Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীনে বিয়ের সংখ্যা হ্রাস প্রভাব পড়ছে অর্থনীতি ও পরিবারের উপর

প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : ২৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল লিউ ঝেনফেং-এর। তারপর যা হয়। একটি মেয়ে, একটি বাড়ি, আসবাবপত্র, খেলনা। তার মেয়ে সং জংপেই-এর বয়স এখন ২৮।
তিনি ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। দু’জন সঙ্গিনীর সাথে বেইজিং-এ একটি ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন তিনি। নিজের ক্যারিয়ার ও আর্থিক স্বচ্ছলতার দিকে তার দৃষ্টি। অদূর ভবিষ্যতে বিয়ে করা বা-মা হওয়ার কথা তিনি ভাবছেন না। সং বলেন, এ পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমার নিজের উন্নতি।
অল্প চীনাই এখন বিয়ে করছে, আর তার গভীর প্রভাব পড়ছে চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে। বিয়ে হ্রাস পাওয়া মানে কম শিশুর জন্ম এবং বাড়ি, গৃহস্থালি সামগ্রী ও পরিবার সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্র কেনাকাটার ক্ষেত্রে কম ব্যয়। অথচ চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অভিযাত্রায় বেশি ব্যয় প্রয়োজন।
কিছু ব্যবসা ইতিমধ্যেই অবিবাহিত নির্ভর হয়ে পড়েছে। অলংকার নির্মাতারা অবিবাহিতা প্রেমিকাদের জন্য সস্তায় ছোট আকৃতির অলংকার তৈরি করছে। এক গৃহস্থালি সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছোট রাইস কুকার বিক্রি করছে। সন্তান জন্ম বিষয়ক বিদেশী সংস্থাগুলো যে সব চীনা মহিলা পরে সন্তান জন্মদানের জন্য তাদের ডিম্বাণু হিমায়িত রাখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে যদিও এ প্রক্রিয়া চীনে অবিবাহিত মহিলাদের জন্য নিষিদ্ধ।
চীনের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার বিরাট অংশের কারণে সৃষ্ট বিবাহ মন্দা এবং এক সন্তান নীতির কঠোর অনুসরণের ভালো দিকও আছে। এর একটি কারণ হচ্ছে চীনে শিক্ষিত মহিলাদের উদ্ভব। অর্থনীতি, জনসংখ্যা ও সমাজতত্ত¡ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সব মহিলারা ক্যারিয়ার গঠন ও আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জনের জন্য বিয়ে বিলম্বিত করছে যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষমতাবান এক মহিলা জনগোষ্ঠি যারা বিয়েকে আর নিরাপত্তার একমাত্র পথ বলে মনে করে না।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্কুল অব ডেভেলপমেন্ট-এ অর্থনীতির অধ্যাপক ঝাং জিয়াওবো বলেন, কারণ তারা উচ্চ শিক্ষিতা, ভালো বেতনের চাকরি করে, তারা বিয়ে করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
চীন তার সরকারী মিডিয়ায় বিয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু জনসংখ্যা ও পরিবর্তনশীল সামাজিক রীতিনীতি তা কঠিন করে তুলছে।
গত বছর ১ কোটি ২০ লাখ চীনা বিবাহের জন্য নিবন্ধন করে। এ নিয়ে উপর্যুপরি দ্বিতীয় বছর বিবাহকারীদের সংখ্যা হ্রাস পেল। একই প্রবণতার কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে যা গত বছর ছিল ৩৮ লাখ। এক দশক আগের চেয়ে এ সংখ্যা দ্বিগুণ।
বিবাহ হ্রাসের ঘটনার প্রধান কারণ চীনের এক সন্তান নীতি। ৩৫ বছর পর জানুয়ারিতে এ নীতির অবসান করা হয়েছে যা দেশে জন্মহার হ্রাস দ্রæত করেছে। তার ফল হিসেবে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রধান বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর সময়ে দু’দশক আগের চেয়ে বিয়ে করার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে অধিকাংশ পরিবারই যখন ছেলে সন্তান পছন্দ করে, সে কারণে চীনে পুরুষের সংখ্যা বেশি যা বিয়ের সম্ভাবনাকে আরো জটিল করে তুলছে।
সং-এর মা লিউ স্বীকার করেন যে ভালো বিয়ের জন্য তার মেয়ের অপেক্ষা করা উচিত। তবে তার আশা যে মেয়ে কাউকে খুঁজে পাবে। লিউ বলেন, আমি চাই সে সুখী হোক। আমি মনে করি, পরিবারই তাকে নিরাপত্তা দেবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া দ্বিমুখী হতে পারে। বিবাহিত দম্পতিদের তুলনায় অবিবাহিত অবস্থায় লোকজন বাড়ি কম কেনে, সন্তান থাকে না, খেলনা ও অন্যান্য জিনিসপত্র কম কেনে। এ অবস্থা রফতানির উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি ও সরকারী প্রকল্পসমূহে বড় ব্যয়ের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে মিতব্যয়ী চীনা জনগণকে আমেরিকান-ধরনের ব্যয়মুখী করে তোলা জটিল হয়ে পড়বে।
এ অবস্থা চীনা ভোক্তাদের তাদের অর্থ ব্যাংক থেকে দূরে অথবা ঘরে বিছানার নিচে রাখতে উৎসাহিত করতে পারে। চীনের হবু বরের পরিবার দম্পতির আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রদানের লক্ষ্যে তাদের জন্য একটি বাড়ি কেনার জন্য বহু বছর ধরে অর্থ জমায়। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঝাং বলেন, যদি পাত্রী পাওয়া কঠিন হয় তখন পরিবার আরো বড় বাড়ি কেনার জন্য অধিক পরিমাণে অর্থ সঞ্চয় করে।
