Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদুল আজহা ও কোরবানি

প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইকবাল কবীর মোহন
মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে ঈদুল আজহা অন্যতম। প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ এই উৎসব পালিত হয়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে বিশ্বের মুসলমানরা আনন্দঘন পরিবেশে ঈদুল আজহা পালন করে। এটি মুসলমানদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন মুসলমানরা খুশির এক মোহনায় এসে মিলিত হয়। ঈদুল আজহার দিন মুসলমানরা সকালে ওয়াজিব নামাজ আদায় করে। তারপর পশু কোরবানি করে। ঈদের নামাজ আদায় ও কোরবানির মাধ্যমে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ লাভ করে।
কোরবানির ইতিহাস
ঈদুল আজহার দিন পশু কোরবানি করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে। এই কোরবানির পেছনে রয়েছে গৌরবময় এক ইতিহাস। জিলহজ মাসের এই দিনে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পেয়ে অনেক ছাগল ও মেষ কোরবানি করেন। ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হলো না। ইবরাহিম (আ.)-কে আবার কোরবানি করার কথা বলা হলো। তিনি এবার উট কোরবানি করলেন। তাতেও আল্লাহ খুশি হলেন না। হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে এবার তাঁর প্রিয় বস্তু কোরবানি করার আদেশ দেয়া হলো। এই আদেশ পেয়ে আল্লাহর নবী মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। ইবরাহিম (আ.) এই রহস্যের কোনো কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ভাবলেন প্রিয়বস্তু তো কলিজার ধন শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)। তিনি এবার নিজ পুত্রকেই কোরবানি করার জন্যে মনস্থির করলেন। ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন। ইসমাইল  (আ.) তখন বেশ ছোট। ছোট হলেও তিনি ছিলেন খোদাভীরু। তিনি পিতার কথা শুনে অনায়াসে রাজি হয়ে গেলেন। পিতা ও পুত্রের কথাবার্তা আল্লাহপাক কুরআনের সূরা সাফফাত-এর ১০২ নম্বর আয়াতে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘অতঃপর সে (ইসমাইল) যখন পিতার (ইবরাহিম) সাথে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে আমি জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’
এবার হজরত ইবরাহিম (আ.) কোরবানির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করলেন। পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে ইবরাহিম (আ.) মিনায় গিয়ে হাজির হলেন। পুত্রকে শুইয়ে ইবরাহিম (আ.) কোরবানি করার উদ্যোগ নিলেন। কোরবানি করার সময় পুত্রের প্রতি মায়া জাগতে পারে এ জন্য তিনি চোখ বেধে নিলেন। আল্লাহর কি কুদরত! ইবরাহিম (আ.) ছুরি চালাতে যাবেন, এমন সময় আকাশ থেকে এক আওয়াজ এলো। নির্দেশ এলো ‘হে ইবরাহিম থামো’। ইবরাহিম (আ.) থতমত খেয়ে গেলেন। চোখের নিমিষে এ সময় একটি দুম্বা এসে গেল। আর তাই কোরবানি হয়ে গেল। আর ইসমাইল (আ.) অলৌকিকভাবে মুক্তি পেলেন। তবে ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনে শেষ পর্যন্ত অটল ছিলেন। এ জন্য তাঁর কাজে আল্লাহ খুশি হলেন। এ কথাই আল্লাহপাক কুরআনে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘হে ইবরাহিম! আপনি আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। আমি এভাবেই সৎকর্মীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে এটা ছিল বড় কঠিন পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্যে এক মহান বস্তু দুম্বা।’(-সূরা আসসাফফাত, আয়াত : ১০৪-১০৭)
হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও আল্লাহভীতির মহিমা স্মরণে পালিত হয় ঈদুল আজহা। দুনিয়ার প্রতিটি সঙ্গতিপন্ন মুসলমান এ দিনটিতে আত্মত্যাগের উদাহরণস্বরূপ আল্লাহর আদেশে পশু কোরবানি করে। মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর কোরবানিকে ওয়াজিব করেছেন। তিনি বলেন, ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’-সূরা কাউসার, আয়াত : ২
কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত
নেক আমলসমূহের মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ ইবাদত। কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে করা হয়। আল্লাহর আদেশ থাকার কারণে মুসলমানরা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য এই আদেশ পালন করে। উল্লেখ্য যে, পশু কোরবানি করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহভীতিই এখানে মূখ্য বিষয়। আল্লাহরপাক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এর গোশত ও রক্ত, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা হাজ, আয়াত : ৩৭)। যে কোরবানির সাথে তাকওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আবেগ জড়িত নেই, আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই কোরবানির কোনো মূল্য নেই। তাই আল্লাহতায়ালা কুরআনে আরো বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সূরা মায়িদা, আয়াত :২৭)
কোরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কোরবানি করে না, তাদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘(হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত) যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’Ñইবনে মাজাহ
কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে হজরত জায়িদ ইবন আরকাম (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ কোরবানি কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। তাঁরা (আবার) বললেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত আছে? তিনি বললেন : এর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, বকরীর পশমেও কী তাই? জবাবে তিনি বললেন, বকরীর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি আছে।’
অন্য এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে মুমিন ব্যক্তি প্রশান্ত হৃদয়ে হাসিখুশি মনে সওয়াবের আশায় কোরবানি করবে, আল্লাহতায়ালা তার এ কোরবানিকে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষার জন্য ঢালস্বরূপ বানিয়ে দেবেন। -ইবনে মাজাহ
আরেক হাদিসে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর কাছে বনি আদমের পশু জবেহ অপেক্ষা অন্য কোনো আমল বেশি পছন্দনীয় নয়। কিয়ামাতের দিন কোরবানিকৃত পশু লোম, খুর ও শিংসহ উপস্থিত হবে।-তিরমিজি
কোরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব
বালিগ, মুকিম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) ব্যক্তি ১০ জিলহজ ফজর হতে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তার ওপর কোরবানি করা ফরজ। কোরবানি ওয়াজিব হবার জন্যে জাকাতের মতো নিসাব পরিমাণ সম্পদ পুরো এক বছর নিজ আয়ত্তে থাকা শর্ত নয়। বরং যে অবস্থায় সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়, ঐ অবস্থায় কোরবানি করাও ওয়াজিব হয়। তবে মুসাফির ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। কোন মহিলা নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করা ওয়াজিব।
সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক ব্যক্তির ওপর শুধুমাত্র একটি কোরবানি করা ওয়াজিব, যদিও তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হোন। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কোরবানি না করাই উত্তম।   
কোরবানির শিক্ষা ও করণীয়
পবিত্র ঈদুল আজহা প্রতিবছর আমাদের কাছে ঘুরেফিরে আসে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পশু কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা করে। এই কোরবানির শিক্ষা কী তা আমাদের জানা দরকার। মনে রাখতে হবে, কোরবানি কেবলমাত্র পশু জবেহ করা নয়। কোরবানি হলো নিজের ভেতরের পশু সত্তাকে জবেহ করা। তার মানে, মনের সকল কুপ্রবৃত্তিকে খতম করা। কোরবানির গোশত পেয়ে গরিব-দুখী খুশি হয়। কোরবানি করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য ও নির্দেশ মানার শিক্ষা গ্রহণ করে। কোরবানির দিন মুসলমানরা একে অপরের সাথে মহামিলনে মিলিত হয়। এদিন ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এতে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি হয়। তাই কোরবানির যাবতীয় আহকাম মেনে খোদাভীতির মানসিকতা নিয়ে কোরবানি করা দরকার। তা হলে আশা করা যায়, আল্লাহর দরবারে আমাদের কোরবানি কবুল হবে। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সমর্থ্য হবো।   



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদুল আজহা ও কোরবানি

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন