পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ঢাকার একটি কলেজের ছাত্রী ছিল কুমিল্লার মেয়ে মোসারাত জাহান মুনিয়া। গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রাতেই মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন যে, ২০১৯ সালে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহানের সঙ্গে মুনিয়ার পরিচয় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর আগে বনানীর যে বাসায় তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতেন, সেই বাসাটিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, ডিএনএ নমুনা, সিসিটিভি ফুটেজ, কল রেকর্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, ঘটনাস্থল থেকে মুনিয়ার মোবাইল ও বিভিন্ন ধরনের আলামতসহ ৬টি ডায়েরি পাওয়া যায়। ডায়েরিগুলোর তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। তিনি জানান, মুনিয়ার মৃত্যু হত্যা, নাকি আত্মহত্যা, তা নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ।
মুনিয়ার ফ্ল্যাটের ভাড়া ছিল মাসে লাখ টাকারও বেশি। একাই থাকতো সে ওই ফ্ল্যাটে। আর ফ্ল্যাটের ভাড়া দিত সায়েম সোবহান। মৃত্যুর আগের দিন সে তার বোনকে বলেছিল যে, সে বিপদে পড়ে গেছে। এরপর তার বোন কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে দেখে মুনিয়ার লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে। এটি হত্যা, না আত্মহত্যা, সেই সাক্ষ্য-প্রমাণ হাতে পাওয়ার আগেই কিছু নামকরা পত্রিকা লিখছে যে, সে আত্মহত্যা করেছে।
কিছু সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া এমনভাবে প্রতিবেদন ও মন্তব্য প্রকাশ করছে যে, মনে হচ্ছে, মেয়েটি মারা গিয়েছে কোন এক আগন্তুকের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে। সেই আগন্তুকের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা তাদের বারণ। অথচ এ আগন্তুকের ব্যক্তিগত জীবনে এবং পরিবারে ঢুকলে বেরিয়ে আসবে আরো কিছু হত্যাকান্ড এবং মুনিয়ার মতো মেয়েদের নাম।
তো, মুনিয়া যে আত্মহত্যা করেছে, এটি পুলিশের আগে সোশ্যাল মিডিয়ার তথাকথিত চরিত্রবান নীতিবাগিশরা কী করে নিশ্চিত হলেন? তারা কী করে নিশ্চিত হলেন যে, পিতৃমাতৃহীন এতিম মুনিয়া কোনো ফাঁদে পড়ে বা অসহায়ত্বের শিকার হয়ে নয়, বরং স্বেচ্ছায় লোভের বশবর্তী হয়ে এ জীবন বেছে নিয়েছিল? তারা কী করে নিশ্চিত হলেন যে, এটি অন্য কারো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সঙ্ঘটিত হত্যাকান্ড নয়? বা এমনকি কোনও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডও নয়?
এই হচ্ছে আমাদের কিছু সংবাদমাধ্যম এবং সমাজ সংস্কারকদের সততার দৌড়। এরাই এক সময় নাইনে পড়া ১৫ বছরের শাজনীনের লাশের পোস্টমর্টেমের রগরগে উত্তেজক বর্ণনা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পিছপা হয়নি। যারা টিআরপি বা খাবরের কাটতির প্রলোভনে প্রতিনিয়ত ধর্ম এবং নীতি বিসর্জন দিয়ে চলেছেন, তারাই হুট করে মফস্বল থেকে শহরের জৌলুসপূর্ণ প্রলোভনে পড়া একটি বাচ্চা মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে সমালোচনায় মত্ত। অথচ প্রকৃত অপরাধীর চরিত্রের অদ্যপান্ত নিয়ে কথা বলতে তাদের বড় অনীহা।
কতো হবে মুনিয়ার বয়স? সর্বোচ্চ ১৭? এর বেশি তো নয়। মুনিয়া ভুল করছিল, নাকি ঠিক করছিল, তা বোঝার মতো মানসিক পরিপক্কতা হয়ত তার হয়নি। তার এ বয়সে সবার কাছেই সব কিছু রঙিন মনে হয়। অতি সাধারণ জিনিসকেও মনে হয় বিশাল কিছু। যারা এ বয়স পার করে এসেছেন, তারা সবাই এটি জানেন। এ বয়সের আবেগ বা ভালবাসা জাত বা শ্রেণী, বা কোনও বাধা মানে না। যদিও মেয়েটা ভুল করছিল সেই ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল পরিবারের বড়দের।
এতটুকু মেয়ের চরিত্রের চটকদার সমালোচনা যারা করছেন, তাদের চিন্তার দৈন্যতা আজ সেই ফেলে আসা অতীত মনে করিয়ে দিচ্ছে, যখন আমরা মানুষ ছিলাম। এক সময় আমরা মানুষ ছিলাম। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেলের যৌতুকলোভী ও চরিত্রহীন ডাক্তার ইকবাল পরকীয়ার জের ধরে বেøড দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে স্ত্রী সালেহাকে। অস্থায়ী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সাথে ইকবালের পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় হত্যাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।
ঐ সময় জেলা শহরগুলোতে পত্রিকা পৌঁছাত একদিন পর। তারপরেও প্রথম ও দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্তের রিপোর্টে সালেহার আত্মহত্যার কথা মেনে নেয়নি দেশবাসী। পুলিশও ছাড় দেয়নি। তৃতীয় দফায় কবর থেকে লাশ তুলে আবার ময়না তদন্তে হত্যা প্রমাণিত হয়। ইকবালের ফাঁসির আদেশ হয়। সাংবাদিকরা পত্রিকার প্রথম পাতায় ছোট করে হলেও প্রতিদিন খবর ছাপিয়ে গেছে ফাঁসি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত।