কিন্তু চীনা ক্রেতারা কিছু একটা কিনতে টাকা ব্যয় করতে পারে। শিক্ষিত, তরুণী শহুরে নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভের জন্য আর বিয়ের প্রয়োজন না হওয়ায় বিয়ের ক্ষেত্রে ভাটা দেখা গেছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, চীনে বেতন ও চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েেেছ। ২০১৪ সালে চীনে স্নাতক নিম্ন নারীর সংখ্যা ছিল অর্ধেকেরও বেশি। এক দশক আগে এ সংখ্যা ছিল ৪৬ শতাংশ। আর স্নাতক নারীদের সংখ্যা ছিল অর্ধেক।
পূর্ব চীনের হ্যাংঝুর ৩০ বছর বয়স্কা চেং গুপিং চাকরি শুরু করেছেন ও অর্থনীতিতে পিএইচডি করতে চাইছেন এমন একজন নারী। তার ও তার বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে সম্প্রতি সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি তার পেশাগত ও শিক্ষাগত বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আমি উপলব্ধি করলাম যে আমাদের অনুরাগ ও ঘনিষ্ঠতা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, আমি দেখতে চাই যে আমি নিজে কতদূর যেতে পারি।
চেং বলেন, উপযুক্ত স্বামী খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার বয়সী বহু মানুষই পরিপক্ব নয় বা দায়িত্বহীন। তার সাবেক এক বয়ফ্রেন্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যখনি কিছু করতে চাইতাম বা খেতে যেতাম, সে চতুরের মত আচরণ করত এবং হেসে বলত তুমি যা পছন্দ কর আমরা তাই করব। তার এ আচরণে মনে হত আমার একটি ছেলে আছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য এ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিয়ের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় চীনে সোনার গহনা বিক্রি হ্রাস পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে বহু স্টোরই এখন ডেটিং করছে এমন স্বল্প আয়ের যুগলদের জন্য সস্তা রতœসহ বিচিত্র ধরনের অলংকার তুলে ধরছে।
হংকং ভিত্তিক জুয়েলারি চেইন ৎসে সুই লুয়েন-এর নির্বাহী অ্যানি ইয়াউ ৎসে বলেন, যদিও তারা বিয়ে করছে না কিন্তু সবাই চায় তার সাথে কেউ থাকুক এবং তারা এখনো ভালবাসা চায়।
এক অনলাইন প্রপার্টি এজেন্ট জিয়াজিয়াসুন বলেন, অবিবাহিত লোকদের জন্য তারা কম ব্যয়ের বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেছেন। একটি চীনা গৃহস্থালি সামগগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইডিয়া অবিবাহিতদের টাটকা ভাত ভাত রান্নার সুবিধা এবং ফ্রিজের ঠাÐা খাবার খাওয়া পরিহারের লক্ষ্যে ছোট আকারের রাইস কুকার তৈরি করছে। মাইডিয়া’র ক্ষুদ্র গৃহস্থালি সামগ্রী বিভাগের প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থাপক হুয়াং বিং বলেন, চীনে পরিবার পর্যায়ে যে পরিবর্তন ঘটছে সে ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন।
চীনের পরিবারগুলোতে এ পরিবর্তনের ধারা পারিবারিক বন্ধন ও সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। উল্লেখ্য, চীনের বিবাহিত দম্পতিরা ঐতিহ্যগতভাবে বয়স্ক পিতা-মাতার প্রতি যতœশীল।
২৯ বছর বয়স্কা উ জিংজিং তার প্রজন্মের কাছে বয়স্ক ব্যক্তিরা বোঝা হয়ে উঠতে পারে বলে দেখছেন। একটি ইন্টারনেট কোম্পানিতে কর্মরত উ বলেন, মধ্যবিত্ত পর্যায়ের একদল লোক আছে যারা পরিবারের ভিত্তি এবং তারা সন্তান ও পিতা-মাতা লালন-পালনকে ঝামেলা হিসেবে গণ্য করবে। তিনি বলেন, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এটা ঘটবে।
উ বলেন, এখনকার তরুণ-তরুণীরা যাকে তাকে বিয়ে করতে চায় না। তারা চায় এমন সম্পর্ক যার ভিত্তি হচ্ছে ভালোবাসা। তার মা চিন্তিত যে সে যদি বিয়ে না করে তাহলে কে তাকে দেখবে। ৫৩ বছর বয়স্কা ঝাই লিপিং বলেন, আমরা এখনো তার দেখাশোনা করছি। কিন্তু আমরা তো চিরদিন থাকব না। আশা করি সে এমন কাউকে খুঁজে পাবে যে তাকে দেখবে এবং আমরা আশ্বস্ত হতে পারব।
উ এখনো অবিবাহিতা। সঠিক কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, আগের দিনে লোকজনের মধ্যে মেলামেশা বেশি ছিল এবং তারা দৈনন্দিন জীবনে একজন সঙ্গী খুঁজে নিত। এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে যাদের সম্পর্কের ভিত্তি ভালোবাসা। এখন বহু লোকই এ পুরনো মানসিকতা প্রত্যাখ্যান করে ও একজন পছন্দসই ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে চায়। সূত্র নিউইয়র্ক টাইমস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীনে বিয়ের সংখ্যা হ্রাস প্রভাব পড়ছে অর্থনীতি ও পরিবারের উপর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