পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ওরা যেন জীবন্ত কোরআন। প্রতিটি মেয়ে এক একটা জীবন্ত কোরআন শরীফ। ৩০ পারা কোরআন তাদের মুখস্থ। যারা হিফজখানায় পড়ে পবিত্র কোরআনের হাফেজ হন; তারা নূরানী দিয়েই পড়ালেখা শুরু করেন। আর নূরানীর ছাত্রীরা পর্দার আড়ালে থেকে নিত্যদিন পাঠ শুরু করেন সেই ভোর রাতে। নীরব সুনসান ভোরে মিষ্টি বাতাসে ভেসে আসছে কোরআনের সুমধুর সুর। আহা! প্রাণ জুড়িয়ে যায়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, লালবাগ, মালিবাগ, জুরাইনসহ যেসব এলাকায় নূরানী মাদরাসা রয়েছে; সেখানে মানুষ প্রতিদিন ভোরে কোরআনের এ সুমধুর সুর শুনতে অভ্যস্ত। হিফজখানার ছোট ছোট ছাত্রীদের কোরআনের আওয়াজে ঘুম ভাঙতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। কিন্তু করোনার কারণে সে এখন সুর আর শোনা যায় না।
করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে ব্যাংক, মার্কেট, শপিংমল খোলা রাখা হয়েছে। অথচ দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের ‘জীবন্ত কোরআন’ হিসেবে গড়ে তোলার মাদরাসাগুলো বন্ধ। মাদরাসা বন্ধ রাখায় নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েছে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়ে যারা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নিজেরাই একএকটি জীবন্ত কোরআন হয়ে উঠবেন তারাও পড়ে গেছেন বিপদে। শুধু তাই নয়, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কোরআনের হাফেজ হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সুধীজন বলেছেন ‘তুমি একটি শিক্ষিত ও আদর্শ মা দাও/আমি তোমাকে শিক্ষিত, সৎ ভালো সমাজ উপহার দেব’। অথচ আলেমদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে কোনো কারণে মাদরাসা বন্ধ রাখা যেতেই পারে। তবে নূরানী ও হেফজখানা বন্ধ করা উচিত নয়। যারা কোরআনের হাফেজ হন তাদের প্রতিদিনই ধারাবাহিকভাবে পড়তে হয়। নিয়মিত পাঠ কিছুদিন বন্ধ রাখলেই পবিত্র কোরআন মুখস্থে ছেদ পড়ে। পরে আবার পুরনো ধারায় ফেরা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কাজেই অন্য মাদরাসা না হোক অন্তত হেফজখানাগুলো খুলে দেয়া উচিত। নূরানীতে পড়া ছেলেমেয়েরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। তাদের মতো স্বাস্থ্য সচেতন ও স্বাস্থ্যবিধি মানা অন্যদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
করোনা মহামারি সংক্রমণে বেসরকারি মহিলা মাদরাসাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত : দীর্ঘ দিন লকডাউনের কারণে কোরআন-হাদিসের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বেসরকারি মহিলা মাদরাসার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী। প্রতিদিন পর্দার আড়ালে প্রত্যেক মহিলা মাদরাসায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শোনা যেত। লকডাউন চলাকালে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে মহিলা মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। লকডাউনের দরুণ মহিলা মাদরাসাগুলোর সকল আয়ের পথ বন্ধ। বিত্তশালী ব্যক্তিদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় দাতাদের পক্ষ থেকেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাভাবে মহিলা মাদরাসাগুলো বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মহিলা মাদরাসাগুলোর লাখ লাখ টাকার বকেয়া এবং শিক্ষিকাসহ স্টাফ বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশকিছু মহিলা মাদরাসার মুহতামিম দ্বীনি শিক্ষার চর্চা অব্যাহত এবং মহিলা মাদরাসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত চালু করার জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বাংলাদেশে সা¤প্রতিক সময়ে নারীদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। ধর্মীয় শালীনতা বজায় রেখেই নারীরা প্রতিদিন মহিলা মাদরাসায় দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করছেন। নারীদের ধর্মীয় শিক্ষার পর্যাপ্ত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় শহর-গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভাড়া বাড়িতে হাজার হাজার মহিলা মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। করোনা মহামারির কারণে মহিলা মাদরাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ। গত বছর লকডাউনের পর মাদরাসা খুলে দেয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম ভালোই চলছিল। মহিলা মাদরাসার আয়ের উৎস ছাত্রীদের মাসিক বেতন এবং বিত্তশালীদের আর্থিক সহায়তা। মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকার কারণে মাসিক বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মহিলা মাদরাসার পরিচালকরা। অর্থাভাবে অনেক মহিলা মাদরাসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গতকাল বুধবার কয়েকটি বেসরকারি মহিলা মাদরাসা সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে এসব চিত্র ফুটে উঠে।
মিরপুর ১২ নম্বরস্থ জামিয়া মিল্লিয়া মাদানীয়া আরাবিয়া আজমা মহিলা মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মুফতি ইমরান কাসেমী জানান, দীর্ঘ দিনের লকডাউনের কারণে মাদরাসার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতি বছর মাহে রমজানে নির্ধারিত দাতাদের মাধ্যমে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা আয় হতো। কিন্ত এবার দাতাদের তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ যাবত মাত্র ৭০/৮০ হাজার টাকা লিল্লাহ বোর্ডিং ফান্ডে জমা হয়েছে। তিনি বলেন, ১ হাজার ছাত্রীর মধ্যে ১৭০ জন ছাত্রী লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে ফ্রি খানা খায়। আর্থিক সঙ্কটের দরুণ স্টাফ, কর্মচারীসহ ৪০ জন শিক্ষিকার গত ৪ মাস যাবত বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এতে শিক্ষিকা ও স্টাফদের বকেয়া পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। শিক্ষিকারা পরিবার পরিজন নিয়ে বহু কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। মুফতি ইমরান কাসেমী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করায় লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবিলম্বে মহিলা মাদরাসাসহ সকল হিফজ বিভাগ ও নূরানী বিভাগ খুলে দেয়ার জন্য সরকারের উচ্চ মহলের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
রাজধানীর পূর্ব ধোলাইপাড় বাজার আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদরাসার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা শোয়াইব আহমাদ গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার দিকে নারীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, মুসলিম নারীদের মাহরাম ছাড়া সবার সাথেই পর্দা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম নারীর সম্মানার্থে এবং দুষ্ট লোকের অশিষ্ট আচরণ থেকে তার মর্যাদা রক্ষার্থে পর্দা ফরজ করেছেন। পর্দা যেমন পুরুষদের রক্ষা করে, তেমনি নারীকেও নানা কষ্টদায়ক ব্যাপার থেকে রক্ষা করে। ইসলামে প্রতিটি মুসলিম নারীর জন্য বেগানা পুরুষের সামনে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা জরুরি। তারা হলেন, মাহরাম ব্যতীত বাকি সবাই। এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই মহিলা মাদরাসায় নারী শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
মাওলানা শোয়াইব আহমাদ বলেন, লকডাউনের কারণে মাদরাসার বাড়ি ভাড়া ১২ লাখ টাকা এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ১৬ জন শিক্ষিকা ও স্টাফদের প্রায় ৯ লাখ টাকা বেতন বোনাস এখনো বাকি। ৩০ জন হতদরিদ্র ছাত্রীর মধ্যে এখনো ১৫ জনকে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে খানা খাওয়ানো হচ্ছে। লিল্লাহ বোর্ডিং চালিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীর মানিকনগরের খাতুনে জান্নাত (রা.) মহিলা মাদরাসার পরিচালক মুফতি আবুল হাসান শামসাবাদী বলেন, লকডাউনে মহিলা মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক মহিলা মাদরাসা ভাড়া বাড়িতে চলে। ভাড়া চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হচ্ছে পরিচালকদের এবং অনেকে ঋণে জর্জরিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, লকডাউনের এই কঠিন সময়ে মাদরাসার গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বন্ধ হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাদরাসাগুলো খোলার অনুমতি দিলে অনেকের কর্মসংস্থান ঠিক থাকবে এবং মাদরাসাগুলো চলবে। তিনি আরো বলেন, প্রতি রমজানে কোরআন শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করত। এ বছর লকডাউনের কারণে কোরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
রাজধানীর গোলাপবাগ জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মহিলা মাদরাসার পরিচালক মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ ইব্রাহিমী বলেন, লকডাউনের কারণে কোরআন চর্চা ও কোরআন তিলাওয়াত বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করছি কোরআন চর্চা ও কোরআন তেলাওয়াত চালু হলে করোনা মহামারি থেকে মুক্তি দান করবেন আল্লাহ।
মহিলা মাদরাসার একজন শিক্ষিকা আলেমা সৈয়দা সায়েমা ইমরান আজিবা বলেন, ছাত্রীরা যেভাবে মাদরাসা খোলা অবস্থায় পড়াশোনা ও ইবাদত-বন্দেগি করে তাতে অভিভাবকরাও সন্তোষ প্রকাশ করেন। লকডাউনের কারণে বাড়িতে অবস্থান করায় তারা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে না বলে অনেক অভিভাবকই আমাদের কাছে অভিযোগ করছেন। ছাত্রীদের ভবিষ্যতের প্রতি লক্ষ্য করে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মাদরাসাগুলো খুলে দেয়া খুবই প্রয়োজন মনে করছি।
যাত্রাবাড়ীস্থ দারুল হিকমাহ মহিলা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি নাজমুল ইসলাম ফরাজী বলেন, লকডাউনে মাদরাসা বন্ধ থাকায় ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে মহিলা মাদরাসাগুলো। তিনি অবিলম্বে মাদরাসা খুলে দেয়ার দাবি জানান। কুতুবখালী হযরত ফাতেমা (রা.) ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট কওমী মহিলা মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা সাইফুল ইসলাম স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাদরাসা চালুর দাবি জানান।
ঢাকার দারুল উলূম ইসলামিয়া মহিলা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি আব্দুল কাইয়ূম বলেন, লকডাউন পরিস্থিতিতে বিগত চার মাস যাবত মাদরাসার বাড়ি ভাড়া ৯৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। বাড়িওয়ালা দফায় দফায় চাপ দিচ্ছে ভাড়া পরিশোধের জন্য, অন্যথায় বাড়ি ছেড়ে দেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, অনেক গরিব ছাত্রীর অভিভাবক ঠিকমতো বেতনও দিতে পারছেন না। এদের মাদরাসা থেকে বের করেও দিতে পারি না। তিনি স্বাস্থ্যবিধি পালন করে সকল কওমি মাদরাসা খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।