যানে ৭টি আধুনিক মানের রেস্তোরাঁ তৈরি করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, মানুষের শরীরে করোনাভাইরাস যেভাবে ফুসফুসকে আক্রান্ত করছে, লকডাউনের মধ্যে রাতের আঁধারে গাছ কেটে একইভাবে নগরীর ফুসফুসকে আক্রান্ত করা হচ্ছে। গাছ কাটার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উদ্যানের শতাধিক গাছে ক্রসচিহ্ন দেওয়া হয়েছে। সেগুলো কাটা হবে। পুরো উদ্যানেই ইট, পাথর, লোহা-লক্কড়ে ঠাসা। যত্রতত্র পড়ে আছে কাটা গাছের গুঁড়ি-ডালপালা। এক সময়ের ঘন ছায়ার উদ্যান এখন ফাঁকা। চারপাশের পরিবেশ জানান দিচ্ছে ‘গাছের আর্তনাদ’। উদ্যানে ওয়াকওয়ে ও ৭টি ফুড কর্নার বানানোর জন্য এরই মধ্যে কাটা হয়েছে অনেকগুলো গাছ। শ্রমিকরা গাছ কেটে গাছের গুঁড়িতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। পাশে খাবারের দোকানের জন্য কয়েকটি স্থাপনা তৈরির কাজ চলছে। হাঁটাপথে ইট বিছানো হচ্ছে। ইট বিছানোর জন্য কিছু অংশের মাটি খোঁড়া হয়েছে। এই হাঁটাপথের নকশার মধ্যে যে গাছগুলো পড়েছে সেগুলো গাছ কাটা হয়েছে। সরেজমিনে আরো দেখা যায়, উদ্যানের বিভিন্ন জায়গায় কর্তৃপক্ষের নাম দিয়ে নোটিশ টানানো। বড় একটি গাছের ছবি এঁকে লেখা হয়েছে ‘ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় উদ্যানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পিত সবুজায়ন ও পরিবেশ উন্নয়নের কাজ চলমান। সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য’। ওই গাছের নিচে বিভিন্ন সংগঠন গাছ কাটার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে। বুকে গাছ কাটার প্রতিবাদী ব্যানার লাগিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদকারীরা জানান, তারা গুনে দেখেছেন এখন পর্যন্ত ১৫০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আরো অনেক গাছ কেটে ফেলার জন্য ক্রসচিহ্ন দেয়া হয়েছে। তবে শ্রমিকদের দাবি এখন পর্যন্ত অর্ধশত গাছ কাটা হয়েছে।
উদ্যানের দায়িত্বে থাকা কার্পেন্টার নজরুল ইসলাম খোকনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরা জানি না এখানে কী গাছ কাটা হচ্ছে। এটা স্যার (অফিসার) ভালো বলতে পারবেন। কয়েক জন নির্মাণ শ্রমিক জানান, দায়িত্বরত অফিসার তাদের কয়েকটি এলাকা দেখিয়ে দিয়েছেন। দেখানো জায়গায় যত গাছ আছে সেগুলো কাটতে হচ্ছে। গাছ কাটার সময় কয়েকজন ছাত্র এসে বাধা দিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা চুক্তিতে কাজ করছি। এর বেশি কিছু জানি না।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেন। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন এ উদ্যানে। উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে খরচ হয় ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজে খরচ হবে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। গত ২৩ বছর ধরে উদ্যানে ১৫০ ফুট উচ্চতার কাচের তৈরি স্বাধীনতা স্তম্ভ, উদ্যানের উত্তর প্রান্তের শিখা চিরন্তন, পানির ফোয়ারা, ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, দেয়ালে ম্যুরাল স্থাপন, বাংলা একাডেমির সামনের অংশে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, নতুন ফটক, উদ্যানের চারপাশে স্টিলের বেড়া নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ হয়েছে। এই উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পটির উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটির তৃতীয় পর্যায়ের নকশা প্রণয়ন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থাপত্য অধিদফতর। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদফতর আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।
সোরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে ৫ মে বুধবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে মন্ত্রণালয় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘কিছু গাছ’ কাটা হলেও প্রায় এক হাজার গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অতঃপর সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পছন্দ করেন না, তারাই বিভিন্ন কথা বলে উদ্যানের কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গাছ কাটা বিষয়ে আমরা লিখে পাঠাইছি। এখানে কোনো দিনই উদ্যান ছিল না। রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় হতো, জনসভা হয়েছে। মিথ্যাচার করে বলা হচ্ছে বন ছিল। আমরাই হাজার হাজার গাছ লাগাইছি, আরও লাগাব। অথচ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদের হাসানুল হক ইনু এমপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্টুরেন্ট নির্মাণের জন্য গাছ কাটার প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে জাতীয় ইতিহাসের গৌরবের স্মারক চিহ্ন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যানের সংরক্ষণের জন্য সরকার গৃহীত ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’ এর মূল পরিকল্পনার পরিবর্তন করে ৭টি রেস্টুরেন্ট স্থাপনের নতুন পরিকল্পনা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
এদিকে ঐতিহাসকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রক্ষায় ২০০৯ সালে আদালতে মামলা দায়ের করা দুই ব্যক্তির অন্যতম ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন গাছ কাটার প্রতিবাদ করে বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটি ঐতিহাসিক সম্পত্তি। এই উদ্যানকে যতটা সম্ভব অক্ষত রাখতে হবে। স্থাপনা হতেই পারে, তবে তা চারদিকে ছড়িয়ে করতে হবে। ঢাকা শহরের পার্ক ও গাছপালা রক্ষায় বিভিন্ন সময় আমাদের মতামত দিয়েছি। বেশিরভাগ সময়ই মতামতের ধার ধারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, কোনো ধরনের যুক্তি ছাড়া উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা যৌক্তিক নয়। একটি গাছ এত বড় হয়েছে, আমাদের পরিবেশকে পরিষ্কার করে দেয়, কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নিয়ে আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ করে। এরকম একটি গাছ তো দু-একদিনে বড় হয় না। এগুলোকে রক্ষা করেই যে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
মানববন্ধন : প্রতিদিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন করছে। গতকালও গাছ কাটার প্রতিবাদে ছবির হাট নামে এক সংগঠন মানববন্ধন করেছে। সেখানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক একটি স্থান হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই সবুজ উদ্যানটি ঢাকা শহরের একটি অক্সিজেন ভাণ্ডার। এই অক্সিজেন ভাণ্ডারের ওপর নজর পড়ছে কুচক্রী ব্যবসায়ীদের। এখানের গাছ কেটে রেস্তোরাঁ তৈরি করার চেষ্টা করছে তারা। অক্সিজেন ভাণ্ডারকে বানানোর চেষ্টা করছে ব্যবসাখানা। যেটি আমরা কখনও হতে দেব না। আমরা বলতে চাই, কোনোভাবেই উদ্যানের গাছ কাটাতে দেওয়া হবে না।এ ছাড়াও নোঙর বাংলাদেশ, স্বাধীনতা উদ্যান সাংস্কৃতিক জোট, গ্রিন প্লানেট নামে তিনটি সংগঠন গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
উচ্চ আদালতের রায় ছিল : রেসকোর্স ময়দানে একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান ও একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে ২০০৯ বছরের ২৫ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। ২০১০ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য থাকায় হাইকোর্ট উদ্যানটি রক্ষার স্বার্থে একটি রায় দিয়েছিল। ওই রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাত্তর-পরবর্তী স্থাপনা, যেমনÑ শিশু পার্ক, মহানগর পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ফুলের মার্কেট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত রায়ে এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭টি স্থান চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেয়। সেগুলো হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেওয়া ভাষণের স্থান, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান, একাত্তর সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথের স্থান, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থান। এ ৭টি স্থান ছাড়া রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব ধরনের স্থাপনা অপসারণ করতে বলা হয়। ২০২০ সালেও এ সংক্রান্ত আরেকটি রিট আবেদনে শুনানিতে এ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে এ রায়ের আদেশ বাস্তবায়নের প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। পরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ধর্মমন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দেয় আদালতে। সেই প্রতিবেদন দেখে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিল, গত ১০ বছরে অন্য কোথাও শিশু পার্ক সরাতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ঢাকায় বাচ্চাদের খেলার জায়গা নেই।
ফিরে দেখা : ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোদিনে উল্টালে দেখা যায়, ১৬১০ সালে মুঘল শাসনামলে এই উদ্যাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকা নগরীতে উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন। সেই উদ্যান এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক। নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার পরাজয়ের পর উপনিবেশিক (ব্রিটিশ) শাসনামলে এটি রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিতি পায়। ১৯০৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলেও ছিল তাই। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ হওয়ার পর এর নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়; রাস্তার অপর প্রান্তের অংশ হয় রমনা পার্ক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।