এ ফাঁসির পেছনে সাংবাদিকদের বড় অবদান থাকায় ফাঁসির পর সাংবাদিকরা ইকবালের পরিবারের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে দা-লাঠি নিয়ে ইকবালের পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিকদের তাড়া করেছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে যারা ইকবালের প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে গিয়েছিল, তিনি তাদের তিরস্কার করে বের করে দেন। এ হত্যাকান্ডের ফলে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে যৌতুক বিরোধী আইন পাশ হয়।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশের কিংবদন্তী ডাক্তার দম্পতি গাইনির মেহেরুন্নেসা ও ঢাকা মেডিকেলের প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেমের পুত্র মুনির খুকু নামের এক বিবাহিতা মহিলা ও মায়ের বয়সী নার্স মিনতির সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এ সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ায় মুনির খুন করে স্ত্রী শারমীন রিমাকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনের কন্যা ছিলেন। আবার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশ।
পত্রিকার পাতা, জনতার একাত্মতা, রীমা হত্যা নিয়ে ধারাবাহিক ম্যাগাজিন, বই, ক্যাসেটে গান, পথে ঘাটে ট্রেনে, বাসে শিল্পীদের রীমার পক্ষে গানের জোয়ারে সহমর্মীতা, একাত্মতা, আর ন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে দেশবাসী। মুনিরের ফাঁসির আদেশ হয়। জনগণ তাতেও সন্তষ্ট হয়নি, হত্যার ষড়যন্ত্রকারী খুকুরও ফাঁসি চেয়েছে। তখন এর মধ্যে আওয়ামীলীগ, বিএনপি বলে কিছু ছিল না। ছিল না সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির বা সত্য ছড়িয়ে দেয়ার হাতিয়ার কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল। শুধু মানবিকতা।
১৯৯১ সালে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সব এক হয়ে আরিচা মহাসড়ক বন্ধ করে দেয়। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বাধ্য হয়ে মুনিরের সাথে খুকুরও ফাঁসির আদেশ হয়। যদিও উচ্চ আদালতে খুকুর ফাঁসির আদেশ পরবর্তীতে বাতিল হয়, তবে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের পুত্র মুনিরের ফাঁসি কেউ রুখতে পারেনি।
আজ সেই মানবিক বাংলাদেশ কোথাও হারিয়ে গেছে। হারিযে গেছে আল্লাহভীতি এবং ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও। ইসলামের দৃষ্টিতে গীবত বা পরনিন্দা একটি মারাত্মক পাপ। এই পাপের প্রবণতা আমাদের সবার মধ্যে কমবেশি আছে। কিন্তু আত্মসংযমের মাস রমজানেও ইসলামের অন্যতম ফরজ নেক আমল রোজা পালন অবস্থায়ও আমরা আমাদের পারস্পরিক কথাবার্তায়, লেখালেখিতে, বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পাপের চর্চা করছি অনায়াসে।
অথচ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)
রাসুল (সা.) পরনিন্দাকে ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য আখ্যায়িত করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘গীবত ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্যতম গুনাহ।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তাওবা করলে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু যে গীবত করে তার গুনাহ প্রতিপক্ষের মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হয় না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১২)
গীবতের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মিরাজের রাতে আমি কিছু লোককে দেখলাম, তাদের তামার নখ রয়েছে এবং তা দিয়ে তারা নিজেদের মুখমন্ডল ও বুক আঁচড়াচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল, এরা কারা? তিনি বলেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গীবত করত এবং তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলত।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৭৯)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার পরনিন্দা করেছ, তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো, এভাবে বলবে, হে আল্লাহ তুমি আমাকে এবং ওই ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দাও।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি, হাদিস : ৬৩৬৭)
আল্লাহ মাফ করুন, যারা অন্যের মেয়ে নিয়ে সমালোচনায় লিপ্ত, ভবিষ্যতে তাদের বা অন্য কারোর মেয়েদের যেনো এমন দুঃখজক পরিণতি না হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।